করিডোরের সামনেই বোধ করি ড্রয়িং রুম। সূক্ষ্ম সিঙ্কের নেটের সবুজ পর্দা ভেদ করে ঘরের আলোর আভাস এদিকে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।
ড্রয়িং রুমে নিশ্চয় কারা বসে আছে মনে হল আমার, কারণ মৃদু কথা-বার্তার শব্দ শোনা যাচ্ছিল।
সহসা একটা তীক্ষা গলার স্বর শোনা গেল, না, না—এ আমি সহ্য করব না। কিছুতেই সহ্য করব না। বুঝে দেখ অরুণ, ভেবে দেখ!
চমকে উঠলাম। প্রফেসর শর্মার গলা। থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম।
ম্রিয়মাণ কণ্ঠস্বরে অতি কষ্টে অরুণবাবু যেন জবাব দিলেন, কেন এই নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন মিঃ শৰ্মা? এর চাইতে একটুও বেশী আমি জানি না। আর জানতামও না।
তাহলে এই আমাকে বিশ্বাস করতে হবে, কর?
হ্যাঁ। কিন্তু প্রফেসার এবারে আপনাকে যেতে হবে। আমার একজন বন্ধুর এখানে আজ রাত্রে নিমন্ত্রণ আছে। হয়তো এখুনি তিনি এসে পৌঁছবেন।
আমি এগিয়ে গিয়ে দরজায় ধাক্কা দিলাম।
ভিতর থেকে আহ্বান এল, আসুন ভিতরে।
ভিতরে প্রবেশ করে দেখলাম, চমৎকার আধুনিক কেতায় সুসজ্জিত একখানি ড্রয়িং রুম, চারদিকে সোফা-কাউচ। মাঝখানে একটা শ্বেতপাথরের টেবিলে প্রকাণ্ড একটা জয়পুরী ফ্লাওয়ার ভাসে এক থোকা শুভ্র রজনীগন্ধা। বাতাসে তার মিষ্ট গন্ধ ছড়িয়ে দিচ্ছে।
আসুন, আসুন সুব্রতবাবু। অরুণবাবু বললেন, এঁকে চেনেন তো? প্রফেসার কালিদাস শৰ্মা—আমার বিশেষ বন্ধু।
হ্যাঁ, চিনি বৈকি।
নমস্কার সুব্রতবাবু। তারপর প্রফেসার নিঃশব্দে টুপিটা হাতে তুলে নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন, আচ্ছা শুভরাত্রি অরুণ, শুভরাত্রি সুব্রতবাবু! আমার গাড়ি গলির মুখেই আছে, আমি পিছনের দরজা দিয়েই চললাম।
প্রফেসার নিঃশব্দে বের হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ অরুণবাবু চুপচাপ বসে রইলেন, তারপর হঠাৎ একসময় বললেন, চা আনতে বলি সুব্রতবাবু?
না, থাক। এত রাত্রে আর চা খাব না।
আপনিও একজন ডিটেকটিভ, না সুব্রতবাবু?
না।
ভয়ঙ্কর চরিত্রের লোকগুলোকে আমার চিরকালই খুব ভাল লাগে, জানেন সুব্রতবাবু।
কেন বলুন তো?
আমার কথার কোন জবাব দিলেন না। অরুণবাবু, চুপচাপ বসে রইলেন, তারপর সহসা একসময় বললেন, চলুন, পিছনের বাগানে আমাদের খাবার আয়োজন করেছি। বাগানের মধ্যে টেবিল-চেয়ার পাতা, মাথার উপর চীনা-লণ্ঠনের পীতাভ আলো। চলুন। চমৎকার আইডিয়া, না?
আমরা দুজনেই উঠলাম।
বাড়ির পিছনে ছোটখাটো একটি ফুলের ও ফলের বাগান আছে। একটা কামিনী গাছের তলায় টেবিল-চেয়ার পেতে খাবার আয়োজন করা হয়েছে।
শীতের রাত্রে এই খোলা বাগানে বসে খাওয়া…হাসি পাচ্ছিল। মাথার ওপরে গাছের ডালে ঝুলছে গোটাচারেক চীনা-লণ্ঠন। একটা পীতাভ আলোয় চারিদিক যেন স্বপ্নাতুর হয়ে উঠেছে।
এও এক অভিজ্ঞতা।
বাবুর্চি এসে টেবিলে খাবার দিয়ে গেল। গল্প করতে করতে আমরা খাওয়া শুরু করলাম। কথায় কথায় সাহিত্য নিয়ে তর্ক উঠল।
অরুণবাবু বলতে লাগলেন, রূপকথা পড়তে আমার বড় ভাল লাগে সুব্রতবাবু, একজন বন্ধুর মুখে একদিন আমি ‘সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে, রূপকথাটা শুনেছিলাম, বন্ধু আমাকে বইখানা এনে দেবেও বলেছিল। এনেও দিয়েছিল, অথচ বইখানা হিন্দীতে অনুদিত। উঃ, কি বিচ্ছিরি ঐ হিন্দী ভাষাটা! আমি দুচক্ষে দেখতে পারি না। শেষটা আমি নিজেই একটা বাংলায় লেখা বই কিনি।
অরুণ করের কথায় আমার সহসা যেন তরতর করে দেহের সমস্ত রক্ত মাথায় গিয়ে উঠেছে বলে মনে হতে লাগল। তারপর আবার একসময় আত্মগতভাবেই তিনি বলতে লাগলেন, মানুষ মরেই, তার জন্য দুঃখ নেই। কিন্তু আমি গোলমাল ভালবাসি না। শান্তি চাই। সম্পূর্ণ শান্তি।
খাওয়া-দাওয়া শেষ হবার পর আমারা দুজনে বাগানে নানা গল্প করতে করতে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। মাথার উপরে নিঃশব্দ শীতের রাত্রি। রাতের চোরা হাওয়ায় বাগানের গাছপালার পাতায় পাতায় মাঝে মাঝে সিপি সিপ শব্দ জাগে। চারিদিকে একটা অদ্ভুত থমথমে ভাব।
বাগানের এক দিকে কৃত্রিম ফোয়ারা থেকে ঝিরঝির করে জল পড়ছে। ফোয়ারার চার পাশ শ্বেতপাথরে গোল করে বাধানো।
ক্ষীণ অষ্টমীর চীদ মৃদু আলো বিকীরণ করছে শীতের আকাশের গায়ে। একটা বড় শিশু গাছের তলায় আসতেই সহসা অরুণবাবু পায়ে কি বেধে হোঁচটি খেয়ে পড়ে যেতে যেতে উঃ বলে নিজেকে যেন কোনমতে সামলে নিলেন।
আমি শশব্যস্ত তাঁকে ধরে সামলাতে গিয়ে মৃদু চাঁদের আলোয় সামনের দিকে চেয়ে বিস্ময়ে আতঙ্কে নির্বক হয়ে গেলাম। রক্তাক্ত একটা মৃতদেহ বাগানের মধ্যে ঘাসের ওপর উপুর হয়ে পড়ে আছে। গলাটা ধড় থেকে প্রায় দু ভাগ হয়ে এসেছে সামান্যর জন্য একেবারে পৃথক হয়নি।
সেই অস্পষ্ট আলো আঁধারিতেও চিনতে আমাদের কষ্ট হয়নি মৃতদেহটি কার। মৃতদেহটি প্রফেসার কালিদাস শর্মার।
একটা আর্ত চিৎকার করে হঠাৎ অরুণবাবু অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন।
অদৃশ্য আততায়ীর মরণ পরশ আবার নিঃশব্দে একজনকে গ্রাস করল।
উঃ কী ভয়ানক দৃশ্য! কী নিষ্ঠুর হত্যা! কী দানবীয় কাণ্ড!
একটা অশরীরী আতঙ্ক যেন মৃদু পদবিক্ষেপে বাগানের গাছের আড়ালে আড়ালে অন্ধকারে এগিয়ে আসছে। প্রথমটায় বেশ একটু যেন হকচকিয়েই গিয়েছিলাম, তারপর ঝরনা থেকে জল এনে জ্ঞানহীন অরুণবাবুর চোখে-মুখে ঝাপটা দিতে লাগলাম; কিছুক্ষণ বাদে অরুণবাবুর জ্ঞান ফিরে এল। তারপর অরুণবাবু খানিকটা সময় গুম হয়ে বসে থেকে একসময় হঠাৎ পাগলের মতই হাঃ হাঃ করে অদ্ভুতভাবে হাসতে শুরু করলেন।