তাছাড়া দেখুন, মসলাটা কেমন ফিকে ব্রাউন রংয়ের ‘মরিহুয়ানা’ (‘morihuanna) কিংবা ‘হ্যাসহিস’ (‘hashish’) ভাং সিদ্দি বা গাঁজা জাতীয় জিনিস। তবে আসলে কোন জিনিসটা দিয়ে যে এই সিগারেটের মসলা তৈরী হয়েছে তা রাসায়নিক পরীক্ষাগার থেকে পরীক্ষিত না হয়ে আসা পর্যন্ত সঠিক বলা চলছে না। তোমরা হয়তো জান না, ইজিপ্টের লোকেরা হ্যাসহিসের সবুজ বা কাঁচা পাতা খায়। তাতে নাকি নেশা হয়। মেক্সিকোতে যে হ্যাসহিস পাওয়া যায়, তার পাতা আরো তীব্র নেশা আনে। খুব সম্ভব প্রফেসর শর্মা এই ধরনের সিগারেট তৈরী করে কুমারসাহেবকে নেশায় পরিতুষ্ট করে থাকেন। প্রফেসর শর্মা উদ্ভিদ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন বলে ওঁর সিগারেটের ওপরে সর্বপ্রথম আমার সন্দেহ জাগে, যে মুহুর্তে উনি আমার দেওয়া সিগারেটের অফার ফিরিয়ে দিলেন, অথচ ঠিক সেই সময়ই নিজের কেস হতে সিগারেট বের করে ধূমপান শুরু করলেন। কোন সভায় বা দুদশজন যেখানে মিলিত হয়েছে, সেখানে কেউ সিগারেট কাউকে অফার করলে তাকে refuse করে পরমুহুর্তেই নিজের সিগারেট ব্যবহার করা এটিকেট-বিরুদ্ধ। একমাত্র সেই কারণেই আমি কুমারসাহেবের নিঃশেষিত ফ্যাগ end টা অ্যাসট্রে হতে তুলে নিয়েছিলাম। তারপর একটু থেমে আবার বললে, হ্যাঁ ভাল কথা ডাক্তার, আপনাদের ডাক্তারী শাস্ত্ৰে ভাং সিদ্ধি প্রভৃতির নেশা করলে কি কি লক্ষণ দেখা যায় বলে?
চোখের মণিতে অবস্থিত আলো প্রবেশের ছিদ্রপথ pupil সঙ্কুচিত (contracted) হয়ে যায়। জোরে জোরে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে শুরু করে, সামান্য একটু চলাফেরা করলেই exhaustion হয়ে গা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। কল্পনায় সব নানা রকম অদ্ভুত অদ্ভুত দৃশ্য চোখের ওপর ভাসতে থাকে; যাকে আমরা ডাক্তারী শাস্ত্ৰে hallucination বলি! এখন বোধ হয় বুঝতে পারছ রায়, কুমারসাহেব যে অদ্ভূত গল্প আমাদের শোনাচ্ছিলেন তা ঐ নেশারই প্রভাবে।
অদ্ভুত আর তাকে বলা চলে না ডাক্তার, আজকের রাতের ঘটনার কথা ভাবতে গেলে কিছুই আর আশ্চর্য বা অদ্ভুত লাগে না। আমি এখনও স্থিরনিশ্চিত নই কুমারসাহেবের গল্পটা নেশা থেকেই উদ্ভূত না কল্পনা মাত্র। আপনি যে জিনিসটার প্রভাবের কথা বলছেন সেটাও ঐ গাঁজা বা ভাং জাতীয় গাছের পাতা থেকে হয়, এবং ঐ ধরনের নেশার বস্তু একটা সিগারেটের মধ্যে যতটুকু থাকে তাতে করে আমন নেশা হতে পারে বলে আমার কিন্তু মনে হয় না। সামান্য একটু উত্তেজকের কাজ করতে পারে মাত্র। আমার মনে হয় এ ধরনের নেশায় কুমার সাহেব অনেকদিন থেকেই বেশ অভ্যস্ত। না হলে তিনি এ ধরনের নেশা করে নিশ্চয়ই অসুস্থ হয়ে পড়তেন এবং সেটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া এই জাতীয় নেশায় অভ্যস্ত যেসব নেশাখের, তাদের এই সামান্য একটু নেশার দ্রব্য সেবন করলে আর যাই হোক অন্ততঃ কল্পনায় স্বপ্ন যে দেখতে শুরু করবে না এটাও ঠিক। অর্থাৎ আমি বলতে চাই, আপনাদের ডাক্তারী শাস্ত্রে ঐ hallucination দেখা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়তো না হওয়াটাই বেশী সম্ভব। আরো একটা কথা এই সঙ্গে আমাদের ভুললে চলবে না যে, এ জাতীয় জিনিসের লোককে মেরে ফেলবারও একটা ক্ষমতা আছে, তবে একটু দীর্ঘ সময় লাগে। যেমন ধরুন দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে নিয়মিত ভাবে ঐ ধরনের নেশা করে আসলে, অনবরত এগুলো slow poisoning-য়ের কাজ করতে পারে অনায়াসেই। এমনও হতে পারে যে, ঐভাবে নেশার মধ্য দিয়ে slow poisoning করে কেউ ঐ উপায়ে অনেক দিন ধরেই ওঁকে সবার অলক্ষ্যে এ জগৎ থেকে নিঃশব্দে সরিয়ে ফেলবার চেষ্টা করছিল।
এমন সময় ম্যানেজারবাবু এসে ঘরে ঢুকলেন। —এমন করে আর কুমারসােহবের সর্বনাশ করবেন না। স্যার, আপনার লোকেদের আদেশ দিন যাতে করে তঁরা এবার এখানে উপস্থিত সম্মানিত অতিথি-অভ্যাগতদের অন্ততঃ চলে যেতে বাধা না দেন। একেই তো তীরা সব নানা অদ্ভুত প্রশ্ন করে করে আমাদের প্রায় পাগল কর তোেলবার যোগাড় করেছেন। এমন কি এর মধ্যে কেমন করে না জানি প্রকাশও হয়ে গেছে যে কুমারসাহেবের সেক্রেটারীকে কে হত্যা করেছে। আমি যদিও তঁদের বুঝিয়ে বলেছি, তিনি আত্মহত্যা করেছেন, কেউ তাঁকে হত্যা বা খুন করেনি, কিন্তু এ ধরণের কথা একবার রটলে কি কেউ আর কারও কথা বিশ্বাস করে বা করতে চায়?
কিরীটী হাসতে হাসতে বললে বসুন। আপনার মনিবের সেক্রেটারী আত্মহত্যা করেছেন শুনলে নিশ্চয়ই আপনার প্রভুর আত্মমর্যাদা বেড়ে যাবে, কি বলেন ম্যানেজারবাবু? কিন্তু সে কথা থাক, ব্যস্ত হবেন না, এখন বলুন তো দেখি, আজ রাত্রে এই উৎসবে এমন কি কেউ এখানে এসেছেন যাঁকে আপনি চেনেন না বা ইতিপূর্বে কোন দিন দেখেননি?
না, কই এমন কাউকে দেখছি বলে তো আমার আজ মনে পড়ছে না! ম্যানেজারবাবু বলে উঠলেন, তাছাড়া এ উৎসবে আমন্ত্রিতদের প্রত্যেকেই নিমন্ত্রণ-লিপি দেওয়া হয়েছিল এবং নিমন্ত্রণ-লিপি ছাড়া আর কাউকেই প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। সেক্রেটারীবাবুর এ বিষয়ে কড়া নজর ছিল।
সহসা আবার কিরীটী প্রশ্ন করল, আচ্ছা ম্যানাজারবাবু, বলতে পারেন, আপনাদের কুমারসাহেবের সেক্রেটারী মিঃ মিত্র কতদিন থেকে আফিং খাওয়াটা অভ্যাস করেছিলেন? দেখুন অস্বীকার করবেন না বা অস্বীকার করবার চেষ্টা করবেন না। আপনি নিশ্চয়ই তীর অনেক কথাই জানেন, কেননা বেশীর ভাগ সময়ই দুজনে আপনারা সহকমী হিসাবে এখানে কাজ করছিলেন। বলুন না মশাই, চুপ করে আছেন কেন? খেতেন নাকি তিনি?