কিরীটী সম্মুখে উপবিষ্ট প্রফেসর শর্মার দিকে তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ প্রফেসার আপনি যা বলছিলেন এবার বলুন।
প্রফেসর শর্মা বললেন, জিনজার খাবার পর সেক্রেটারী শুভঙ্করকে নিয়ে আমি খাবার ঘরে যাই। সেখানে আমাকে একটু অপেক্ষা করতে বলে শুভঙ্কর নীচে চলে যায়।
অনুমান তখন রাত্ৰি কটা?
প্রফেসর শর্মা মৃদু একটু হাসলেন, ক্ষমা করবেন মিঃ রায়, আগে তো বুঝিনি আজকের রাত্রের প্রতিটি ঘণ্টা, প্রতিটি মিনিটের হিসেবনিকেস কারো কাছে দিতে হবে তাহলে না হয় ঘড়িধরে সব কাজগুলো করে রাখতাম। তবে যতদূর মনে হয়। রাত্রি তখন নটা হবে বা নটা বাজবার মিনিট চার-পাঁচ আগেও হতে পারে। তারপর হঠাৎ ব্যঙ্গ-মিশ্রিত কণ্ঠে বললেন, কিন্তু ব্যাপারটা কি বলুন তো মিঃ রায়, গরীবকে ফঁাসাবার মতলবে জেরা করছেন না তো?
কিরীটী ও-কথার কোন জবাব না দিয়ে গভীর স্বরে প্রশ্ন করলে, আপনি তাহলে তারপর খাবার ঘরেই রয়ে গেলেন?
হ্যাঁ খাবার ঘরে পরিষ্কার টেবিল চেয়ার পাতা ছিল, কেননা আজ খাবার আয়োজন হয়েছিল নীচে। হঠাৎ আমার নজরে পড়ে, টেবিলের ওপর একখানি হিন্দী ভাষায় অনুদিত ছোটদের রূপকথা সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে পড়ে আছে। আমি হিন্দী ভাষা বেশ ভালই জানি এবং হিন্দীতে অনুদিত ছোটদের একখানি রূপকথা দেখে লোভ সামলাতে পারলাম না; তাছাড়া রূপকথা পড়তে চিরদিনই বড় ভালবাসি। বইখানি হাতে পেয়ে অন্যমনস্ক ভাবে একটা চেয়ারের ওপরে বসে পড়লাম। বেশী লোকের গোলমাল আমি কোন দিনই পছন্দ করি না, ভাবলাম বাঁচা গেল। হাতের কাছে বইটা পেয়ে তাতেই মনঃসংযোগ করলাম। বইটা সত্যিই ভাল। রুপকথা পড়তে আপনার কেমন লাগে মিঃ রায়?
ব্রাভো! চমৎকার! কিরীটী চাপা উল্লাস ভরা কণ্ঠে বলে উঠল, এ যে দেখছি। একটা মজার রহস্য উপন্যাস হয়ে দাঁড়াচ্ছে! চারদিকে উৎসবের কলোচ্ছাস, একজন ছায়ার মত এসে স্নানের ঘরে মাটি কোপানোর খুরপি ফেলে গেলেন; আর একজন খাবার ঘরে এসে সাত সমুদ্র তেরা নদীর পারে রুপকথা কুড়িয়ে পেলেন এবং তখনি সেই রূপকথা পড়ায় মত্ত হয়ে উঠলেন। এমন সময় এক সাংঘাতিক খুনী রক্ত দেখবার নেশায় পাশের ঘরে হায়েনার মত হিংস্র হয়ে উঠছে! সব কিছুর মধ্যেই একটা মানে থাকা দরকার। যদি এই পর পর ঘটনাগুলোর আদপে কোন মানেই না থাকে, তাহলে এই পৃথিবীতে কোন কিছুরই মানে श्ा না!
পরমুহুর্তেই যেন হঠাৎ কিরীটী আবার গভীর হয়ে প্রফেসার শমর্যকে পুনঃপ্রশ্ন করল, খুব ভাল, ঘড়ির সময় নিয়ে আপনি একটু আগে আমাদের ঠাট্টা করছিলেন, আবার কিছু সময়-সম্পৰ্কীয় অতি আবশ্যকীয় দু-চারটে কথা এসে যাচ্ছে! ক্ষমা করবেন প্রফেসার, আমি সিঁড়ির ও খাবার ঘরের ঘড়ি মিলিয়ে দেখেছি। আমার ঘড়ি আর ওই দুটো ঘড়ি একই সময় দিচ্ছে— আপনার ঘড়িতে এখন কটা প্রফেসার?
প্রফেসর শর্মা পকেট থেকে একটা মূল্যবান রৌপ্য-নির্মিত ঘড়ি বের করে হাতের ওপরে নিয়ে দেখে বললেন, ঠিক দশটা বেজে বারো মিনিট হয়েছে।
আমারও ঠিক তাই, কিরীটী আপন হাতঘড়ি দেখে বললে, তোমার ঘড়িতে কত সুব্রত?
দশটা বেজে চব্বিশ মিনিট। আমার ঘড়ি দেখে বললাম।
বেশ! প্রফেসার, আপনার যদি আপত্তি না থাকে। তবে দয়া করে যদি বলেন, রাত্রি ঠিক সাড়ে নটার সময় আপনি কোথায় ছিলেন? কিরীটী প্রশ্ন করল প্রফেসারের মুখের দিকে চেয়ে, অর্থাৎ যখন মিঃ মিত্ৰ কুমারসাহেবর প্রাইভেট ঘরে গিয়ে ঢোকেন?
নিশ্চয়ই। বলে সহসা প্রফেসার হাঃ হাঃ করে উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠলেন। তারপর কেনমতে হাসি চাপিতে চাপতে বললেন, সাড়ে নটার সময় হলঘরে দাঁড়িয়ে আমি আপনারই পাহারারত ভদ্রলোকটির সঙ্গে কথা বলছিলাম। তারসঙ্গে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রায় আট-দশ মিনিট কথাবার্তা বলেছি। তারপর তার সামনেই এই ঘরে এসে ঢুকি এবং কুমারসাহেব এইখানে দাঁড়িয়ে আপনাদের সকলের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেন, আশা করি আপনার মহামান্য তীক্ষ্মবুদ্ধি বন্ধুবর এত তাড়াতাড়ি সে কথা ভুলে যাননি!
কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে স্পষ্টই বুঝতে পারছিলাম অসহ্য বিরক্তিতে সে এবার নিশ্চয়ই কোন কিছু বলে বসবে, কিন্তু হঠাৎ যেন সে নিজেকে সামলে নিয়ে সামনেই ঝোলানো ভৃত্যদের ডাকবার ঘণ্টার দড়িটায় ধীরে ধীরে একটা টান দিয়ে ছেড়ে দিল।
আমরা সকলে নির্বক বিস্ময়ে কিরীটীর মুখের দিকে উদ্গ্ৰীব হয়ে চেয়ে রইলাম।
হরিচরণ ঘরে এসে ঢুকল।
প্রফেসারের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে কি ইঙ্গিত করতেই ঘাড় হেলিয়ে বললে, হ্যাঁ, স্যার, ঐ ভদ্রলোক আমার কাছেই ছিলেন। এক সময় আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, মশাই, ঠিক এখন সময় কত বলতে পারেন? আমার মনে হচ্ছে আমার ঘড়িটা বোধ হয় একটু slow যাচ্ছে। আমি বললাম, আমার ঘড়ি ঠিকই আছে—সাড়ে নটা বেজেছে। আমরা দুজনে এগিয়ে গিয়ে সিঁড়ির ঘড়িটাও একবার দেখে নিজেদের ঘড়ির সঙ্গে মিলিয়ে নিলাম। কুমারসাহেবের প্রাইভেট রুমের ঠিক সামনাসামনি ওঠবার সিঁড়ি, আমরা দুজনেই সিঁড়ির মাথা পর্যন্ত এগিয়ে গিয়েছিলাম। ভদ্রলোক আমার ঘড়িটা সিঁড়ির সঙ্গে একই টাইম দিচ্ছে দেখে নিজের ঘড়িটি মিলিয়ে নিতে নিতে আমার সঙ্গে কথা বলছিলেন।
কিরীটী বাধা দিল, তাহলে তুমি তখন ঠিক সিঁড়ির মাথায় ছিলে, যখন মিঃ মিত্র কুমারসাহেবের প্রাইভেট রুমে প্রবেশ করেন।
হ্যাঁ, সেই সময় প্রায় পাঁচ মিনিট উনি আমার সঙ্গেই ছিলেন। তারপর তিনি এই ঘরে এসে প্রবেশ করেন।