কি? বিকাশ প্রশ্ন করলেন।
আপনার বন্ধু অর্থাৎ মিঃ শুভঙ্কর মিত্ৰ খুন হয়েছেন।
সহসা যেন কথাটা শুনে বিকাশ মল্লিক অতিকে উঠলেন, অ্যাঁ…তবে কি—তবে কি যে মৃতদেহ দেখে এলাম একটু আগে…
হ্যাঁ, তাঁরই মৃতদেহ। এমন সময় কিরীটী ও প্রফেসর শর্মা এসে ঘরে প্রবেশ করলেন।
আপনি তাহলে এখন যেতে পারেন বিকাশবাবু, আমার লোকের কাছে আপনার ঠিকানাটা শুধু দয়া করে রেখে যাবেন।
বিকাশ মল্লিক কিরীটীর কথা শুনে একপ্রকার ছুটতে ছুটতেই ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।–
সে ঘরে তখন আর কোন লোকজনই ছিল না, সেকথা আগেই বলেছি।
মাথার ওপর উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক আলোয় ঘরখানি উদ্ভাসিত। একটু আগেও যে-ঘরটা কলহাস্যে মুখরিত ছিল, এখন সেটা শূণ্য খা-খাঁ করছে।
কিরীটী প্রফেসর শর্মাকে একটা চেয়ারে উপবেশন করতে বলে নিজেও একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল।–
মিঃ শুভঙ্কর মিত্রের আপনিই সব চাইত বড় বন্ধু ছিলেন শুনেছি। সুতরাং এক্ষেত্রে আপনার কাছে যতটা সাহায্য পাব, আর কারও কাছ থেকেই তা পাব না। অবিশ্যি এত রাত্রে আপনাকে বেশী বিরক্ত করব না। সামান্য দু-চারটে কথা—বুঝতেই পারছেন, বিশেষ প্রয়োজনেই..
না না, সে কি, জিজ্ঞাসা করবেন বৈকি। বিশেষ করে এখানে যখন উপস্থিত আছি।
আচ্ছা, আজ কাঁটার সময় ঠিক আপনি এখানে এসে পৌছান মিঃ শৰ্মা?
সঠিক আমার মনে পড়ছে না, তবে রাত্রি আটটা থেকে সোয়া-আটটার মধ্যে।
বেশ, তারপর থেকে অর্থাৎ আপনার এখানে পৌঁছবার পর থেকে এখানে আপনার চোখে যা যা দেখেছেন বা ঘটেছে সব খুলে সংক্ষেপে আমায় বলুন।
সে আর এমন বিশেষ কঠিন কি! আমার নিজের যে এখানে আসবার খুব ইচ্ছা ছিল তা নয়, একপ্রকার দীনতারণের ইচ্ছাতেই এখানে আজ রাত্রে আমায় আসতে হয়; অথচ সে এসেই চলে গেল, তাছাড়া-হঠাৎ কথার মাঝে যেন একটু থেমে প্রফেসর শর্মা আমার কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলেন, তাছাড়া আমার ধারণা ছিল, দীনতারণের এখানে কারও সঙ্গে সাক্ষাৎ করবার আগে থেকেই কথা ছিল।
কারও মানে কোন ভদ্রলোকের সঙ্গে তো? কিরীটী বললে।
প্রফেসর শর্মা যেন একটু চমকে উঠলেন। পরীক্ষণেই কিরীটীর চোেখর ওপর চোখ রেখে স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন।
না, আমি তা ঠিক জানি না। প্রফেসর শর্মা আবার বলতে লাগলেন, তাছাড়া এখানে পৌঁছেই আমি নীচের হলঘরে ঢুকি, সেইখানেই মিঃ মিত্রের সঙ্গে আমার দেখা হয়। আমরা দুজনে কথা বলতে বলতে একটা টেবিলের সামনে দুটো চেয়ার টেনে নিয়ে বসে দু গ্লাস ‘জিনজার’ খেতে লাগলাম। হঠাৎ এক সময় “জিনজার’ খেতে খেতে শুভঙ্কর হাসতে হাসতে গ্লাসের লাল রঙের তরল পদার্থের দিকে চেয়ে আমায় বললে, দেখছিল কালিদাস, কী টুকটুকে লাল! সত্যি ভাই, আজ রাত্রে এই লাল রংটা যেন আমার মনে একটা নেশা ধরিয়ে দিচ্ছে! Oh red, it is simply charming! It is nice!
হঠাৎ কিরীটী মুখটা ঘুরিয়ে আমাকে বললে, সুব্রত, বেল বাজিয়ে একটা বেয়ারাকে ডাক তো।
বেল বাজবার সঙ্গে সঙ্গেই, যে বেয়ারাটি প্রথম মৃতদেহ আবিষ্কার করে, সে এসে দাঁডাল।
কিরীটী তার মুখের দিকে চেয়ে বললে, আরে, তুমিই তো প্রথম মৃতদেহ দেখ, না? তুমি কফি নিয়ে যাবার ঘণ্টা শোন কখন?
আজ্ঞে, রাত্রি ঠিক সাড়ে-নটার সময়। কেননা আমি ঘড়ির দিকে নজর রেখেছিলাম।
তুমি তখন কোথায় ছিলে?
রান্নাঘরে হুজুর। রান্নাঘরের লাগোয়াই খবার ঘর, এবং রান্নাঘর ও খাবার ঘর কুমারসাহেবের প্রাইভেট রুমের ঠিক পিছনেই।
কুমারসাহেবের প্রাইভেট রুমের মধ্যে যে তোমাদের ডাকবার অন্য বেল আছে, সেই বেল বাজার দড়িটা কোথায়?
প্রাইভেট রুম থেকে। হলঘরে আসবার দরজার গায়েই হুজুর।
বেশ, বেল শোনা মাত্রই তুমি কফি নিয়ে চলে এলে, না?
না। বাবুর্চি কফিটা তৈরী করতে একটু সময় নেয়। মিনিট দশেক বোধ করি দেরি হয়েছিল। কফি নিয়ে আসতে।
কোন দরজা দিয়ে তুমি কুমারসাহেবের প্রাইভেট রুমে ঢোক?
ওঘরে যাবার হলের মধ্য দিয়ে যে দরজা আছে সেই দরজা দিয়ে। দরজার ঠিক সামনেই একজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়েছিলেন, বোধ হয় আপনারই লোক হবেন তিনি। আমি দরজায়। শব্দ করলাম, কিন্তু কোন সাড়া শব্দ ভেতর থেকে পেলাম না। এবার জোরে দরজায় ধাক্কা দিলাম, কিন্তু তাতেও কোন সাড়াশব্দ পেলাম না। তখন আমি সামনে দাঁড়ানো সেই … ভদ্রলোকটিকে জিজ্ঞাসা করি, ঘরে কেউ আছেন কি? তাতে তিন জবাব দেন, তার মানে? কারও ঐ ঘরে থাকবার কথা ছিল নাকি? আমি তাতে জবাব দিই, আজ্ঞে, সেক্রেটারী সাহেবের তো ঐ ঘরে থাকবার কথা। তাতে আমায় বললেন, তবে যাও। আমি তখন দরজা টেনে ভিতরে প্রবেশ করি। বেয়ারার গলার স্বর ক্রমেই উত্তেজিত হয়ে উঠছিল, সে কথা বলতে বলত ঘন ঘন আমাদের সকলের দিকে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছিল।
তারপর কিরীটী জিজ্ঞাসা করল।
আজ্ঞে, তারপর আমি কফি নিয়ে ঘরে গিয়ে ঢুকে প্রথমে কিছু দেখতে পাইনি।
ঘরের মধ্যে এগিয়ে গিয়ে হঠাৎ পায়ে বাধা পেয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাই। পড়েই আমি চিৎকার করে উঠি ও তাড়াতাড়ি উঠে আপনাদের ঘরের দিকে যাই। আমি আল্লার নামে শপথ করছি, হুজুর এর চাইতে বেশী কিছুই আমি জানি না। আমি খুন করিনি। বলতে লিতে লোকটা হাউ হাউ করে কঁদতে কঁদিতে কিরীটীর পায়ের কাছে আছাড় খেয়ে পড়ল।
তোমাদের কোন ভয় নেই হে, তুমি উঠে বস। আমি জানি তুমি খুন করেনি। কিরীটির কথায় কতকটা আশ্বস্ত হয়েই যেন লোকটা চোখ মুছতে মুছতে উঠে বসল।
০৬. প্রফেসর শর্মার দিকে তাকিয়ে