পাওনি তার কারণ আহত ব্যক্তি চিৎকার করবারও সময় পায়নি—it was so sudden! কিন্তু সে কথা থাক। যা হয়ে গেছে তার জন্য দুঃখ করে লাভ নেই। চল আর একবার সব ঘুরে ভাল করে দেখা যাক।
বাগানের পিছনের দরজা দিয়ে গলিপথে এসে দাঁড়ালাম দুজনে।
সামনেই একটা পোড়ো মাঠ। তার ওদিকে কতকগুলো খোলার বস্তি।
অনেক দূরে দূরে এক-একটা কেরোসিনের বাতি জ্বলছে। সাধারণতঃ এই অপ্রশস্ত পথটা কুলি-কামিন ছাড়া আর কারও দ্বারা ব্যবহৃত হয় না।
গতরাত্রে বৃষ্টি হয়েছিল, তাই এই গলিপথের কাদা এখনও শুকোয়নি। ঐ দেখ অন্ধকারে এখনও প্রফেসারের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। আমি জানতাম খুনী আজ এখানে আসবে, কিন্তু কেন? খুনী এখানে নিশ্চয়ই কোন ট্যাক্সিতে চেপে এসেছে, কিন্তু বাগানের দরজা পর্যন্ত আসেনি। পাছে তার ড্রাইভারের মনে কোনপ্রকার সন্দেহ জাগে। চল, এগিয়ে গিয়ে দেখা
কিছুদূর এগিয়ে যাবার পরই আমরা গাড়ির চাকার দাগ দেখতে পেলাম ভিজে রাস্তার ওপর। তাহলে কিরীটীর অনুমান মিথ্যা নয়!
কিরীটী আবার বলতে লাগল, আজ রাত্রে খুনী যখন এখানে আসে তখন সে প্রস্তুত হয়েই এসেছিল; কিন্তু যে অস্ত্ৰ দিয়ে সে হত্যা করেছে সেটা রক্তাক্ত অবস্থায় সঙ্গে নিয়ে যায়নি, পাছে ড্রাইভারের মনে সন্দেহ জাগে। ফেলে রেখে গেছে সে সেটা নিশ্চয়ই, কিন্তু কোথায়? চল বাগানটা খুঁজে দেখি। থানায় খোঁজ নিলেই ট্যাক্সি এসোসিয়েশন থেকে আজ এমন সময় কোন ট্যাক্সি ভাড়া করা হয়েছিল। কিনা অনায়াসেই জানতে পারব।
সত্যিই বাগানে খুঁজতে খুঁজতে একটা বকুল গাছের গোড়ায় ছুরিটা পাওয়া গেল।
কিরীটী বললে, থাক, ছুরিটা ধরো না; চল অরুণবাবুর ঘরে যাই। এখুনি থানায় গিয়ে আমি হরিচরণকে এখানে পাঠাব। ভিজে মাটির বুকে অপরাধীর পায়ের দাগ নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। কেননা ট্যাক্সি থেকে নেমে বাকি পথটা সে হেঁটেই বাগানে এসেছিল!..এবারে চল, ভিতরে যাওয়া যাক। ঘরে ঢুকে দেখি একজন ডাক্তার এসেছে; অরুণবাবুকে পরীক্ষা করে ওষুধের ব্যবস্থা দিয়ে তিনি বিদায় নিলে আমরা চলে এলাম।
***
পরের দিন সন্ধ্যার দিকে কিরীটী ফোনে আমায় একবার ডাকল, এখুনি তার ওখানে একবার যেতে হবে, খুব জরুরী। ডাঃ চট্টরাজও তার ওখানেই অপেক্ষা করছেন।
কিরীটীর ওখানে গিয়ে তার গাড়িতেই আমরা সোজা কুমারসাহেবের বাড়িতে গেলাম। দরজার গোড়াতেই ম্যানেজারবাবুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তিনি বললেন, কুমারসাহেব বাড়ি নেই, আজ দুপুরের ট্রেনে নাকি মধুপুর গেছেন কী একটা জরুরী কাজে। কাল রাত্রের ট্রেনে ফিরবেন।
একসময় কিরীটী বললে, শুনেছেন ম্যানেজারবাবু, প্রফেসার শর্মা কাল রাত্রে খুন হয়েছেন?
অ্যাঁ! সে কি—কেন? কেন খুন হলেন? লোক তো খারাপ ছিলেন না নেহাৎ, তবে—; তারপর হঠাৎ কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে ব্যাকুল স্বরে বললেন, খুনীকে নিশ্চয় ধরেছেন, মিঃ রায়!
হ্যাঁ আচ্ছা প্রফেসর শর্মা সম্পর্কে আপনাকে গোটাকতক কথা জিজ্ঞাসা করতে চাই–আশা করি সঠিক জবাব পাব।
মৃদু হেসে ম্যানেজারবাবু জবাব দিলেন, কিরীটীবাবু কি মনে করেন, প্রফেসার শর্মার হত্যা সম্পর্কে কোন কিছু আমি জানি!
না, সেজন্য নয়, তার সম্পর্কে কয়েকটা কথা জানা প্রয়োজন, তাই। আচ্ছা শুনেছি নাকি ভদ্রলোকের জন্ম ও জন্মাবার পর অনেক দিন তার কাশীতেই কেটেছিল? অথচ তিনি বলতেন, তিনি বহুকাল বাংলা দেশেই আছেন এবং জন্মও নাকি তার এই দেশেই! তাছাড়া অরুণবাবু যে সমস্ত চেক শর্মাকে দিতেন, আপনি নাকি সেগুলো আপনার অ্যাকাউন্টেই ব্যাঙ্ক থেকে ভাঙ্গিয়ে দিতেন? একথা কি সত্যি ম্যানেজারবাবু?
সম্পূর্ণ মিথ্যে কথা মশাই। আমার নিজের ব্যাঙ্ক-অ্যাকাউন্টে কারও চেক আমি কোনদিনই ভাঙাইনি।–
বেশ। শুনেছি। তিনি একটা নাটক লিখেছিলেন এবং সেই নাটক নিয়ে থিয়েটার খুলবোর
এ কথা কি সত্যি?
হ্যাঁ, আমিও তা শুনেছি বটে।
আমরা মার্বেল হাউস থেকে বের হয়ে গাড়িতে চেপে বিকাশ মল্লিকের বাসায় গিয়ে হাজির হলাম।
বিকাশবাবু তখন বের হবার আয়োজন করছেন, আমাদের দেখে বৈঠকখানায় নিয়ে গিয়ে বসালেন।
তারপর কিরীটীবাবু, কি মনে করে? আপনার ‘কেস’, কতদূর এগুলো?
আপনি প্রফেসর শর্মাকে চিনতেন, বিকাশবাবু? কিরীটী প্রশ্ন করল।
সামান্যই চেনা-পরিচয় ছিল। তার সম্পর্কে প্রায়ই আমি অনেক কথা শুনতাম। উনি বেশ চমৎকার ‘হিন্দী’ বলতে কইতে পারতেন। শুভঙ্করবাবুর বাড়িতেই ওঁর সঙ্গে আমার আলাপ হয়। নেহাৎ মন্দ লোক বলে তাঁকে আমার কোনদিন তো মনে হয়নি! তবে একটু যেন ‘হামবাড়া’ গোছের লোক ছিলেন। …এরপর আরো কিছুক্ষণ কথাবাতাঁর পর আমরা বিদায় নিলাম।
***
গাড়ি কীলীঘাট ব্রীজ পার হতেই কিরীটী হীরা সিংকে বললে, টালিগঞ্জে ব্যারিস্টার চৌধুরীর বাড়ি।
ময়নাঘরের সামনে এসে দাঁড়াল।
পুলিস সার্জেন ও একটা ডোম আমাদের জন্যে ঘরের মধ্যে অপেক্ষা করছিল।
পুলিস সার্জেন আমাদের আহ্বান জানালেন, শুভসন্ধ্যা, মিঃ রায়!
আপনার মৃতদেহগুলো কোন ঘরে থাকে? কিরীটী প্রশ্ন করল।
ঠাণ্ডি ঘরে।
শুভঙ্কর মিত্রের মৃতদেহটাও আছে বোধ হয় সেইখানেই।
হ্যাঁ, চলুন। এই কাল্লু, পরশুকার সেই গলাকাটা দেহটা ও মাথাটা স্ট্রেচারে করে বাইরে নামা!
কাল্লু চলে গেল।
সার্জেনের পিছু পিছু আমরা একটা অল্প পরিসর ঘরের মধ্যে এসে ঢুকলাম। একটা বিশ্ৰী উৎকট গন্ধে নাড়ি পাক দেয়। সামনেই একটা সেলফের মত আলমারিতে পার পর কতকগুলো মৃতদেহ সাজানো। কাল্প স্ট্রেচারে করে শুভঙ্কর মিত্রের মৃতদেটা সামনে এনে নামাল আর একজন ডোমের সাহায্যে।