তাহলে আর কি হবে, হতাশ হতে হল। আজ তবে আসি সর্দার। গ্রে স্ট্রীটের দিকে একটা জরুরী কাজ আছে…এখুনি যেতে হবে একবার। প্রফেশার শর্মা বলে ওঠেন।
আরে তাই নাকি, আমার বন্ধুরাও তো রাত্রে আজ ও পাড়াতেই নিমন্ত্রণ! কি হে সব্রত, অরুণ করের বাড়িতে আজ তোমার নিমন্ত্রণ না? কিরীটী আমার মুখের দিকে তাকিয়ে সহস্যে বললে।
কিরীটীর কথায় প্রফেসর শর্মার চোখ দুটো সহসা একবার তীক্ষ হয়েই আবার স্বাভাবিক হয়ে এল।
এরপর আমরা সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে রাম সিং-এর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে এসে উঠে বসলাম। রাত্রির অন্ধকারে হেডলাইট জ্বলিয়ে গাড়ি ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোড ধরে ছুটে চলল।
কিরীটী একসময় হীরা সিংকে ডেকে আদেশ দিল, হীরা সিং, পথে মেছুয়াবাজারে একবার ডাঃ রুদ্রের ল্যাবরেটরীর সামনে থেমে। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললে, আচ্ছা সুব্রত, এককালে তো তুমি কলেজ-জীবনে শুনেছি। একজন খুব নামকরা ‘অ্যাথলেট’ छिटुब्न? –
কেন বল তো হঠাৎ এ প্রশ্ন?
আচ্ছা তোমরা যখন কোন জায়গায় শো দেখাতে যেতে, তোমাদের সঙ্গে বড় বড় লাগেজ থাকত না?
তা থাকত বৈকি! আমি জবাব দিলাম।
কিরীটী মৃদুস্বরে বললে, হুঁ, এবারে পাকা বন্দোবস্ত। সন্দেহ হবার যেটি নেই। কিরীটী অন্যমনস্ক ভাবে কী যেন ভাবতে লাগল এর পর।
যথাসময়ে আমাদের গাড়ি ডাঃ রুদ্রের ল্যাবরেটরীর দরজার সামনে এসে দাঁড়াল।
ডাঃ রুদ্র ল্যাবরেটরীতে ছিলেন না। তাঁর একজন সহকারী আমাদের এসে অভ্যর্থনা করে সমাদরের সঙ্গে বসবার ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাল, বললে, বসুন, ডাক্তার একটা জরুরী কাজে বের হয়েছেন, ফিরতে একটু দেরী হবে।
সহকারীর হাতে কিরীটী পকেট থেকে একটা লেড পেনসিল বের করে দিয়ে বললে, ডাঃ রুদ্রকে এই পেনসিলটা একটিবার পরীক্ষা করে দেখতে বলবেন তো অমিয়বাবু!…আমি শুধু জানতে চাই পেনসিলটা কোন গ্রুপের। হ্যা ভাল কথা, যে বইটা দিয়ে গিয়েছিলাম, তার থেকে ফটো নিয়ে ডেভলাপ করে দেখবার কথা ছিল, সেটা করা হয়েছে কি?
আজ্ঞে, ফটোর নেগেটিভটা শুকোচ্ছে। আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি, সাধারণ লেখবার কালি দিয়েই বইয়ের ওপর নামটা লেখা হয়েছিল। বইয়ের ওপর পড়া গেছে পরিষ্কার।
খুব সুখবর! প্লেটটা এখনি দেখবখন। হ্যাঁ, পুলিসের রিপোর্টটা সার্জেন দিয়ে যায়নি?
হ্যাঁ, ডাক্তার বলছিলেন মৃত মিঃ মিত্রের রক্ত ও হৃৎপিণ্ড পরীক্ষা করে দেখা গেছে, তিনি আফিংয়ের নেশায় নাকি অভ্যস্ত ছিলেন, প্রায় অন্তত বছর খানেক ধরে।
হ্যাঁ। কুমারসাহেবের প্রাইভেট রুমের জানালার কাছে যে আঙুলের ছাপের ফটো তোলা হয়েছিল সেটার রিপোর্ট কী?
হুবহু স্যার দিগেন্দ্রর আঙুলের ছাপের সঙ্গে মিলে গেছে স্যার।
বেশ। যে তলোয়ারটা সেই ঘরে পাওয়া গিয়েছিল তার গায়ে কোন আঙুলের ছাপ পাননি, না?
আজ্ঞে না।
সবাই আপনারা ভালভাবে পরীক্ষা করে দেখেছিলেন তো অমিয়বাবু?
হ্যাঁ স্যার, সব কিছুই পরীক্ষা করে দেখেছি।
এবারে কিরীটী আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে বললে, আমাদের কথাবার্তা শুনে সুব্রত বোধ হয় খুব আশ্চর্য হয়ে গেছ, না? ডাক্তারও হয়তো হয়েছেন। কিন্তু একটা কথা কি জানেন? একটা ‘ক্রাইমকে অনুসন্ধান করে তার গোপন কথা জানতে হলে অনেক ছোটখাটো ব্যাপারেরও সাহায্য নিতে হয়। কারণ অনেক সামান্য ব্যাপারের মধ্যে কত সময় যে আমরা প্রয়োজনীয় সূত্রের সন্ধান পাই ভাবলেই বিস্মিত হতে হয়। একজন খুনী বা দোষীকে খুঁজে বের করতে হলেই যে টনটনে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থাকতেই হবে তার কোন মানে নেইসামান্য বিচার বুদ্ধি ও common sense থাকলেই যে কেউ খুনীকে অনায়াসেই খুঁজে বের করতে পারেন.I.অন্তত আমার বিশ্বাস তো তাই।
এরপর একটু থেমে আবার বলতে শুরু করে, জানি জীবনে শত পরাজয় আছে এবং সেইজন্যই হঠাৎ পাওয়া একটি দিনের জয়ের আনন্দ অতীতের সমস্ত পরাজয়ের বেদনায় যেন শান্তিবারি ছিটিয়ে দেয়। ঐ ধৈর্য, অধ্যবসায় ও সহজ বিচার-বুদ্ধি আছে বলেই জীবনে আজ পর্যন্ত আমি কখনো হতাশ হইনি। যে কোন রহস্যই আমার কাছে বিচার ও বিশ্লেষণে অল্প সময়ের মধ্যে সহজ হয়ে গেছে। যা হোক, এবার আমাদের উঠতে হয়, রাত্রি প্রায় সাড়ে আটটা হল। বলতে বলতে কিরীটী আমার ও ডাক্তারের চোখের সামনে একটা টাইপ করা কাগজ মেলে ধরলা, তাতে এই কটা কথা লেখা।
“প্রফেসার কালিদাস শর্মা,-খোঁজ নিয়ে দেখলাম লোকটার বাড়ি ও জন্মস্থান কাশীতে। ওইখানেই এবং পরে পাটনায় ও কাশীতে ওঁর জীবনের চব্বিশটা বছর কাটিয়েছেন। ওঁর পিতার নাম স্বৰ্গীয় জ্ঞানদাস শৰ্মা। পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ভিদ বিজ্ঞানে এম. এ. ডিগ্ৰী নেন। তার পর কলকাতায় ১৯৩৬ সন থেকে প্রফেসারী শুরু করেন। কিন্তু একটি বৎসর না যেতেই ১৯৩৭ সালে কলেজ সংক্রান্ত কতকগুলো কী ব্যাপার নিয়ে চাকরী যায়। বর্তমানে তিনি কোথাও কোন কাজ করেন না, তবে প্রায়ই দেখা গেছে অরুণ করের নাম সই করা চেক ব্যাঙ্ক থেকে উনি ভাঙিয়ে নিয়েছেন।”
কিরীটী আমাদের দিকে একবার চেয়ে অদ্ভুত একটু হেসে কাগজটা মুড়ে ভাঁজ করে পকেটে রেখে উঠে দাঁড়াল। চল, আশা করি এর পর আর রহস্যের মূল সূত্রটি খুঁজে পেতে তোমাদের কারও কষ্ট হবে না।
গাড়িতে বসে কিরীটী বললে, তাহলে সুব্রত, তুমি তো অরুণ করের বাড়িতেই যাবে, না?
হ্যাঁ।
আচ্ছা। আমার একটা জরুরী কাজ আছে। অন্য জায়গায়, আমি আপাতত সেইখানেই যাব।
১২. আমার গাড়িটা বিগড়ে আছে
আমার গাড়িটা আজ ক’দিন হতে বিগড়ে আছে, অগত্যা বাসে চেপেই অরুণ করের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে চললাম। রাত্রি তখন সাড়ে আটটা হবে, গ্রে সন্টীটের মোড়ে বাস থেকে নামলাম। অরুণ করের দেওয়া ঠিকানা মত র্তার বাড়িটা খুঁজে নিতে আমার বিশেষ কোন বেগ পেতে হল না। ট্রাম রাস্তার পিছনে একটা গলির মধ্য দিয়ে একটু এগিয়ে গেলে অরুণ করের বাড়ি। চমৎকার আধুনিক প্যাটানের কংক্রীটের তৈরী মাঝারি গোছের একখানা দ্বিতল স্বাড়ি; লোহার গেট পার হলেই সামানেই একটা ‘লন’—লাল সুরকি ঢালা রাস্ত বরাবর দরজা পর্যন্ত গেছে; দু’পাশে কেয়ারী করা মেহেদির বেড়া ও নানাজাতীয় প্রচুর মরসুমী ফুলের সৌন্দর্যের সমারোহ। তারপরই সাদা ধবধবে বাড়িখানি একটা সুমিষ্ট ফুলের গন্ধ বাতাসে ভাসিয়ে আনে।