বলছি। কিন্তু সত্যি বলছেন মিঃ মিত্র মারা গেছেন?
হ্যাঁ হ্যাঁ, বললাম তো মারা গেছেন। মিথ্যে কথা আজ পর্যন্ত জীবনে একটাও বলিনি। মিথ্যাকে আমি আন্তরিক ঘূণা করি। এখন বলুন আপনার কথা।
আমিও জানি এবং টের পেয়েছি সে মারা গেছে। মৃদুস্বরে যুবকটি বললে।
কিন্তু তিনি যে মারা গেছেন, আপনি সেকথা জানলেন কি করে?
আমি যে অনুভব করছি সে মারা গেছে। হ্যাঁ, সমগ্র চেতনা দিয়ে অনুভব করছি সে মারা গেছে। আর তা না হলে–সি মারা না গেলে আমি পাগল হয়ে যাব। উঃ, কী ভালটাই তাকে একদিন আমি বেসেছি, নিজের ভাইয়ের মত অগাধ শ্রদ্ধা করেছি। যাক, সে মরেছে। অত বড় একজন ‘স্পোর্টসম্যান’ সে কিনা তার সব সম্মান প্রভুত্ব ছেড়ে দিয়ে শেষটায় কুমারসাহেবের মত একজন লোকের কাছে যেচে চাকরি নিল। কুমারসাহেব স্মাসকে দুচক্ষেও দেখতে পারেন না, অথচ তার কী একটা জরুরী কাজ নাকি আমার সঙ্গে আছে, তাই চুপে চুপে রাত্ৰি নটায় আমাকে এখানে আসতে বলেছিল। তাকে আমার বড় ভাল লাগত একদিন। অত চমৎকার আবৃত্তি করতে জীবনে আর কাউকে শুনিনি। বাংলা কবিতা কী চমৎকারই না আবৃত্তি করত, কিন্তু সেই সব আবৃত্তির মধ্যে সহসা যখন এক এক সময় এক একটা হিন্দি কবিতা থেকে আবার আবৃত্তি শুরু করত, শুধু তখনই আমার বিশ্ৰী লাগত। যাক সে কথা, আজ যখন সকালে আমাদের বাড়িতে সে এখানে আসবার জন্য আমাকে বলতে যায়, তার মুখের ওপরে যেন অদ্ভুত একটা পরিবর্তন দেখেছিলাম–যেন মনে হচ্ছিল তার মুখের দিকে চেয়ে, সে বুঝি পাগল হয়ে উঠেছে। তার কথামত ঠিক রাত্ৰি নটা বাজবার কিছু আগেই এখানে এসে আমি তার অপেক্ষায় বসে আছি। এমন। সময় যেন মনে হল, আমারই ঠিক নীচের ঘরে কিসের একটা গোলমাল—
তারপর? রুদ্ধশ্বাসে প্রশ্ন করলাম।
তারপর-তারপর আমার ঠিক মনে নেই। এক সময় আস্তে আস্তে এই ঘরের দরজাটা খুলে গেল। স্পষ্ট বুঝলাম, নিঃশব্দ পদসঞ্চারে কে যেন অন্ধকারেই এই ঘরে এসে ঢুকেছে৷ একটা অজানিত ভয়ে সমস্ত শরীর আমার রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল। পদশব্দেই বুঝেছিলাম, আমি যার অপেক্ষায় এখানে বসে আছি। এ সেই শুভঙ্করদা নয়। অথচ ঘন অন্ধকারে বন্য পশুর মত আগন্তুক তখন ধীরে ধীরে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি। বরাবর আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে অন্ধকারেই খপ করে সে আমার ডান হাতটা হাত বাড়িয়ে চেপে ধরল; তারপর চাপাস্বরে উত্তেজিত ভাবে বললে, বন্ধু বৃথা এত রাত্রে এখানে এখনও বসে আছ। তোমার শুভঙ্করদার সঙ্গে আজ আর দেখা হবে না, কেননা তোমার সঙ্গে দেখা করবার চাইতেও তার ঢ়ের বড় কাজ কালো ভ্ৰমরে’র সঙ্গে আছে। তারপরই যেমন সে এসেছিল তেমনিই চলে গেল।
কী, কী বললেন? তীব্র উৎকণ্ঠায় যেন আমার কণ্ঠস্বর ভেঙে পড়ল।
হ্যাঁ, বললে কালো ভ্রমরের সঙ্গে কাজ আছে। চেনেন নাকি?
কালো ভ্রমর! কালো ভ্রমর! এ কি ভয়ানক আশ্চর্য! নিজের হাতে যার মৃতদেহ নদীর জলে ভাসিয়ে দিয়ে এলাম, সত্যই কি সে তাহলে সেদিন মরেনি? আমার মনের মধ্যে যেন ঝড় বইতে শুরু করল। পাঁচ-ছয় বছর আগেকার কতকগুলো ঘটনা ছায়াছবির মতই মানসপটে বার বার ভেসে উঠে মিলিয়ে যেতে লাগল পর পর।
তারপরই সে চলে গেল? আবার প্রশ্ন করলাম যুবকটিকে।
হ্যাঁ, আর দ্বিতীয় কথাটি সে বলেনি। এদিকে সে চলে যাবার পর মনে হল, যে হাতটা সে আমার চেপে ধরেছিল, সেটা যেন কেমন ভিজে-ভিজে লাগছে। ব্যাপার কী দেখবার জন্য পকেট থেকে টর্চ বের করে জ্বালালাম। কিন্তু টর্চের আলোয় হাতের দিকে দৃষ্টি পড়তেই আতঙ্কে মুহূর্তে যেন সর্ব-শরীর আমার ঝিম ঝিম করে উঠল। তাজা লাল রক্তে আমার হাতের কবজী ও জামার আস্তিনটা রাঙা টুকটুকে হয়ে গেছে। উঃ, মাথার মধ্যে এখনো আমার কেমন করছে!
বলতে বলতে সহসা মার সামনে তার হাত দুটো প্রসারিত করে বললে, এই দেখুন, এখনও সেই রক্তমাখা হাতের স্পর্শটুকু আমার জামার আস্তিনে সুস্পষ্ট ভাবেই বর্তমান।
আমি টর্চের আলো ফেলে দেখলাম, যুবকের দুধ-গরদের পাঞ্জাবির আস্তিনে রক্তের দাগ দারুণ বিভীষিকায় এখনো সুস্পষ্ট।
আচ্ছা, আপনি সেই লোকটিকে চিনতে পেরেছিলেন?
না, তাকে আমি জীবনে আর কোন দিনও দেখিনি। তাছাড়া ঘর অন্ধকার ছিল।
গলার স্বর আপনার কি পরিচিত বলে মনে হয়েছিল সেই লোকটার?
না, অমনি অস্বাভাবিক স্বর আমি জীবনেও শুনিনি। চাপা অথচ গমগম করছে, মনে ঐচ্ছিল যেন বহুদূর থেকে সমুদ্রের ক্রুদ্ধ অস্পষ্ট গর্জনের মত।
কাউকে সন্দেহও করেন না?
না, না, না। আপনাকে তো আমি বলেছি, তাকে আমি চিনি না!
এতক্ষণে আমি আমার গলার স্বর কোমল থেকে কঠিন করলাম, দৃঢ়ভাবে বললাম শুনুন, আপনার কোন ভয় নেই। আপনি যা জানেন সব কিছু কথা গোপন না করে আমাকে খুলে বলুন। আপনাকে কথা দিচ্ছি, কেউ আপনাকে আঘাত করতে পারবে না। আপনার সমস্ত বিপদে আমরা বুক পেতে দাঁড়াব। আপনার কোন ভয় নেই।
দয়া করুন। অনুগ্রহ করে আমায় যেতে দিন। রাত্রি প্রায় শেষ হয়ে এল। এরপর মামার বাসায় গেলে যদি ঘূণাক্ষরেও তিনি জানতে পারেন যে আমি এতক্ষণ বাইরে ছিলাম, তবে জুতো মারতে মারতে আমাকে তঁর বাসা থেকে দূর করে দেবেন। চিরদিনের মত। আর তাছাড়া বর্তমানে কথা বলবার মত আমার দেহ ও মনের অবস্থা এতটুকুও নয়। এখন আমায় যেতে দিন। আমি প্রতিজ্ঞা করছি, আপনি যখনই ডাকবেন তখুনি আমি আপনার কাছে গিয়ে হাজির হব। আমার নাম অরুণ করা।. নং গ্রে স্ট্রীটে আমি থাকি। আমায় ছেড়ে দিন। আমি এখুনি পিছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে বাগান দিয়ে চলে যাব, কেউ দেখতে পাবে না, বাগানে আমার সাইকেল রয়েছে!