আজ্ঞে!
বলুন! কঠিন আদেশের সুর কিরাটীর কণ্ঠে ঝঙ্কত হয়ে উঠল। কিছুক্ষণ ম্যানেজারবাবু মাথা নীচু করে কি যেন ভাবলেন, তারপর একসময় মৃদুস্বরে বললেন, আজ্ঞে মাসখানেক হবে, তিনি আফিং একটু একটু করে গরম কফির সঙ্গে খেতেন। বলতেন, অন্য কোন বদ নেসার থেকে আফিং খাওয়াটা নাকি ভাল। তাছাড়া তার পেটের গোলমাল আছে বলে ডাক্তার নাকি পরামর্শ দিয়েছিল প্রত্যহ একটু একটু করে আফিং খেতে। আফিং ধরবার পর উপকারও নাকি পাচ্ছিলেন।
ভাল কথা! খুব ভাল কথা! কিন্তু আপনাদের কুমারসাহেবও কি ঐ সঙ্গে কোন নেশায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন নাকি?
আজ্ঞে, তিনি বোধ হয় ঐ একই সময় থেকে আফিং খাওয়ার সঙ্গে অভ্যস্ত হয়েছেন, কিন্তু আমার মনে হয় কুমারসাহেব আফিংয়ে অনেক দিন থেকে অভ্যস্ত।
বেশ। আচ্ছা আজ রাত্রে কুমারসাহেবকে আপনারা ভাং বা সিদ্ধি জাতীয় কোন জিনিস দিয়ে সিগারেট তৈরী করে দিয়েছিলেন?
আজ্ঞে–
বলুন, জবাব দিন!
আজ্ঞে হ্যাঁ। কেননা আমি ভেবেছিলাম সিদ্ধি খেলে তিনি একটু চাঙ্গা হয়ে উঠবেন। জানি না কেন যেন আজ চার-পাঁচদিন একটা চিঠি পেয়ে অবধি তিনি অত্যন্ত অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। সর্বদাই মনমরা, যেন কি কেবলই ভাবছেন তাই ভাবলাম, আজকের এই উৎসবের দিন, সাধারণ সিদ্ধির সরবত-টরবত দিলে হয়তো তিনি আপত্তি করতে পারেন, তাই সিগারেট তৈরী করে রেখেছিলাম। এ রকম মাঝে আরো দুবার সিগারেট করে খাইয়েছিও তাকে। সন্ধ্যার অল্প পরেই আমি তখন কুমারসাহেবের লাইব্রেরী ঘর বসে কয়েকটা হিসাবপত্র মিলিয়ে নিচ্ছি, কুমারসাহেব যেন খুব উত্তেজিত হয়েছেন এমন অবস্থায় এসে লাইব্রেরী ঘরে ঢুকলেন, বললেন, এক কাপ গরম কফি খাওয়াতে পারেন ম্যানেজারবাবু? আর আপনার সেই সিগরট কয়েকটা দিতে পারেন? তারপর তিনি আমাকে একটু আগে বাথরুমে কী দেখেছেন তাই বলতে লাগলেন। আমি নিজে তাকে কফি নিয়ে এসে দিলাম ও পকেট থেকে তৈরী করা গোটাপাঁচেক সিগারেটও দিলাম।
আজকেই আপনি তাহলে প্রথম তাকে ঐ ধরনের সিগারেট দিয়েছিলেন বোধ হয়?
আজ্ঞে না। দিন পাঁচেক আগে একবার গোটাপাঁচেক তৈরী করে দিয়েছিলাম।
তবেই দেখুন ডাক্তার, ভাং বা সিদ্ধির প্রভাবে কুমারসাহেব কল্পনার বিভীষিকা দেখেননি, সিগারেট পান করবার আগেই দেখেছেন। তারপর ম্যানেজারের দিকে ফিরে তাকিয়ে বললে, বেশ। আচ্ছা ম্যানেজারবাবু কুমারসাহেবের সঙ্গে যখন আপনার দেখা হয় তখন ঠিক কত রাত্রি হবে বলতে পারেন? মানে রাত্রি তখন কটা বাজে?
আজ্ঞে রাত্ৰি নটা হবে।
আচ্ছা, তারপর আপনি কী করলেন?
তারপর আরও কিছুক্ষণ আমি ঐখানেই ছিলাম, কেননা কুমারসাহেব সিগারেট নিয়েই ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন দ্রুতপদে। তারপর হিসাবপত্র দেখা হয়ে গেলে প্রায় রাত্ৰি সাড়ে নটার সময় আমি নীচে নেমে যাই।
এর পর ম্যানেজারবাবুকে কিরীটী বিদায় দিল।
ভদ্রলোকও যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন, কেননা তিনি একপ্রকার দৌড়েই ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন।
ম্যানেজার ঘর থেকে চলে যাবার পর সকলেই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। কিরীটীও বোধ করি কি ভাবছিল।
০৭. ঘরের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে
ঘরের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে সর্বপ্রথম কিরীটীর দিকে চেয়ে এবারে আমিই প্রশ্ন করলাম, আজকের ব্যাপারের অনেক কিছুই যেন তুমি এখনো চেপে রাখছ বলে মন হচ্ছে কিরীটী? একটা সূত্র অবিশ্যি পাওয়া যাচ্ছে, মিঃ শুভঙ্কর মিত্র নেশা করতেন!
কিরীটী মৃদু হেসে বলে সেটা এমন বিশেষ একটা সূত্র নয়। কিন্তু এই case সম্পর্কে আপাতত যতটা জানতে পেরেছ, তাতে করে তোমার মতামতটা কী সুব্রত? যতটুকু জেনেছ বা শুনেছ। এর মধ্যে কোন অসামঞ্জস্য বা অবিশ্বাস্য মনে হয় কী?
একটা অসামঞ্জস্য খুব মোটা ভাবেই চোখে পড়েছে।
ডাঃ চট্টরাজ বাধা দিলেন, এক মিনিট সুব্রতবাবু! বলে হঠাৎ কিরীটীর দিকে চেয়ে বললেন, হ্যাঁ, একটা কথা রায়, তোমার ধারণা বোধ হয়। স্যার দিগেন্দ্ৰই কারও ছদ্মবেশে আজ রাত্রের উৎসবে যোগ দিয়েছিলেন?
যদি বলি ডাঃ চট্টরাজ তাই! এমন কোন বিশেষ ব্যক্তির ছদ্মবেশ নিয়ে তিনি এখানে আজ হয়েতো এসেছেন, যার সঙ্গে মিঃ মিত্রের বেশ ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল। তা ছাড়া কোন নিমন্ত্রণ-বাড়ির একটা কার্ড যোগাড় করে এখানে আসাটা এমন বিশেষ কিছুই একটা কঠিন ব্যাপার বলে কি মন হয় ডাঃ চট্টরাজ?
না। কিন্তু তাহলে তুমি স্থিরনিশ্চিত যে, স্যার দিগেন্দ্ৰই কারও ছদ্মবেশে এসে আজ রাত্রে হতভাগ্য শুভঙ্কর মিত্রকে খুন করেছেন? কিন্তু—
মৃদু হেসে সহজ স্বাভাবিক স্বরে কিরীটী জবাব দিল, নিশ্চয়ই। এতে আমার দ্বিমত নেই।
কিন্তু বন্ধু, এক্ষেত্রে মিঃ মিত্রের মত একজন তৃতীয় ব্যক্তিকে স্যার দিগেন্দ্রের খুন করবার কী এমন সার্থকতা থাকতে পারে সেটাই যেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। অবিশ্যি কুমারসাহেবকে হত্যা করলেও না হয় বোঝা যেত; কেননা তাঁর মুখে শুনেছি স্যার দিগেন্দ্র প্রায় তিন-চারখানা চিঠিতে একাধিকবার কুমারসাহেবকে শাসিয়েছেন তার প্রাণ নেবেন বলে। এবং যে কারণেই হোক কুমারসাহেবের ওপরে তাঁর একটা আক্রোশও আছে।
কিরীটী এবার বলে, জানেন কিনা আপনারা জানি না—গতকাল রাত্রে কুমারসাহেব শেষ চিঠি পেয়েছেন স্যার দিগেন্দ্রর কাছ থেকে এবং সেই সঙ্গে আমাদের সেক্রেটারী সাহেবও একখান চিঠি পেয়েছিলেন। চিঠিতে লেখা ছিল, বলতে বলতে একখানা চিঠি পকেট থেকে টেনে বের করে কিরীটী চিঠিটা পড়তে শুরু করে ঃ আমাদের সাত পুরুষের সঞ্চিত অৰ্থ নিয়ে তুমি যে এই দানধ্যানের ছেলেখেলায় মেতে উঠেছ, এর সকল ঋণ কালই তোমার আপন বুকের রক্ত দিয়ে কড়ায়গণ্ডায় পরিশোধ করত হবে। বুকের রক্ত ঢেলে অর্জিত এ অর্থ অপব্যবহার করে যে পাপ করেছ, তা বুকের রক্তেই শেষ হয়ে যাক। আঃ, তাজা টুকটুকে লাল রক্ত ফিনকি দিয়ে ঠাণ্ডা মাটির বুকের ওপর ঢেউ খেলে যাচ্ছে! কী আনন্দ! লাল—লাল রক্ত I love it! I like it.