কুমারসাহেবের আত্মীয়স্বজন বলতে কেউ নেই। এ সংসারে। তিনতলার ঘরগুলো তাই খালিই পড়ে থাকে। মাঝে মাঝে কোন দূর-সম্পর্কীয় আত্মীয় এলে তেতলায় থাকেন। তা সেও ক্কচিৎ কখনো।
তিনতলার হলঘরে ঢোকবার মাথায়ই সিঁড়ি। সিঁড়ির দরজাটা ভেজানো! দরজার হাতল ঘুরিয়ে ঠেলতেই নিঃশব্দে দরজার কপাট দুটো ফাক হয়ে গিয়ে খানিকটা জমাট বাঁধা অন্ধকার চোখকে যেন অন্ধ করে দিল মুহুর্তের জন্য।
হাতের টর্চ জ্বালিয়ে চারদিকে একবার চেয়ে দেখলাম। এ হলঘরখানিও অবিকল নীচের হলঘরেরই অনুরূপ।
নিঃশব্দে একাকী সেই অন্ধকার নির্জন হলঘরের মধ্যে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। চারদিক হতে জমাট বাঁধা অন্ধকার যেন অদৃশ্য হাতে আমাকে এসে বেষ্টন করে এধরছে, অনুভব করছি। অন্ধকারের হিমশীতল স্পর্শ। আশ-পাশে কোথাও এতটুকু গোলমাল বা শব্দ পর্যন্ত নেই। যেন যুগযুগান্তরের তন্দ্রাচ্ছন্নতা এইখানে এসে জমাট বেঁধে আছে অতলান্ত অন্ধকারের মধ্যে।
নিজের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দটুকু পর্যন্ত শোনা যায়।
এরপর কতকটা আন্দাজে ভর করে, যে ঘরটা ঠিক প্রাইভেট রুমের ওপরে হবে বলে মনে হল, সেই ঘরের দরজাটার হাতল ঘুরিয়ে খুলে ফেললাম। নিঃশব্দে দরজা খুলে গেল।
ভরা শীতের আকাশের একটুকরো চোখে পড়ল। যেন একটুকরো স্বপ্ন। দূরদূরান্তের মায়ায় ঘেরা। নাগালের বাইরে।
সহসা একটা মৃদু নিশ্বাসের চাপা শব্দ আমার সজাগ কানে এসে যেন আঘাত দিল। দেহের সমগ্ৰ লোমকূপ পর্যন্ত যেন অভাবনীয় একটা পরিস্থিতির জন্য হঠাৎ সজাগ হয়ে উঠল।
হাতে ধরা টর্চন্টার বোতাম আবার টিপলাম। সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকারের বুকে সেই টর্চের আলোয় যে অভাবনীয় দৃশ্য সহসা আমার চোখে পড়ল তার জন্য ক্ষণপূর্বেও এতটুকু আমি প্রস্তুত ছিলাম না। সত্যিই চমকে উঠেছিলাম।
দেখলাম ঘরের এক কোণে একটা সোফায় মুখ নীচু করে নিঃশব্দে একটি অল্পবয়সী। যুবক বসে আছে।
আমার মত সেও বোধ হয় আমার অপ্রত্যাশিত আবির্ভাবে চমকে উঠেছিল সঙ্গে সঙ্গে।
কে? কে আপনি? কী চান এ ঘরে? বলতে বলতে ভীত ত্ৰস্তভাবে যুবকটি উঠে দাঁড়াল।
ক্ষমা করবেন, আমি আপনাকে বিরক্ত করতে এ ঘরে আসিনি। তা ছাড়া আমি ভাবতেও পারিনি এই নির্জন অন্ধকার ঘরে এমনি করে ভূতের মত চুপটি করে কেউ বসে থাকতে পারে। সত্যিই আমি একান্ত লজ্জিত। দুঃখিত মিঃ…। আমি কেবল এ ঘরের মেঝেটা একবার পরীক্ষা করে দেখবার জন্য শুধু এসেছিলাম। মানে…
কিন্তু কে আপনি? হঠাৎ এ ঘরের মেঝোঁটাই বা আপনি দেখতে এসেছেন কেন?
বর্তমানে আমি একজন পুলিসের সহকারী। আমি ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছিলাম।
পুলিস! পুলিসের সহকারী! কিন্তু এখানে কেন? সে কি মরে গেছে নাকি।
যুবকের অসংলগ্ন কথায় মুহূর্তে সমগ্র ইন্দ্ৰিয় আমার যেন সজাগ হয়ে উঠল। কোনমতে নিজেকে সংযত করে বললাম, কার কথা বলছেন? কে মরেছে?
কে আবার, কুমারসাহেবের সেক্রেটারী মিঃ শুভঙ্কর মিত্ৰ! একটু যেন দ্বিধাগ্রস্ত ভাবে কতকটা থেমে থেমে যুবক কথাগুলো বললে।
হ্যাঁ, মারা গেছেন তিনি সত্যি! কিন্ত। আপনি যখন এতটা জানেনই, আপনাকে কয়েকটি কথা জিজ্ঞাসা না করে সুস্থির হতে পারছি না যে!
আমি কথাটা বলতে বলতে আলোটা আবার নিভিয়ে দিলাম। ঘর পূর্বের মত অন্ধকারে জমাট বেঁধে উঠল। অন্ধকারে সোফার ওপর নড়েচড়ে বসবার খসখস আওয়াজ কানে এল.
কী জিজ্ঞাসা করবেন শুনি? কণ্ঠস্বরে পরিষ্কার অসহিষ্ণুতার আভাস যেন ঝরে পড়ল, কে আপনাদের খুন হয়েছে বা মারা গেছে সেই সম্পর্কেই আপনি আমাকে আবোলতাবোল কতকগুলো অবান্তর প্রশ্ন করবেন তো? কিন্তু কেন বলুন তো? আমাকে একা একা এই অন্ধকার ঘরে বসে থাকতে দেখে নিশ্চয়ই আপনার মনে ঐ জঘন্য ইচ্ছা জেগেছে, না?
রাগ করবেন না। যদিও আপনি রাগলেও, আমার কথার জবাব আপনাকে দিতেই হবে।
দিতেই হবে কথার জবাব? কেন শুনি? জোর নাকি?
আপনাকে তো আগেই আমি বলেছি, আমি একজন পুলিসের লোক। কাজেই…।
যুবক যেন কি ভাবলে, তারপর মৃদুকণ্ঠে বললে, বেশ, জবাব দেব। করুন, কি জিজ্ঞাসা করবার আছে আপনার! চটপট জিজ্ঞাসা করে ফেলুন। তারপর আবার একটু থেমে হঠাৎ বললে, আসুন না, চলুন। ঐ জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ানো যাক; বলতে বলতে যুবক উঠে দাঁড়ায়। একটা মৃদু অথচ মিষ্টি গন্ধ সহসা আমার ব্ৰাণেন্দ্রিয়কে যেন আলোড়িত করে তুলল। যুবক নিজেই এগিয়ে গিয়ে পথের ধারের জানলার কপাটটা খুলে দিল ধাক্কা দিয়ে।
মধ্যরাত্রির বর্ষণক্লান্ত শীতের আকাশ। অস্পষ্ট আলোছায়ার মধ্যে পাশ্বের দণ্ডায়মান যুবকের দিকে ফিরে তাকালাম। আধুনিক বেশভূষায় সজ্জিত! অত্যন্ত ফিটফট; বয়স বোধ করি বাইশ-তেইশের মধ্যে হবে।
যুবকটিই প্রথমে কথা বললে, অন্ধকার রাত্রে নির্জন ঘরে একা এক চুপ করে বসে থাকতে আমার বড় ভাল লাগে। কিন্তু আপনাকে তো ঠিক পুলিসের লোকের মত লাগছে। না! পুলিস আবার এরকম ভদ্র ও সভ্য দেখতে হয় নাকি? সত্যি চমৎকার চেহারা আপনার, যেন ঠিক গ্ৰীক দেবতা অ্যাপোলোর প্রতিমূর্তি। বাঙালীদের মধ্যে এত সুন্দর চেহারা বড় একটা আমি দেখিনি। সত্যি বলুন তো কে আপনি কি আপনার সত্য পরিচয়?
বলেছি তো আমি পুলিসের লোক। কিন্তু এখন আমার চেহারার বর্ণনা স্থগিত রেখে আপনার কথাগুলো বলবেন কি? আপনি এখানে কেন বসেছিলেন এমনি করে ভূতের মত একা একা? নিশ্চয়ই কারও জন্যে বসে অপেক্ষা করছিলেন, না?