বাজার ছাড়িয়ে গঙ্গার ধারে প্রকাণ্ড চাকমিলান প্রাসাদতুল্য বাড়ি। লোহার গেটটা ভেজানেই ছিল। মৃদু একটা ঠেলা দিতেই খুলে গেল।
সামনেই অনেকখানি জায়গা জুড়ে একটা নানা জাতীয় দেশী বিদেশী মরসুমী ফুলের বাগান।
বাড়ির কোথাও একটা আলোর চিহ্ন পর্যন্ত নেই। অন্ধকারে নিঃশব্দে ভূতের মতই যেন বাড়িটা একটা বিভীষিকার মত স্তুপ বেঁধে আছে। ভয় করে। গায়ের মধ্যে ছমছম করে ওঠে।
দরজার কড়া নাড়তেই দরজাটা খুলে গেল! সামনেই আধাবয়েসী একটি ছোকরা দাঁড়িয়ে।
কিরীটিই জিজ্ঞাসা করল, কি রে, তোর নাম কি?
আজ্ঞে, মাধব, বাবু।
এ বাড়িতে কতদিন চাকরি করছিস?
মাত্র কয়েক সপ্তাহ হল বাবু আমাকে তঁর কাজে বাহাল করেছিলেন। আমি তার বেয়ারার কাজ করতাম।
বেশ, বাড়ির আর সব চাকরেরা কোথায় মাধব?
আজ্ঞে, অন্য চাকরবাকর তো কেউ আর নেই। কর্তা অনেকদিন আগেই তাদের ছাড়িয়ে দিয়েছেন।
কেন?
তিনি বলেছিলেন মাস-চার-পাঁচেকের জন্য তিনি কুমারসাহেবের সঙ্গে সিঙ্গাপুর যাবেন কী একটা কাজে।
ও, তাহলে তুই তীর খাস-চাকর ছিলি বল?
আজ্ঞে সাধ্যমত র্তার সুখ-সুবিধার দিকে নজর রাখতে কোনদিনই আমি কসুর করিনি কর্তা। আমারও আপাততঃ চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে যাবার কথা কিছুদিনের মত। তারপর তিনি বলেছিলেন, সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে এলে আবার আমাকে সংবাদ দেবেন।
কাল রাত্রে তুই তাহলে এখানেই ছিলি মাধব?
আজ্ঞে। এত বড় একটা বাড়িতে একা একা—শেষে রাত্রি একটার সময় ফোনে খবর পাই—আমাদের বাবু মারা গেছেন। বড় ভাল লোক ছিলেন কর্তা, কিন্তু বাবু আশ্চর্য, তারই ঠিক কিছুক্ষণ আগে যেন মনে হল শব্দ পেলাম সদর দরজায় চাবি দিয়ে যেন কে দরজা খুলছে …বাবু কখনো কখনো অনেক রাত্রে বাসায় ফিরতেন বলে আর একটা চাবি তীর কাছে থাকত। রাত্রে তিনি সেই চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতেন। আমি তাড়াতাড়ি নীচে গেলাম, কিন্তু কাউকেই দেখতে পেলাম না। ভাবলাম আমার শুনবারই ভুল হবে হয়তো।
ডাক্তার একবার মাথাটা দোলালেন কথাগুলো শুনে।
কটা চাবি তোর কর্তার সঙ্গে থাকত মাধব?
আজ্ঞে, তাঁর শোবার ঘরের, লাইব্রেরী ঘরের, বাইরের দরজার, অন্যান্য ঘরের ও সিন্দুকের কয়েকটা চাবি একটা রিংয়ে ভরা সর্বদাই কর্তার কাছে থাকত বাবু। কিন্তু একথা জিজ্ঞাসা করছেন কেন বাবু?
কাল দুপুরে যখন তিনি বাড়ি থেকে যান, তখনও তীর কাছে চাবির সেই রিংটা ছিল কিনা তুই জানিস মাধব?
আজ্ঞে জামা-কাপড় পরিবার পর আমিই র্তার অন্য একটা কোটের পকেট থেকে চাবির রিংটা এনে তার হাতে দিই।
কাল কত রাত্রে তোর মনে হয়েছিল তোর বাবু ফিরে এসেছেন? ডাক্তার প্রশ্ন করলেন।
রাত প্রায় দেড়টা হবে বাবু বোধ করি!
আচ্ছা তুই যে বলছিলি বাবুর সিন্দুক আছে, কোন ঘরে সেটা?
আজ্ঞে দোতলায় বাবুর শোবার ঘরে।
একবার দেখাতে পারিস সে ঘরটা?
চলুন না।
আমরা সকলে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে এলাম। লম্বা একটা টানা বারান্দা, তার উত্তর দিকে এক কোণে শুভঙ্করবাবুর শয়নঘর। কিন্তু ঘরের সামনে এসে আমরা সকলেই বিস্মিত হয়ে গেলাম! দরজার গা-তালায় তখনও একটা চাবি সমেত চাবির রিং ঝুলছে।
মাধব বললে, তাই তো বাবু, ঐ কর্তার চাবির রিং, কিন্তু এটা দরজার গা-তালায় ঝুলছে দেখছি! এখানে কী করে এল ওটা, আশ্চর্য! তবে কি.সত্যিই বাবু ফিরে এসেছিলেন রাত্রে?
তুই সকলে আর ওপরে আসিসনি মাধব, না? কিরীটী জিজ্ঞাসা করল।
আজ্ঞে না।
তোর অনুমান ভুল হয়নি মাধব! এখন বোঝা যাচ্ছে সত্যই কাল রাত্রে কেউ এ বাড়িতে এসেছিল।
কিরীটী চাবি ঘুরিয়ে ধাক্কা দিয়ে শয়নঘরের দরজাটা খুলে ফেললে এবং মৃদুস্বরে বলতে লাগল, সুব্রত, ডাক্তার, এখন বুঝতে পারছেন বোধ হয় কেন কাল রাত্রে মৃত শুভঙ্কর মিত্রের পকেট সার্চ করে আমার সন্দেহ হয়েছিল! একজন অবিবাহিত অল্পবয়স্ক যুবকের কাছে অন্তত তার প্রাইভেট চাবিটা থাকা দরকার, কিন্ত সেটা নেই। এখন বুঝতে পারছেন, সবার অলক্ষ্যে কেমন করে খুনী মৃতব্যক্তির পকেট থেকে চাবি চুরি করে সরে পড়েছিল এবং চাবি নিয়ে সে যখন বরাবর এখানেই এসেছে, নিশ্চয়ই কান উদ্দেশ্য নিয়েই এসেছিল। কিন্তু সেটা কী? সেটা কী?
মিঃ মিত্রের শয়নঘরটি বেশ প্রশস্ত। দামী মেহগনী কাঠের তৈরী একটি খাটে পাতা বিছানা চমৎকার একটি লাল রংয়ের বেডকভার দিয়ে ঢাকা। ঘরের মধ্যে আসবাবপত্রের তেমন বিশেষ কোন বাহুল্য নেই।
ঘরের দেওয়ালে বড় বড় সব অয়েল পেন্টিং টাঙানো। দরজার সামনেই শিকারীর সুট পরা মিঃ মিত্রের কয়েক বছর আগেকার তোলা বোধ হয় একটি ফটো। মিঃ মিত্র যেমন একজন পাকা শিকারী ছিলেন, তার শিকারের শখও ছিল তেমনি ভয়ানক প্রবল। কিরীটী কিছুক্ষণ ফটোটার কাছে দাঁড়িয়ে তীক্ষ দৃষ্টিতে ফটোটা দেখতে লাগল। তারপর একসময় আবার মাধবের দিকে ফিরে প্রশ্ন করলে, ওই ঘরের দরজার ওদিকে একটা ঘর আছে, না রে মাধব?
আজ্ঞে বাবু! ওই ঘরেই বাবুর লেখাপড়া করবার টেবিল ও সিন্দূকটা আছে। চলুন। আমরা সেই দরজা দিয়ে পাশের ঘরে গিয়ে প্রবেশ করলাম। অল্প-পরিসর একখানি ঘর। এক পাশে একটা মাঝারি সাইজের সেক্রেটারিয়েট টেবিল ও গোটা দুই গন্দিমোড়া চেয়ার। অন্যদিকে একটা প্রকাণ্ড বহুদিনের পুরনো লোহার সিন্দূক। চাবির রিংয়ের মধ্যেই সিন্দুকের চাবি ছিল। কিরীটী আলগোছে অতি সন্তৰ্পণে চাবি দিয়ে সিন্দুকটা খুলে ফেললে; কিন্তু আশ্চর্য, সিন্দুক একদম খালি, একটি কাগজের টুকরো পর্যন্ত নেই তার মধ্যে।