কিছুক্ষণ থেমে আবার কিরীটী শুরু করে, স্যার দিগেন্দ্র অবিশ্যি প্রথমে ভাইপোকে বিশ্বাস করতে পারেননি। কিন্তু ভাইপো অনেক কিছু প্রমাণের দ্বারা কাকার সমস্ত সন্দেহের নিরবসান করে দিলেন। আত্মীয়স্বজনদের মধ্যেও অনেকেই তাকে নিঃসন্দেহে গণেন্দ্রনারায়ণের একমাত্র সন্তান “দীপেন্দ্র’ বলে মেনে নিলেন। এবং অতঃপর স্যার দিগেন্দ্ৰ ভাইপো দীপেন্দ্ৰকে প্রাসাদে স্থান দিলেন। এরপর কিছুদিন নির্বিয়ে কেটে গেল। তারপর হঠাৎ একদিন শোনা গেল, স্যার দিগেন্দ্রর নাকি কেমন মাথায় গোলমাল দেখা দিয়েছে। দিনের বেলায় লোকটি ধীরস্থির, অত্যন্ত ভদ্র ও অমায়িক; কিন্তু রাত্রি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেন তঁর মাথায় খুন চাপে; ধারালো ছুরি ও ক্ষুর নিয়ে সামনে যাকে দেখেন তাকেই খুন করতে যান। ডাক্তার এল, বললে, রোগটা ভাল না। অত্যাধিক চিন্তার ফলে নাকি এরকমটি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিলেন রোগীকে এখন সর্বদা চোখে চোখে রাখতে হবে। এমনি করেই কিছুদিন চলল, সহসা এক রাত্রে স্যার দিগেন্দ্ৰ কুমার দীপেন্দ্রনারায়ণকেই ধারালো একটা ক্ষুর দিয়ে কাটতে উদ্যত হলেন।
হ্যাঁ, আমিও খবরের কাগজে এ ব্যাপারটা পড়েছি। বললাম, খুব বাঁচা বেঁচে গিয়েছিলেন সেদিন কুমারসাহেব। এবং তারপরই স্যার দিগেন্দ্রকে রাঁচির পাগলা-গারদে ভর্তি করে দেওয়া श, न्यों?
কিরীটী মৃদুকণ্ঠে বলল, হ্যাঁ।
এখনও রোধ হয় পাগলা-গারদেই আছেন? বেচারী! অত বড় একটা প্রতিভাসম্পন্ন লোক!
না, মোটেই না। কিরীটী মৃদু হেসে বললে, তোমরা জািন লক্ষপতি স্যার দিগেন্দ্রনারায়ণকে রাঁচির পাগলা-গারদে একটা প্রাইভেট সেলে বছর তিন আগে যেমন রাখা হয়েছিল, এখনও বুঝি তেমন আছেন!
তবে? বিস্মিত দৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে তাকালাম।
বছর দুই হল সহসা এক রাত্রে স্যার দিগেন্দ্ৰ সবার অলক্ষ্যে পাগলা-গারদ থেকে পালিয়ে যান।
বল কি! তারপর?
তারপর,-তারপর আর কি? পুলিস ও আই. বি. ডিপার্টমেন্টের লোকেরা অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাঁর টিকিটের দর্শন আজ পর্যন্ত পাননি।
তারপর একটু থেমে কিরীটী বললে, কিন্তু মাত্র সপ্তাহখানেক হল একটা মজার সংবাদ পাওয়া গেছে। সংবাদটা অবিশ্যি অত্যন্ত গোপনীয়, আই. বি. ডিপার্টমেন্টের এক “কনফিডেনসিয়াল’ ফাইলেই মাত্ৰ টোকা আছে।
আমি রুদ্ধনিশ্বাসে প্রশ্ন করলাম, কী?
মাস দুই আগে খবরের কাগজে বিখ্যাত ডাঃ রুদ্রের অদ্ভুতভাবে নিহত হবার কথা পড়েছিলি, মনে আছে সু?
মৃদু স্বরে বললাম, মনে আছে বৈকি।
কিরীটী প্রায়-নিভন্ত চুরুটাটা গাড়ির জানলা দিয়ে ফেলে দিল। তারপর বলতে লাগল, সমগ্র ভারতবর্ষে ডাঃ রুদ্রের মত Plastic surgery-তে (গঠন-মূলক অস্ত্ৰ চিকিৎসা) অদ্ভুত পারদর্শিতা আর কারও ছিল না। তিনি দেহ ও মুখের ওপর অস্ত্ৰ দিয়ে সামান্য কিছু কাটাকুটি করে দেহ ও মুখের চেহারা এমন ভাবে পরিবর্তন করে দিতে পারতেন যে, তাকে পরে আর আগেকার সেই লোক বলে চেনবারও কোন উপায় পর্যন্ত থাকত না।
কিন্তু ডাঃ রুদ্র যেমন একদিকে ছিলেন অদ্ভুত প্রতিভাসম্পন্ন, অন্যদিকে ছিলেন তেমনি একটু বেশ আধপাগলাটে ধরনের ও খামখেয়ালী প্রকৃতির। লোকটার একটা প্রচণ্ড নেশা ছিল, প্রত্যেক রবিবার রাঁচির পাগলা-গারদে গিয়ে বেছে বেছে যারা criminal পাগল তাদের সঙ্গে নানারকম কথাবার্তা বলে বহু সময় কাটিয়ে আসা। ডাঃ রুদ্র আগে যখন কলকাতায় প্র্যাকটিস করতেন, শোনা যায়। তখনও তিনি নাকি বছরের মধ্যে প্রায় চার-পাঁচ বার রাঁচি ও বহরমপুরের পাগল-গারদে ছুটে যেতেন।
শেষটায় বছর দুই হল কলকাতার প্র্যাকটিস তুলে দিয়ে রাঁচিতে গিয়েই সুন্দর চমৎকার একটা বাড়ি তৈরী করে নানকুমে স্থায়ীভাবে বসবাস ও প্র্যাকটিস শুরু করেন। ডাক্তার রুদ্র ছিলেন আজন্ম ব্ৰহ্মচারী। মাস দুই আগে অকস্মাৎ একদিন অতি প্রত্যুষে ডাঃ রুদ্রের দেহহীন মস্তকটি তারই ল্যাবরেটারী-ঘরের কাচের টেবিলের ওপর রক্ষিত একটা কাচের জারের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। পুলিস অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তার দেহটি খুঁজে পায়নি। কাটা মাথাটা দেখে স্পষ্টই মনে হয়, কোন ধারালা অস্ত্ৰ দিয়েই নিখুঁতভাবে দেহ থেকে মাথাটা পৃথক করে নেওয়া হয়েছিল। কিরীটী আবার একটা সিগারে অগ্নিসংযোগ করল। গাড়ি তখন কালীঘাট ব্রীজ ক্রস করে ছুটে চলেছে বেলভেডিয়ার রোড ধরে।
শীতের জলসিক্ত হিমেল হাওয়া চলন্ত গাড়ির মুক্ত জানলা-পথে প্রবেশ করে নাকে মুখে আমাদের যেন ছুচ ফোঁটাচ্ছিল। জ্বলন্ত সিগারের লাল আগুনের আভায় ঈষৎ রক্তাভ কিরীটীর গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে আমি চুপটি করে বসে রইলাম।
কিরীটী আবার বলতে লাগল, পুলিসের ধারণা স্যার দিগেন্দ্ৰই নাকি হতভাগ্য ডাঃ রুদ্রের হত্যার ব্যাপারে অদৃশ্যভাবে লিপ্ত।
কেন? আমি প্রশ্ন করলাম।
কেন, তা ঠিক বলতে পারব না, কিরীটী বলতে লাগল, পুলিসের লোকেরা ডাঃ রুদ্রের অ্যাসিস্টান্ট ডাঃ মিত্রের কাছে কতগুলো কথা জানতে পারে। অ্যাসিস্টান্ট ডাঃ মিত্ৰ বলেন, একটি পেসেন্ট নাকি ডাক্তারের নিহত হবার দিন দশেক আগে তার কাছে চিকিৎসার জন্য আসে এবং ডাক্তার নিজেই একা একা পেসেন্টকে ক্লোরোফর্ম করে তার মুখে অপারেশন করেন-পেসেন্টেরই ইচ্ছাক্রমে ডাঃ মিত্রের কোন সাহায্য না নিয়ে। অ্যাসিস্টান্ট ডাঃ মিত্র অবিশ্যি জীবনে কখনো স্যার দিগেন্দ্ৰকে দেখেননি বা চিনতেনও না এবং লোকটি যে ঠিক কেমন দেখতে তাও তিনি বলতে পারেননি। ডাঃ মিত্রের জবানবন্দি থেকে জানা যায়, সেই পেসেন্ট ডাক্তারের সঙ্গে অন্ধকার ঘরে বসে নাকি কথাবার্তা বলত; তবে অপারেশনের পর রাত্রে একবার অ্যাসিস্টান্টটি পেসেন্টকে পথ্য ও ঔষধ খাওয়াতে কয়েকবার গিয়েছিল সামনে; কিন্তু তখন পেসেন্টের সমস্ত মুখে ব্যাণ্ডেজ বাঁধা, চিনবার উপায় ছিল না। অপারেশনের দিন দুই বাদে এক গভীর রাত্রে পেসেন্ট ডাক্তারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। আগেই বলেছি, শহরের একাধারে ছিল ডাঃ রুদ্রের বাড়ি।