কি আর ভাবব! মনটা খারাপ লাগছিল শুভঙ্করদার মৃত্যুর কথা ভেবে ভেবে। বাসায় মন বসল না, তাই কখন এক সময় হাঁটতে হাঁটতে এখানে চলে এসেছি। ভদ্রলোকের চোখের কোণ দুটো সহসা যেন উপচীয়মান অশ্রুধারায় সজল হয়ে এল, মনে পড়ছিল কতদিন এই নির্জন পুকুরের রাণায় আমরা দুজনে বসে তার জীবনের কত সব রোমাঞ্চকর শিকারের অদ্ভূত গল্প শুনেছি। কত ভালবাসতেন। আমাকে শুভঙ্করদা! বলতে বলতে হঠাৎ আবার অরুণ কর চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ, তারপর আবার একসময় আবার বললেন, হ্যাঁ ভাল কথা, জানেন আজ সকালের দিকে আমি একবার কুমারসাহেবের ওখানে গিয়েছিলাম! কথায় কথায় ওঁর সঙ্গে মিঃ মিত্রের কথা উঠতে কুমারসাহেব কী বললেন জানেন?
কী? আমি প্রশ্ন করলাম।
কুমারসাহেব বলছিলেন, শুভঙ্করদার পক্ষে নাকি মরণই মঙ্গল হয়েছে। কি নিষ্ঠুর অথচ কি আশ্চর্য দেখুন! যে লোকটা কুমারসাহেবের জন্য এত করল, তীর মৃত্যুতে তীর চোখে একটু জল পর্যন্ত নেই। অথচ আর কেউ না জানুক আমি তো জানি, এক মূহুর্ত র্তার শুভঙ্করদাকে না হলে চলত না, প্রতি কাজে তাকে তার প্রয়োজন হত। এরপর অরুণ কর কিছুক্ষণ আবার একেবারে চুপচাপ বসে রইলেন; বােধ হয়। অতীত স্মৃতির বেদনায় মনটা ওঁর ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছিল খুব বেশীই! আমিও নীরবে ওঁর পাশে চুপচাপ বসে রইলাম। এমন সময় হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, আচ্ছা এখন চললাম—সেই সকালে বের হয়েছি। যাবেন না। আজ রাত্রে আমার বাসায়! কেউ নেই, মামা-মামী পরশু মধুপুর গেছেন, একদম খালি বাড়ি; সেখানেই খাওয়া দাওয়া করবেন। আসবেন কিন্তু, আসবেন তো?
যাব। মৃদু স্বরে জবাব দিলাম।
অরুণবাবু তাড়াতাড়ি উঠে। গাছের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আমিও উঠলাম।
১১. গাড়িতে বসে ফিরবার পথে
গাড়িতে বসে ফিরবার পথে কিরীটীকে প্রশ্ন করলাম, অনুসন্ধানের মত কিছু পেলে?
না। একটা হাতের লেখার মত কিছু খুঁজছিলাম, কিন্তু পেলাম না। লোকটা দারুণ চালাক, আগে থেকেই সাবধান হয়ে যা কিছু প্রয়োজনীয় সব সরিয়ে ফেলেছে। তবু দুটো জিনিস পাওয়া গেছে। –
কি? কিরীটির মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম।
একটুকরো কাগজ আর এইচ, এইচ, এইচ মার্কা একটা জন ফেবারের ‘লোড’ পেনসিল।
একটা দ্রব্য সেখানে সে বহু যত্নে লুকিয়ে রেখেছে।
ডাক্তার আগেই চলে গিয়েছিলেন। কথা ছিল তিনি পুলিস সার্জেনের ময়নাতদন্তের রিপোর্টটা নিয়ে তার বাসাতেই আমাদের জন্ম: দাপেক্ষা করবেন।
তাই গোটা তিনেকের সময় খাওয়া-দাওয়া সেরে আমরা একবার লালবাজার থানায় পুলিস কমিশনারের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম।
বর্তমান কেস সম্পর্কেই কমিশনার সাহেবের সঙ্গে কিরীটীর নানা কথাবার্তা হল। কিরীটীর সঙ্গে পুলিস কমিশনারের খুব বেশী বুন্ধত্ব, অন্যান্য কথাবার্তার পর সাহেব একসময়ে বললেন, কুমারসাহেব এ ব্যাপারে অত্যন্ত ত্ৰিয়মান হয়ে পড়েছেন মিঃ রায়। তিনি গভর্ণমেণ্টকে দশ হাজার টাকার একটা চেক দিয়ে গেছেন—যে খুনিকে ধরিয়ে দিতে পারবে সে-ই ঐ পুরস্কার লাভ করবে।
তা বৈকি, কিরীটী বললো, তার মত একজন সম্মানিত ব্যক্তির পক্ষে এ বড় কম অসম্মানকর কথা নয়! আজি সংবাদপত্রে দেখছিলাম, বর্তমানে শ্ৰীপুরে যে টি-বি হাসপাতাল তৈরী হচ্ছে গঙ্গার ধারে লক্ষ টাকা ব্যয়ে এবং যার সব কিছু ব্যয়ভার তিনিই নিয়েছেন— সেটা নাকি তার কাকা স্যার দিগেন্দ্রর নামেই ‘দিগেন্দ্র স্যানাটোরিয়াম’ নাম দেওয়া হবেতিনি ঘোষণা করেছেন।
পুলিস কমিশনারের ওখান হতে বিদায় নিয়ে আমরা ডাঃ চট্টরাজের বাসায় গিয়ে দেখি, তিনি আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছেন। তাকে নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। এবং সকলে আমরা বরাবর কুমারসাহেবের ওখানে গিয়ে হাজির হলাম। কথায় কথায় একসময় কিরীটী প্রশ্ন করল কুমারসাহেবকে, আচ্ছা, প্রফেসর শর্মা সম্পর্কে আপনি কতটুকু জানেন বলুন তো কুমারসাহেব?
প্রফেসর শর্মার নামে কুমারসাহেবের সমস্ত শরীরটা যেন সহসা একবার কেঁপে উঠল মনে হল। পরীক্ষণেই উত্তেজিত স্বরে তিনি বললেন, প্রফেসর শর্মা মানুষের দেহে একটি শয়তান মিঃ রায়! He is a dirty snake Blood-sucking Vampire!
প্রফেসর শর্মা আপনার মৃত সেক্রেটারী শুভঙ্কর মিত্রের পরম বন্ধু ছিলেন, তা জানেন বোধ হয় কুমারসাহেব?
ভগবানকে ধন্যবাদ যে সে বন্ধুত্বের অবসান হয়েছে। ভয়ঙ্কর লোক! লোকটা নাকি কি একটা নাটক লিখেছে এবং চেষ্টা করছিল নিরীহ শুভঙ্করকে দিয়ে আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে একটা থিয়েটার-পার্টি খুলতে।
শুনলাম ওরা দুজনে পরস্পর পরস্পরকে নাকি চিনতেন?
একটা মৃদু হাসি কুমারসাহেবের ওষ্ঠ্যপ্রান্তে জেগেই মিলিয়ে গেল, বুঝতে পেরেছি। মিঃ রায়, আপনি কি সন্দেহ করছেন—প্রফেসর শর্মাই ছদ্মবেশী আমার কাকা স্যার দিগেন্দ্র কিনা, না? কিন্তু আমি বলছি তা নয়, তবে সে একজন ভয়ঙ্কর শয়তান বটে। তারপর যেন একটু থেমে আবার আত্মগতভাবে বললেন, কিন্তু কাকার কথা আমি কিছুতেই ভুলতে পারছি না মিঃ রায়। মনে হচ্ছে। এ বাড়ির কোথাও না কোথাও তিনি এখনও মৃত্যু-তৃষ্ণায় ওৎ পেতে বসে আছেন। হ্যাঁ, he is somewhere here! Somewhere here!
কুমারসাহেব। আবার বলতে লাগলেন, এখন আর অবিশ্যি আমার বলতে বাধা নেই মিঃ রায়-কাল সন্ধ্যায় আমার সেক্রেটারী শুভঙ্কর আমাকে বলছিল শীঘ্রই নাকি সে কোথায় টাকা পাচ্ছে! আর সেই টাকা দিয়ে সে নাকি শীঘ্রই একটা থিয়েটার খুলছে, planও প্রায় তৈরী।