ঐ সময় তুমি নিশ্চয়ই হলঘর থেকে প্রাইভেট রুমে যাবার দরজাটার প্রতি বেশ ভাল নজর রেখেছিলে হরিচরণ, কী বল?
খুব কঠিন দৃষ্টিতে নজর না রাখলেও, মোটামুটি ভাল করেই নজর রেখেছিলাম স্যার। এবং বেয়ারা যখন ঘরে ঢেকে আমি তখনও তার পিছনেই দাঁড়িয়ে এবং আমি ওর সঙ্গে সঙ্গেই ঘরের মধ্যে ঢুকে মৃতদেহ দেখতে পাই। আপনি না। আসা পর্যন্ত আমি একবারের জন্যও ওখান থেকে নড়িনি।
হঠাৎ প্রফেসর শর্মা বললেন, আচ্ছা, এবারে আমি আসতে পারি কী মিঃ রায়? রাত্রি অনেক হল। এই আমার নামের কার্ড রইল, যখন ইচ্ছা ফোনে একটু খবর দিলেই আমার দেখা পাবেন। বলতে বলতে একটা সুদৃশ্য কার্ড কিরীটীর হাতের দিকে প্রফেসর এগিয়ে ধরলেন। কিন্তু কিরীটী তাঁর কথায় কোন জবাবই দিল না, চুপচাপ বসেই রইল, যেন কথাগুলো কানেই যায়নি। তারপর নীরবে হাত বাড়িয়ে প্রফেসার হাত থেকে কার্ডটা নিয়ে ভু কুঁচকে কী যেন ক্ষণেক ভােবল, তারপর মৃদু অথচ দৃঢ়কণ্ঠে বললে, প্রফেসর শর্মা, আশা করি ও-ঘরের তলোয়ারটার কথা এর মধ্যেই একেবারে ভূলে, যাননি!
সহসা প্রফেসারের চোখের দৃষ্টিটা তীক্ষ ও উগ্র হয়ে উঠল। তিনি পলকহীন ভাবে কিরীটীর দিকে চাইলেন, কিরীটীও তার নিভীক দৃষ্টিতে প্রফেসারের দিকে চেয়ে রইল।
চারজোড়া তীক্ষ্ম চোখ পরস্পর পরস্পরের দিকে কিছুক্ষণ অপলকে চেয়ে রইল। দুজনেই ভয়ঙ্কর রকম যেন সজাগ হয়ে উঠেছে।
তারপর সহসা আবার প্রফেসার প্রবলভাবে হেসে উঠলেন এবং চিবিয়ে চিবিয়ে অদ্ভুত ভাবে বলে উঠলেন, চমৎকার! তাহলে মান্যবর ডিটেকটিভ বন্ধু আমার আমাকেই খুনী বলে সাব্যস্ত করলেন শেষটায়! ওয়ানডারফুল! অভাবনীয় চিন্তাশক্তি!
না। জলদগন্তীর স্বরে কিরীটী বলে উঠল, অন্ততঃ বর্তমানে আপনাকে খুনী বলে সন্দেহ করিনি। কোন মানুষ আগে থেকে চিন্তা করে খুন করতে পারে, কিন্তু আগে থেকে চিন্তা করে শয়তান হতে পারে না! আমি শুধু কয়েকটা আবশ্যকীয় প্রশ্নই জিজ্ঞাসা করেছি মাত্র। ও-কথা যাক প্রফেসার, বলুন, মিঃ মিত্র কি হিন্দী ভাষা বলতে-কইতে পারতেন?
সত্যি কথা বলতে কি, প্রফেসার বলতে লাগলেন, মোটেই না। হিন্দী ভাষায় তার জ্ঞান, ‘করেঙ্গ’ ‘খায়েঙ্গা’ পর্যন্তই। শুভঙ্কর ছিল আমার ছোটবেলার বন্ধু, তার নাড়ীনক্ষত্র আমি জানি। বড়লোক বাপের একমাত্র ছেলে ছিল ও। লোক জানত ও বিলাতফেরত, উচ্চশিক্ষিত; আসলে ওর পড়াশুনা তেমন ছিল না। ম্যাট্রিক পর্যন্ত বিদ্যার দৌড়। চেহারাটা ছিল সুন্দর আর common sense ছিল প্রচুর, যার ফলে কিছু না জেনেও অনেক কিছুই জািনবার ভান করতে পারত। কিন্তু খেলাধূলায় ওর মত ওস্তাদ বড় একটা দেখা যেত না। টেনিস খেলতে, সাঁতার কাটতে, ঘোড়ায় চড়তে, তরবারি বা ছোরা খেলতে, বন্দুক ছুড়তে, বড় বড় জানোয়ার শিকার করতে ও ছিল একেবারে যাকে বলে অদ্বিতীয়। আচ্ছা, এবারে Good Night জানাচ্ছি। my friend! আশা করি ক্ষণিকের চেনা গরীব বন্ধুর কথাটা ভুলে যাবেন না।
নিশ্চয়ই না। বিশেষ করে না ভুলতে যখন আপনিই এত করে অনুরোধ জানিয়ে যাচ্ছেন! কিরীটী গম্ভীর স্বরে জবাব দিল।
ধীর মন্থরপদে জুতোর শব্দ তুলে প্রফেসার কালিদাস শৰ্মা ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন।
কিরীটী এক সময় বললে, দেখ হরিচরণ, তুমি একবার এখানে যাঁরা যাঁরা উপস্থিত আছেন প্রত্যেকের সঙ্গে কথা বলে জানিবার চেষ্টা কর, তাদের মধ্যে কে কে আজ রাত্রে এখানে প্রফেসার কালিদাস শর্মাকে দেখেছেন! আর খাবার ঘরে গিয়ে একবার দেখ সেখানে সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে নামে বইখানা পাও নাকি! আর চেষ্টা কর জানতে কে ঐ বইখানা এনেছিল সঙ্গে করে? হ্যাঁ, আর যাবার সময় কুমারসাহেবের ম্যানেজারটিকে একবার এখানে পাঠিয়ে দিও তো?
হরিচরণ ঘর থেকে বের হয়ে যেতেই কিরীটী আমাদের দিকে তাকিয়ে বললে, আমি যতদূর জানি, এই কালিদাস শর্মারই বছর তিন-চার আগে কী একটা ব্যাপার নিয়ে দুর্নাম রটে, ফলে কলেজের চাকরি যায়, তারপর থেকেই লোকটা সম্পূর্ণ বেকার; কিন্তু বর্তমানে বেকার অবস্থায় এত বাবুয়ানা ওর আসে কোথা থেকে? খুব সম্ভব কুমারসাহেবকে ও নেশার বস্তু যোগায়!
আমারও যেন তাই মন হয়, ডাঃ চট্টরাজ চাপা উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, বোধ হয় সেইজন্যই কুমারসাহেব যখন আজ রাত্রে আমাদের সঙ্গে গল্প করতে করতে উঠে গিয়ে দ্বিতীয়বার ফিরে এলেন, তখন তাঁকে একরকম যেন অসুস্থের মত দেখাচ্ছিল। মাথাটা নিচের দিকে নামিয়ে শ্লথ মন্থর গতিতে হ্যাঁটছিলেন। তখনই আমার মনে হয়েছিল, ভদ্রলোক বোধ হয় কোন একটা নেশাটেশায় অভ্যস্ত।
আপনি ঠিকই বলেছেন ডাক্তার, কিরীটী বলে উঠল, খুব সম্ভবত দ্বিতীয়বার তিনি যখন আমাদের কাছে আসেন, তখন কোন একটা কিছু নেশা করে এসেছিলেন। আপনি বোধ হয় লক্ষ্য করেননি।
আমি বাধা দিলাম, উনি না লক্ষ্য করলেও, আমার দৃষ্টিকে তুমি এড়াতে পারনি বন্ধু। কুমারসাহেব যখন আমাদের দেওয়া সিগার না খেয়ে নিজের সিগারেট খেয়ে উঠে যান, তখন তাঁর অ্যাসট্রের মধ্যে সেই নিক্ষিপ্ত নিঃশেষিত সিগারেটের টুকরোটা তুমি তুলে নিয়ে পকেটস্থ করেছা!
এতদিনে সত্যসত্যই সুব্রতর চোখ একটু সজাগ হতে আরম্ভ করেছে। কিরীটী হাসতে হাসতে বলতে লাগল, চেয়ে দেখুন ডাক্তার, কিরীটী পকেটে হাত চালিয়ে সিগারেটের টুকরো বের করে আমাদের চোখের সামনে মেলে ধরল, একটু ভাল করে লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারবেন, এ সিগারেট কেনা নয়, হাতে পাকিয়ে তৈরি করা, তাছাড়া সিগারেটের মসলা যেমন হয় এর মধ্যকার মসলা ঠিক তেমন নয়; একটু মোটা এবং কোনমতে কাগজ দিয়ে জড়িয়ে সিগারেট বানানো হয়েছে। শুকে দেখুন…। বলতে বলতে কিরীটী সিগারেটটা খুলে ফেললে।