উঃ, সে কী তীব্ৰ হাসি! কবর ভেঙে যেন কোন অশরীরী প্রেতাত্মা এসে এখানে উন্মাদের মত হাসছে।
আমি অরুণবাবুর হাত ধরে প্রবল এক ঝাকুনি দিয়ে বললাম, কী হাসছেন পাগলের মত! থামুন, থামুন অরুণবাবু! অরুণবাবু, শুনছেন? আপনি কি পাগল হলেন? অরুণবাবু পূর্বের মতই উন্মাদ হাসি হাসতে হাসতে অদূরে একটা ঝোপের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলতে লাগলেন, আমি দেখেছি তাকে সন্ধ্যাবেলা ঐ ঝোপের ধারে। আমি দেখেছি। জানি সে কে। সে মরে গিয়েও আমাদের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছিল। প্ৰতিহিংসা! প্রতিহিংসা! হাঃ হাঃ হাঃ!
আঃ, অরুণবাবু! থামাবেন আপনার হাসি?
এবারে যেন অরুণ করা হঠাৎ হাসি থামিয়ে ফেললেন।
থেমেছি। আর হাসব না। কিন্তু আমি জানতাম যে সে মরবে। কিন্তু আমার বাড়িতেই বাগানের মধ্যে এমনি করে নিজেকে নিজে হত্যা করল!
কী পাগলের মত বকছেন যা-তা? আত্মহত্যা করলে মাথা ওরকম দেহ থেকে প্রায় পৃথক হয়ে আসতে পারে নাকি?
সহসা যেন অরুণবাবু আমার কথায় চমকে উঠলেন। কী বললেন সুব্রতবাবু…তবে সতি্যু কি সে আত্মহত্যা করেনি? তবে কে তাকে এত রাত্রে খুন করে গেল আমন করে? সে নিজে নিজেকে তবে হত্যা করেনি? খুন করেছে। ওকে! না, না, আত্মহত্যা করেছে ও; হ্যাঁ, আত্মহত্যাই করেছে, আপনি জানেন না।
না। আত্মহত্যা নয়, কেউ খুনই করেছে। ভাল করে দেখুন না।
তবে কে হত্যা করলে তাকে আমন করে? কে? কে?
তা কী করে জানিব? নিশ্চয়ই কেউ করেছে।
সহসা যেন অরুণবাবুর সমস্ত মুখখানা রক্তহীন পাংশু হয়ে গেল। অর্থহীন দৃষ্টিতে অদূরে অন্ধকার ঝোপের দিকে তাকিয়ে রইলেন। অদূরে ঝোপের অন্ধকারে হঠাৎ একটা যেন সিগারেটের লাল আগুন দেখা গেল। সঙ্গে সঙ্গে পায়ের শব্দও শুনতে পেলাম যেন। তারপরই পরিচিত গলার আওয়াজ কানো এল।
সুব্রত, এখানে উপস্থিত থেকেও তুমি এমন করে খুন হতে দিলে? একটু বাধা দিতে त्र्ङ्ग(ब्ल नां?
কালো সার্জের সুট পরা, সিগারেট ফুকতে ফুকতে ঝোপের আড়াল থেকে ধীরপদে কিরিটী বের হয়ে এসে আমাদের সামনে দাঁড়াল।
কিরীটী, তুমি এখানে! অস্ফুট কণ্ঠে প্রশ্ন করলাম, হত্যাকারীকে তাহলে তুমি দেখতে পেয়েছ নিশ্চয়ই?
না, দেখিনি। কিন্তু অরুণবাবু অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, আগে ওঁকে ঘরে নিয়ে যাও। তারপর বলছি কেমন করে এখানে এলাম।
আমি অরুণবাবুকে তখন চাকরীদের সাহায্যে তীর শোবার ঘরে পৌঁছে দিলাম।
কিরীটীও পিছনে পিছনে এসে ঘরে ঢুকল।–বেচারী অত্যন্ত আঘাত পেয়েছেন এবং অসুস্থও হয়ে পড়েছেন। পাশের ঘরে ফোন আছে, একজন ডাক্তারকে ফোন করে দাও আগে সুব্রত। ইতিমধ্যে আমি একবার বাইরেটা ঘুরে আসি। ওঁর শ্বাসপ্রশ্বাস যে রকম ভাবে পড়ছে, এখুনি একজন ডাক্তার ডাকা দরকার!
কিরীটী ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল। আমি অরুণবাবুর পাশেই বসে রইলাম।
একসময়ে চেয়ে দেখি, অরুণবাবু ক্লান্তিভরে ঘুমিয়ে পড়েছেন।
পাশের ঘরেই টেলিফোন ছিল, গাইড দেখে একজন ডাক্তারকে কল দিলাম, তারপর কিরীটির খোঁজে বাইরে গেলাম।
বাগানে ঢুকে দেখি অন্ধকারে টর্চের আলো ফেলে কিরীটী বাগানের মধ্যে কিসের সন্ধানে যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে।
পদশব্দে কিরীটী আমার সামনে এসে দাঁড়াল। অস্থির অসংযত চাপা স্বরে বললে, উঃ সুব্রত, আমি একটা আস্ত গাধা! সত্যি বলছি, আমি একটা গাধা। আমি ভুল লোককে পাহারা দিচ্ছিলাম এতক্ষণ। সত্যি এ ভুলের প্রায়শ্চিত্ত নেই। কিন্তু কাল রাত্রেও আমি জানতাম না সত্যিকারের খুনী কে। আমি তোমার কাছে প্রতিজ্ঞা করছি সুব্রত, কাল রাত্রের আগেই খুনীকে আমি ধরিয়ে দেব। আর তা যদি না পারি, আমি কিরীটী রায়ই নই। এস। উত্তেজনায়। কিরীটীর কণ্ঠস্বর শেষের দিকে যেন কাঁপাছিল।
কিছু বুঝতে পারলে? আমি প্রশ্ন করলাম।
এস তোমাকে দেখাই।
চল।
আমরা দুজনে মৃতদেহের কাছে দাঁড়ালাম বাগানে।
কিরীটী বলতে লাগল, ভাল করে চেয়ে দেখ, অস্ত্ৰ দিয়ে গলা কেটে একে খুন করা হয়নি। প্রথমে কেউ প্রফেসারকে দুবার ছোরা মেরেছে, একবার পিছন দিকে পিঠে, আর একবার পাশের পাঁজরায়। তারপর কোন ধারালো অস্ত্ৰ দিয়ে দেহ থেকে মাথাটা পৃথক করে ফেলেছে। চেয়ে দেখ, দুটি কশেরুকার (vertibra) মধ্যবর্তী তরুণাস্থির (cartillage) মধ্য দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। সাধারণ লোক এভাবে আঘাত করতে পারে না। যে আঘাত করেছে, মানবদেহের গঠন-প্ৰণালী সম্পর্কে তার সম্পূর্ণ জ্ঞান আছে। অস্ত্রবিদ্যায় (surgery) সুপণ্ডিত না হলে এভাবে হত্যা করা একেবারেই অসম্ভব। আর wound দেখে মনে হয় এক ইঞ্চি পরিমাণ চওড়া কোন ভারী অস্ত্ৰ দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। অনেকটা বৰ্মার একপ্রকার অস্ত্রের মত। তারপর কিরীটী টর্চের আলো ফেলে দেখােল, ঐ যে সরু রাস্তাটা বরাবর বাগানের মধ্য দিয়ে বাগানের পিছনের দরজা পর্যন্ত গেছে, দেখ ওখানে রক্তের দাগ রয়েছে। খুব সম্ভব দরজার কাছাকাছি কোথাও দাঁড়িয়ে জানালা-পথে প্রফেসার তোমাদের লক্ষ্য করেছিলেন, এমন সময় হত্যাকারী পিছনের দরজা দিয়ে এসে পিছন থেকে প্রফেসারকে ছোরা বসায় পিঠে। ছোরার আঘাত খেয়ে প্রফেসার সামনের দিকে চলে আসেন। সেই সময় পিছন থেকে হত্যাকারী হতভাগ্যের গলা কেটে ফেলবার চেষ্টা করে।
উঃ আর কয়েক সেকেণ্ড আগেও যদি বাগানে আসতাম। কিরীটী, তবে হত্যাটা হত না। কিন্তু আশ্চর্য কোন চিৎকার বা শব্দও তো শুনতে পাইনি! দুঃখিত স্বরে বললাম।