ইতি—
তোমার একান্ত শুভার্থী
কাকা দিগেন্দ্রনারায়ণ
তারপর এই হচ্ছে সেক্রেটারীবাবুকে যে চিঠি লেখা হয়। সেখানা, পড়ি শুনন ঃ পরের অর্থে পোদ্দারী করতে খুব আনন্দ, না? অন্যের বুকের রক্ত ঢেলে উপার্জন করা অর্থে হাসপাতাল গড়ে তুলতে চলেছ! Idea টা চমৎকার বন্ধু! বোকা ভাইপোটির মাথায় হাত বোলাবার চমৎকার উপায় একটি বের করেছ তো! প্রস্তুত থেকে, কাল তোমারও তামাম শোধের দিন ধার্য করেছি। —রক্তলোভী ‘দিগেন্দ্রনারায়ণ।
চিঠি দুখানা পড়া শেষ করে, আবার সে দুটো ভাঁজ করে পকেটে রাখতে রাখতে কিরীটী বলে, এখন বোধ হয় সুব্রত বুঝতে পারছি, এখানে আসবার সময় কেন লোকজন সঙ্গে নিয়ে প্রস্তুত হয়ে এসেছিলাম! এই চিঠি দুখানা আজ দুপুরেই কুমারসাহেব আমাকে পৌঁছে দিয়ে এসেছিলেন।
বটে! এই ব্যাপার! ডাক্তার বলতে লাগলেন, ব্যাপারটা তো তাহলে এই দাঁড়াচ্ছে যে মিঃ শুভঙ্কর মিত্রের একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল রাত্রি সাড়ে নটায়। তারপর তিনি কফি চেয়ে পাঠান, এবং ঠিক রাত্রি সাড়ে নটায় তিনি কুমারসাহেবের প্রাইভেট রুমে পূর্ববর্ণিত অ্যাপয়েন্টমেন্ট রক্ষা করতে গিয়ে উপস্থিত হন। কেমন তো?
হ্যাঁ, এবং তারই অল্পক্ষণ পরে ঘণ্টা বেজে ওঠে, সে কথাটা ভুলবেন না যেন। কিরীটী বলে ওঠে ওঁর কথার মধ্যে বাধা দিয়ে।
না, ঘণ্টা বেজেছিল তা ভুলিনি। খুনী ঘণ্টা বাজবার আগে থেকেই সে ঘরে উপস্থিত ছিল এবং তলোয়ারটা খুন করবার জন্য তৈরী করেই বড় সোফাটার নীচ লুকিয়ে রেখেছিল। Everything was kept ready – পূর্বপরিকল্পিত।
হ্যাঁ, কিন্তু এখন বলুন তো ডাক্তার, কোন দরজা দিয়ে খুনী তাহলে ঘরে গিয়ে ঢুকল?
কেন, দুটা দরজার যে কোনটা দিয়েই তো ঢুকতে পারে… ভুলে যাচ্ছ কেন এ কথাটা যে আমি বলেছি যে, খুনী ঢের আগে থেকেই সে ঘরে উপস্থিত ছিল।
বেশ। কিন্তু এবার বলুন তো ডাক্তার, তাহলে ঘরের কোন দরজা দিয়ে খুনী খুন করে বেরিয়ে গেল? কারণ যখন দেখতে পাচ্ছি। খুনের ঠিক পরই আমরা কেউ তাকে সে ঘরে গিয়ে খুঁজে পেলাম না!
কিরীটীর প্রশ্নে সহসা ডাক্তার চুপ করে গেলেন। মনে হল যেন তিনি অত্যন্ত বিব্রত হয়ে পড়েছেন। তাঁর এই বিব্রত ভাব দেখে আমি বললাম, ডাঃ চট্টরাজ, আমি এই কথাটাই আপনাকে তখন বলতে চাইছিলাম কিন্তু।
দাঁড়ান! দাঁড়ান! ডাক্তার অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলে উঠলেন, খুনী হলঘরের সঙ্গে ওই ঘরে যাতায়াত করবার জন্য যে দরজা আছে, সে দরজা দিয়ে বের হয়নি; কারণ যেখানে আপনার নিযুক্ত লোক প্রহরায় ছিল এবং সেখানে থেকেই সে সর্বদা হলঘরের নজর রেখেছিল, কেমন এই তো আপনার যুক্তি?
খুনী এই ঘর অর্থাৎ এই ড্রয়িংরুমের দরজা দিয়েও বাইরে যায়নি। কারণ যেহেতু এ দরজার ওপর আমি নজর রেখেছিলাম, ঠিক যে মুহুর্তে আমি শুভঙ্কর মিত্রকে ঘরে ঢুকতে দেখি তারপর থেকেই সর্বক্ষণ, কেমন তো? আচ্ছা, তাহলে ডাক্তার এমন কি হতে পারে না যে, এই ব্যাপারটার মধ্যেই অর্থাৎ দরজার ওপর আমাদের নজর থাকা সত্ত্বেও একটা রীতিমত গোলমাল বা রহস্য লুকিয়ে আছে যা আপাতত আমাদের কারও দৃষ্টিতে আসছে না! কিন্তু আমি সত্যই আশ্চর্য হচ্ছি—এমন সহজ গোলমালটা আপনাদের বা সুব্রতর চোখে পড়ছে না কেন? কেন আপনার ধরতে বা বুঝতে এত কষ্ট হচ্ছে?
আমরা কিরীটী কথায় কোন জবাবই দিলাম না।
হাসতে হাসতে কিরীটী বলতে লাগল, তবে শুনুন। আপনারা জানেন ঐ ঘরে যাতায়াত করবার দু-ঘর দিয়ে দুটি দরজা আছে। একটি হলঘর দিয়ে, অন্যটি এই ঘর অর্থাৎ এই ড্রয়িং রুম দিয়ে, কেমন তো? এখন একটা দরজায় পাহার দিচ্ছিল হরিচরণ, অন্যটায় আমি নিজে। নিজেকে আমি যতটা বিশ্বাস করি, আমার সহকারী হরিচরণকে বা তার কথাও ঠিক ততখানিই আমি বিশ্বাস করি। ঐ দুটো দরজার কোনটি দিয়েই কেউ বের হয়ে গেলে, আমার বা হরিচরণের চোখকে ফাঁকি দেবার তার সাধ্য ছিল না। তাছাড়া ঐ প্রাইভেট ঘরের একটিমাত্র জানলাও আমি পরীক্ষা করে দেখেছি খুব ভাল করেই। নীচেই তার ট্রাম রাস্তা, এখনও হয়েতো সে পথে লোকজন যাতায়াত করছে, তখন তো করছিলেই। জানালার নীচে যে ধূলার পরত। জমে আছে, তাও আমি পরীক্ষা করে দেখেছি। কোন সামান্য এতটুকু দাগ বা চিহ্ন পর্যন্ত সেখানে দেখতে পাইনি। আর বিশেষ করে জানালা থেকে ঘরের ব্যবধান প্রায় চল্লিশ ফিট হবে বলে মনে হয়। মানুষ তো দূরের কথা কোন বানরের পক্ষেও এই পথ দিয়ে যাতায়াত করা একেবারেই দুঃসাধ্য। অসম্ভব বললেও অত্যুক্তি হয় না। এবং ঘরেও কেউ লুকিয়ে ছিল না, সে তো আমারা নিজ চক্ষেই পরীক্ষা করে দেখেছি। অথচ সব চাইতে মজার ব্যাপার হচ্ছে খুনী অন্যের অলক্ষ্যে ঘরে প্রবেশ করে, তারপর খুন করে আবার অন্যের অলক্ষ্যেই বেমালুম গা-ঢাক দিয়ে ঘর থেকে চলে গেল; ঠিক যেমন আজ সন্ধ্যায় কুমারসাহেবকে আবছা ছায়ার মত ভয় দেখিয়েই স্যার দিগেন্দ্ৰ হাওয়ার সঙ্গে মিলিয়ে গেলেন—অনেকটা সেই রকম। এর পরেও কি ডাক্তার আপনি বলবেন বা আপনার স্থিরবিশ্বাস যে এই ব্যাপারটাও একটা কল্পনাপ্রসূত ছায়াছবি মাত্র, অর্থাৎ আপনাদের ডাক্তারী ভাষায় haliucination!
উঃ অসহ্য, ক্ষোভে দুঃখে ডাক্তার বলে উঠলেন, অসহ্য! কিন্তু আমিও নিশ্চয় করে বলছি। রায়, খুনী নিশ্চয়ই ঘরের মধ্যে লুকিয়েছিল। এবং আপনার অগাধ বিশ্বাসের পাত্র হরিচরণ হয় আসল ব্যাপার দেখতে পায়নি বা মিথ্যা বলছে, আর তা যদি না হয় বা আপনি তা মেনে নিতে না চান, তবে I must say, ঐ ঘরে নিশ্চয়ই কোন গুপ্তদ্বার আছে যে পথ দিয়ে সে ঘরের মধ্যে ঢুকে খুন করে চলে গেছে।