আচ্ছা, সন্ধ্যার পরে প্রফেসর শর্মার বাসায় গেলে তাঁকে পাওয়া যেতে পারে বলে আপনার কি মনে হয় কুমারসাহেব?
তা ঠিক বলতে পারি না, তবে শুনেছি। দমদমার একটা বাগানবাড়িতে তলোয়ার সঙ্ঘ মানে একটা নাকি গুপ্ত সঙঘ আছে; সেইখানে সে ও আমার মৃত সেক্রেটারী প্রত্যহ সন্ধ্যার পর তলোয়ার খেলতে যেত। সন্ধ্যার পর তার বাসায় না পেলেও, সেখানেই হয়তো তাকে পেলেও পেত পারেন। ঠিকানা দিতে পারি। যদি চান।
আমাদের অনুরোধে কুমারসাহেব ঠিকানাটা দিয়ে দিলেন।
কুমারসাহেব, আপনি অরুণ কর বলে কাউকে চেনেন?
আমার মৃত সেক্রেটারীর একজন পরম ভক্ত ছিল শুনেছি। বেশ ছেলেটি। তেমন বিশেষ কিছু নয়, সামান্য একটু-আধটু জানাশোনা হয়েছিল একবার।
দেখুন কুমারসাহেব, কিরীটী বলতে লাগল, একটা খুনের মাওলার তদন্ত করতে গেলে অনেক অপ্রিয় ব্যাপারের সামনে আমাদের যেতে হয়; সেই জন্যই আগে বলে দিচ্ছি, যদি কোন সময়ে অপ্রিয় কিছু বলি তো মনে কিছু করবেন না যেন। আচ্ছা, এমন কি হতে পারে না যে, আপনার কাকা এমন কারও ছদ্মবেশ নিয়েছিলেন, যিনি হয়তো মিঃ শুভঙ্কর মিত্রের সঙ্গে যথেষ্ট পরিচিত ছিলেন? এমন কি হয়তো আপনার সঙ্গেও পরিচয় ছিল সেই লোকটির?
না, সম্ভব নয়।
অবিশ্যি একথা খুবই সত্যি যে, আপনার নিজের কাকাকে আপনি যতটা চেনেন, আর কারও পক্ষে ততটা চেনা একেবারেই সম্ভবপর নয়। আচ্ছা আপনার মনে কি হয়, এমনভাবে কোন পরিচিত ব্যক্তির ছদ্মবেশে আপনার কাকা স্যার দিগেন্দ্র এখানে আসতে পারেন বলে?
না, বললাম তো, একেবারেই তা অসম্ভব। তাছাড়া আমার চোখকে তঁর পক্ষে ফাঁকি দেওয়া সম্ভবপর নয়। মিঃ রায়। এ চিন্তাও বাতুলতা।
যাহোক, কুমারসাহেবের ওখান থেকে বিদায় নিয়ে তীরই দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী আমরা দমদমায় তলোয়ার সঙ্ঘ অভিমুখে যাত্রা করলাম।
ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোডের ওপর সিঁথির কাছাকাছি এক পুরাতন বাগান-বাড়িতে ঐ সঙ্ঘ।
লোহার গেটের মাথায় একটা কেরোসিনের বাতি টিমটিম করে জ্বলছে। বাগানের মধ্যে বড় বড় আমি ও ঝাউ গাছ। অন্ধকারে সো সো করে ঝাউপাতার একঘেয়ে কান্না শোনা যায়।
সঙ্ঘের কর্তা রাম সিং একজন যুদ্ধ ফেরত পাঞ্জাবী হাবিলদার সৈন্য।
কিরীটী ভৃত্যকে দিয়ে তাঁর কাছে কার্ড পাঠাতেই রাম সিং পাশের একটা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।
দানবের মতই উঁচু লম্বা চেহারা, অন্ধকারে যেন মূর্তিমান বিভীষিকার মতই প্রতীয়মান হয়।
রাম সিং আমাদের নিয়ে গিয়ে একটা ছোট কামরার মধ্যে বসলেন। তারপর আমাদের পরিচয় জেনে বললেন, আমিও মিঃ মিত্রের আকস্মিক মৃত্যুসংবাদ পেয়েছি। বাবু। বাঙালীর মধ্যে আমন চমৎকার তলোয়ার খেলতে আজ পর্যন্ত বড় একটা রাম সিংহের চোখে পড়েনি বাবু। মনটা আমার বড় খারাপ হয়ে গেছে। বহুৎ আচ্ছা আদমি থা।
আমি আপনার যে ঘরে খেলা হয়, সে ঘরটা একবার গোপনে দেখতে চাই রাম ਸੇਲੇ!
আসুন না।
পাশের বারান্দা দিয়ে আমরা একটা প্ৰকাণ্ড হলঘরের খোলা জানালার সামনে এসে দাঁড়ালাম। ঘরের আলো বারান্দায় এসেও খানিকটা পড়েছে।
ঘরের দেওয়ালে দেওয়ালে তীক্ষ্ণ সব তলোয়ার টাঙানো।
ঘরের মেঝেতে প্রফেসর শর্মা দাঁড়িয়ে। পরিধানে দামী কালো সার্জের লংস ও ঝোলা একটা জামা গায়ে। মাথার চুলগুলো ব্যাকব্রাস করা। দেহের প্রতিটি মাংসপেশী যেন সজাগ শক্তির অহমিকায় সুস্পষ্ট। ঘরের পরিবেশে আজ প্রফেসর শর্মাকে যেন চমৎকার মানিয়েছে।
হাতে একটা তীক্ষ্ণ তরবারি নিয়ে তিনি চারপাশে বনবান শব্দে ঘোরাচ্ছেন। হঠাৎ এদিকে চোখ পড়তেই আমাদের সকল গোপনতা সত্ত্বেও তীর সঙ্গে চোখাচে্যুখি হয়ে গেল। কিন্তু তিনি কোন ইঙ্গিত দিলেন না।
এমন সময় একজন ভৃত্য একটা থালায় করে বড় বড় সব কাচের গ্লাসে বাদামের সরবৎ নিয়ে ঘরে ঢুকল।
উপস্থিত যাঁরা ছিলেন সকলেই এক-একটা গ্লাস থালার ওপর থেকে তুলে নিলেন।
প্রফেসার শর্মা একটা সরবতের গ্লাস হাতে নিয়ে, সেটা মাথার ওপর তুলে ধরে আনন্দবিহুল কণ্ঠে বললেন, এস, যে বন্ধু আমাদের মারা গেল তাঁর আত্মার কল্যাণে ও যে এর পরে মরবে তার শুভ কামনায় এই সরবত আমরা প্রাণভরে পান করি। হুররে!
সমস্ত সরবতটা এক চুমুকে পান করে, শূন্য গ্লাসটা সামনের একটা টেবিলের ওপরে শৰ্মা নামিয়ে রাখলেন সশব্দে। তারপর এক পাক ঘুরে আবার বললেন, উপস্থিত ভদ্রমহোদয়গণ, আমার কথা আপনারা অবিশ্বাস করবেন না; শীঘ্রই আর একজনের মৃত্যু আসন্ন হয়ে এসেছে আমি স্পষ্ট সেটা যেন অনুভব করছি। বলতে বলতে প্রফেসর শর্মা হস্তধৃত তলোয়ারটার বঁটিটা শক্ত করে চেপে ধরলেন, বন্ধু সকল, আপনাদের মধ্যে কেউ আজ আমার সঙ্গে অসিমুখে শক্তি পরীক্ষা দিতে প্রস্তুত? আসুন তবে! একদিন তলোয়ার না খেললে যেন শরীর আমার ঝিমিয়ে আসে।
প্রফেসার শর্মার চোখে যখন আমরা পড়েই গেছি, তখন আর গোপনতার প্রয়োজনও নেই; তাই আমরা সকলে ঘরের মধ্যে গিয়েই প্রবেশ করলাম।
ওর বুকে একটা সত্যিকারের শক্তি ঘুমিয়ে আছে। বাবু। ও সত্যি বীর! সাবাস রোটা! রাম সিং বললে।
যাক গে, আপনাদের মধ্যে আমার সঙ্গে আসি খেলতে কারও সাহস নেই দেখছি। এই যে আমার নতুন বন্ধু মিঃ কিরীটী রায় এখানে উপস্থিত রয়েছেন, আসুন না, আপনার সঙ্গেই এক হাত খেলা যাক। অবিশ্যি আপনাকে যথেষ্ট সুযোগ দেব।
অশেষ ধন্যবাদ প্রফেসর শর্মা। ওটায় আমি তেমন রপ্ত নই। কিরীটী মৃদুস্বরে জবাব निळा।