না উত্তেজিত হবেন না ডাক্তার। ধীর গভীর আচঞ্চল স্বরে কিরীটী বললে, খুনী লুকোয়নি আদপেই। আমি যা দেখছি তাও যেমন মিথ্যা নয়, হরিচরণের কথাও মিথ্যা নয়; এবং ঐ ঘরে কোন গুপ্তদ্বার থাকাও একেবারেই সম্ভবপর নয়। আমার কথায় বিশ্বাস না হয় নিজে গিয়ে ভাল করে দেখে আসতে পারেন। আর একবার। ঘরের এক দিকে রাস্তা, আর একদিকে হলঘর, ওপরে তিনতলার ঘর, তার ওপরে খোলা ছাদ। এদিকে এই ড্রয়িং রুম, অন্যদিকে খাবার ও রান্নাঘর। তবে এর মধ্যে ভেবে দেখুন কোন গুপ্তপথ থাকা সম্ভব কিনা। এক কথায় ঘরের মধ্যে কোন গুপ্তপথ নেই। এবং সে জানলাপথেও পালায়নি, হলঘরের দরজা বা এই ড্রয়িংরুমের কোনটা দিয়েই বের হয়ে যায়নি। এবং এখনও ঘরের মধ্যে খুনী লুকিয়ে নেই। আসল কথা কি জানেন?
কিরীটীর মুখের দিকে সোৎসুকভাবে চেয়ে একই সঙ্গে আমরা দুজনেই উদ্গ্ৰীব কণ্ঠে প্রশ্ন করলাম, কী?
তবে শুনুন, আমরা যখন এখানে আসি তার ঢের আগেই খুনী তারকাজ শেষ করে গা-ঢাকা দিয়ে চলে গেছে। তাই আমরা কেউ তাকে দেখতে পাইনি ও-ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে। এবং দেহ ও মণ্ডর position টা দেখে এটাও বুঝতে পারা কঠিন নয় যে, ব্যাপারটা আন্দীে আত্মহত্যা নয়। সহজ ও প্রাঞ্জল খুন—a murder! …হ্যাঁ খুন!
পরে অবশ্য বুঝেছিলাম কিরীটীর কথাটা কতখানি সত্য! …এবং কত কঠিন সত্য!
কিন্তু এ কি নিদারুণ বিস্ময়! চোখের ওপর যেন ভাসতে থাকে একটা অশরীরী ছায়া, যে ছায়া এ বাড়ির প্রতিটি লোকের কাছে সুপরিচিত। যাকে তিলমাত্র কেউ সন্দেহ করে না। যে যেন একটা মুখোশ এটে এই হৃদয়হীন কাজটা করে গেল। দয়া নেই, মায়া নেই। নেই। এতটুকু বিবেক বিবেচনা। নির্মম খুন। পাশবিক লালসা। কে, কে? অথচ এই সমস্ত পরিচিতের মধ্যেই সেও একজন। কিরীটী বলেছে সকলেরই পরিচিত সে। তবে সে কে? আমি? কিরীটি? ডাঃ চট্টরাজ? কুমারসাহেব নিজে? ম্যানেজারবাবু? বিকাস মল্লিক? দিনতারণ চৌধুরী? না প্রফেসর শর্মা? কে? কে? কে?
এমন সময় হরিচরণ ঘরে এসে প্রবেশ করল। কয়েকটা খোলা কাগজ ও একটা বই তার হাতের মধ্যে ধরা আছে। হরিচরণ বললে, এই নিন স্যার, এখানে আজ যাঁরা উপস্থিত। আছেন তাদের সকলেরই জবানবন্দি এই কাগজে টুকে এনেছি, এমন কি চাকরিবািকরদেরও। আর এই নিন বই। বাবুজীকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কিন্তু সেও বলতে পারল না কে এই বইটা সেখানে ফেলে রেখে গেছে। কিন্তু একথা সে বললে হলফ করে যে বিকালে এই বই সে ঘরে দেখেনি। আমন্ত্রিত ভদ্রলোকদের এবারে আপনি ছেড়ে দিতে পারেন স্যার। আমার মনে হয় তাদের কাছ থেকে আর বিশেষ কোন খবর পাওয়া যাবে না।
হুঁ। আশ্চর্য! কিরিটী গম্ভীরভাবে বলতে লাগল, কিন্তু এই ছোট-একটা ‘রূপকথা’ কে এখানে নিয়ে এল? ভাল কথা হরিচরণ, এই বইটা যাঁরা এখানে নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছেন তাঁদের কারও কিনা জিজ্ঞাসা করে একবার দেখেছিল কী?
হ্যাঁ, তাও করেছিলাম স্যার। কেউই বললেন না যে, এটা তার বই বা বইটা কেউ সঙ্গে করে এখানে নিয়ে এসেছেন!
অন্যমনস্ক ভাবে কিরীটী বইয়ের পাতাগুলো ওল্টাতে লাগল। কলকাতার ৫নং কলেজ স্কোয়ারের, আশুতোষ লাইব্রেরী কর্তৃক ছাপা বইয়ের প্রথম পাতায় যেন কার নাম হিন্দীতে লেখা ছিল; কিন্তু তারপর রবার দিয়ে ঘষে ঘষে আবার সেটা যেন বেশ যত্ন সহকারেই মুছে ফেলা হয়েছে।
সহসা ডাক্তারের দিকে ঝুকে পরে কিরীটী বললে, ডাক্তার, আপনি তো হিন্দী জানেন? দেখুন তো কি নাম লেখা ছিল বইটাতে? ইতিমধ্যে হরিচরণের জবানবন্দি নেওয়া কাগজগুলো একটু আমি উল্টেপাল্টে দেখে নিই।
কিরীটী হরিচরণের হাত থেকে কাগজগুলো নিয়ে মনোযোগের সঙ্গে পড়তে লাগল এবং মাঝে মাঝে নোট-বুকটা বের করে কী সব তাতে নোট করে নিতে লাগল। ডাক্তারের দিকে চেয়ে দেখলাম, ডাক্তার গভীর হয়ে চশমার ভিতর দিয়ে বইয়ের প্রথম পাতায় মুছে দেওয়া অস্পষ্ট নামের লেখাটাকে উদ্ধার করবার বৃথা চেষ্টা করছেন। ক্রমে যেন মনে হচ্ছিল একটা বিস্ময়ের ভাব তার চোখে-মুখে ফুটে উঠছে একটু একটু করে। তারপর সেই পাতাটা উল্টে কী যেন মনোযোগের সঙ্গে পাতার দিকে দেখতে লাগলেন।
কিরীটীর কাগজটা দেখা হয়ে গিয়েছিল, হরিচরণের দিকে চেয়ে বললে, হরিচরণ, আজি এখানে যাঁরা উপস্থিত আছেন, তাদের প্রত্যেকের ওপরেই একজন করে লোক যেন আমার দ্বিতীয় আদেশ না পাওয়া পর্যন্ত নজর রাখে। আর এখুনি একজন লোকের বন্দোবস্ত কর, টালার শুভঙ্কর মিত্রের বাড়িতে পাহারা দেবার জন্য। চব্বিশ ঘণ্টা পাহারা থাকবে। কোনক্রমেই কোন লোককে সে বাড়িতে যেন ঢুকত বা বাড়ি থেকে বের হতে দেওয়া না হয়। কেউ যদি ঢুকতে চায় বা বের হতে চায় বাধা দেবে। বাধা না শুনলে গ্রেপ্তার করবে।
হরিচরণ মাথা হেলিয়ে বলল, তাই হবে স্যার।
এইবার কিরীটী তার এতক্ষণ লেখা নোটটা আমাদের চোখের সামনে মেলে ধরলা, তাতে এইরূপ লেখা আছে ঃ
৮-১০ মিঃ রাত্ৰি—মিঃ শুভঙ্কর মিত্র, কুমারসাহেব, প্রফেসার কালিদাস শৰ্মা, দীনতারণ চৌধুরী—এঁরা সকলে কুমারসাহেবের সয়নঘরে কী একটা পরামর্শ করছিলেন। বয় কফি দিয়ে আসতে গিয়ে দেখেছিল। ওঁদের সকলকেই ও ঘরে।
৮-২০ মি- রাত্ৰি-দীনতারণ চৌধুরী এখান থেকে চলে যান; ম্যানাজারবাবু ও দারোয়ান তাকে দেখেছে।
৮-২৫ মিঃ—৮-৫৫ মিঃ—মিঃ শুভঙ্কর মিত্র ও প্রফেসার কালিদাস শৰ্মা দুজনে খাবার ঘরে বসে গোপনে কী সব কথাবার্তা বলছিলেন, বাবুর্চি তাদের দেখেছিল। কারণ সে সময় বেয়ারা না থাকায় বাবুর্চিই নিজে তাদের গরম কফি দিতে গিয়েছিল!