এতে তো আশ্চর্য হবার কিছুই নেই রায়! ডাক্তার বললেন, যারা নিজেদের সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন বা এক কথায় সোজা ভাবে বলতে পার দান্তিক, তাদের পক্ষে নিজেদের ড্রাম পিটবার-নিজেকে প্রচার করবার এও একটা কাঠি বৈকি।
না বন্ধু না, ব্যাপারটা অত সামান্য নয়। এর মধ্যে অন্য কোন ব্যাপার আছে। লক্ষ্য করেছেন, এর মধ্যে কিছু হারিয়েছে কিনা? কিরীটী ডাক্তারের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল।
তার মানে? তোমার কোন দেশী প্রশ্ন কিরীটী? আমি কি আগে থেকে জানতাম নাকি মিঃ মিত্রের পকেটে কি আছে না আছে। আশ্চর্য! রাগতভাবে ডাক্তার জবাব দিলেন।
হ্যাঁ দেখুন, আমরা জানি ভদ্রলোক এখন পর্যন্ত অবিবাহিত এবং এর নিজের ঘর-বাড়িও আছে। সেখানে নিশ্চয়ই চাকরিবোকরও আছে—এখানে তো আর উনি দিবা-রাত্ৰই উপস্থিত থাকেন না! এ কথাও হয়তো বললে নেহাৎ ভুল হবে না যে, ঘরের যাবতীয় চাবিই চাকরবাকারের হাতে দিয়ে তিনি আসেন না। অন্ততঃ দু-চারটে প্রাইভেট ঘরের চাবিও ওঁর পকেটে থাকা উচিত, যা হয়তো চাকরবাকারের হাতে বিশ্বাস করে রেখে আসা চলে না। কিন্তু এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, মিঃ মিত্রের পকেটে সে ধরনের কোন চাবিই পাওয়া যাচ্ছে না। এর পকেট থেকে কিছু হারিয়েছে কিনা বলতে আমি ঐ চাবির কথাই বলতে চাইছিলাম ডাক্তার!
তারপর সহসা কিরীটী আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বললে, সুব্রত, অনুসন্ধানের ব্যাপারটা একটু চোখ মেলে সম্পন্ন করলেই অনেক কিছু গোলমাল চোখে পড়ে। একটা অনুসন্ধানের কাজে হাত দিলে সর্বদা চিন্তা করবে, কি থাকা উচিত ছিল, অথচ তা নেই বা পাওয়া যাচ্ছে না! এক্ষেত্রে আমার চাবির কথাটাই মনে হচ্ছে, সেটাই যেন চুরি গেছে। চাবি চুরি যাওয়াটা খুবই আশ্চর্যজনক। কিন্তু তার চাইতেও আশ্চর্যজনক অথচ সহজ একটা জিনিস হারিয়েছে বা পাওয়া যাচ্ছে না, এখুনি তোমাদের সেটা দেখােব। অথচ তোমরা দুজনেই অর্থাৎ ডাঃ চট্টরাজ ও তুমি অসাবধানতাবশতঃ লক্ষ্য করোনি, যা প্রত্যেক মানুষেরই পক্ষে, যাদের সামান্য একটু বুদ্ধি আছে এবং যারা সেটা খাটাবার চেষ্টা করে, এ ঘরে ঢোকামাত্রই লক্ষ্য করা উচিত ছিল এমন একটা জিনিস পাওয়া যাচ্ছে না!
হত্যাকারীর সম্পর্কে কোন সূত্র কি? আমি প্রশ্ন করলাম।
হ্যাঁ, হত্যাকারী নিজে।
এমন সময় ক্যাঁচ করে দরজা খোলার একটা মৃদু শব্দে আমরা সকলে চমকে চোখ তুলে তাকালাম। এ ঘরের সঙ্গে হলঘরের যোগাযোগ করে যে দরজাটি, তার ফঁােক দিয়ে সাধারণ পোশাক পরা একজন লোকের মুখ ও দেহের অর্ধেকটা প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে এবং তাকে একপ্রকার এক পাশে ঠেলেই একটি যুবক ঘরে এসে প্রবেশ করল।
চোখের উদ্বিগ্ন দৃষ্টি দেখলেই মনে হয় যুবক ভয়ানক ভীত হয়ে পড়েছে। যুবক ঘরে ঢুকেই থাপ করে একটা গদি আঁটা চেয়ারে বসে পড়ল, এসব ব্যাপার কী? বাড়ি যাওয়ার জন্য বেরুতে যাচ্ছি, গেটম্যান বললে, যেতে দেওয়া হবে না, পুলিসের অর্ডার! কুমারসাহেবের দেখা পেলাম না। তাঁর সেক্রেটারী মিঃ মিত্রই বা কোথায়?
সাধারণ পোশাক পরা যে লোকটি আমাদের সঙ্গেই গাড়িতে এসেছিল, সে যুবকের পিছু পিছু এই ঘরে ঢুকল।
ইনি কে জান কালী? কিরীটী লোকটিকে প্রশ্ন করল।
না মিঃ রায়, তবে এঁকে মিঃ মিত্রের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে দেখেছিলাম। তখনই শুনেছিলাম এর নাম নাকি বিকাশ মল্লিক। এমন সময় আবার দরজার বাইরে একটা গোলমাল শোনা গেল। পরীক্ষণেই প্রফেসার কালিদাস শৰ্মা ঘরে প্রবেশ করলেন।
সহসা একটা অস্ফুট ভয়চকিত শব্দ প্রফেসারের কণ্ঠ থেকে বের হয়ে এল, উঃ কী ভয়ানক! এ কি? সমস্ত মুখ তাঁর ভয়ে রক্তশূন্য ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।
হঠাৎ একটা ভারী বস্তুর পতনশব্দে সকলে সচকিত হয়ে উঠে দেখি-বিকাশ মল্লিক অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছে।
এই অপদার্থটাকে বাইরে রেখে এস। প্রফেসর শর্মা কালীকে আদেশ দিলেন।
কিরীটী আমাকে ইঙ্গিত করতেই আমি ও ডাক্তার দুজনে জ্ঞানহীন বিকাশ মল্লিকের অসাড় দেহটা ধরাধরি করে কোনমতে পাশের ঘরে নিয়ে এলাম।
এ ঘরের মধ্যেও মৃত্যুর মতই স্তব্ধতা বিরাজ করছে।
একটা সামান্য ভূঁচ পড়লেও বোধ হয় শব্দ শোনা যায়।
কিছুক্ষণ চোখেমুখে জল দিয়ে হাওয়া করতে করতে একসময় ধীরে ধীরে বিকাশ মল্লিক উঠে সোফার ওপরে হেলান দিয়ে বসল এবং ক্লান্তিভারে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস নিল।
ডাক্তার বললেন, এখন একটু সুস্থ বোধ করছেন কি?
হ্যাঁ মৃদু ক্লান্তস্বরে বিকাশবাবু জবাব দিলেন।
মিঃ শুভঙ্কর মিত্ৰ বুঝি আপনার অনেক দিনের পরিচিত? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
না, খুব বেশী দিনের নয়, মাত্র কয়েক সপ্তাহ হবে। বিকাশ বলতে লাগল, ভাল লোকের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় অল্পদিনেই জমে ওঠে। মিঃ মিত্র একজন নামকরা স্পোর্টসম্যান ও শিকারী ছিলেন। প্রায়ই আমাদের দেশের বাড়ি ডায়মণ্ডহারবারে কি একটা কাজে যেতেন; সেখানেই প্রথম আলাপ হয়। তাছাড়া অনেকদিন থেকেই হিন্দীটাকে ভাল করে শিখবার আমার ইচ্ছা। শুভঙ্করবাবু চমৎকার হিন্দী বলতে ও লিখতে জানতেন। আমি ওঁর কাছেই একটু একটু করে হিন্দী শিখছিলাম। তারপর উনিই আমাকে একদিন এখানে এনে কুমারসাহেবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন এবং কুমারসাহেবের দয়াতেই একটা অফিসে আজ দিন দশ হল একটা কাজ যোগাড় করেছি। তিনিই আজকের এই উৎসবে আমাকে নিমন্ত্রণ করে আনেন।
কিন্তু একটা সংবাদ বোধ হয় এখনও আপনি পাননি বিকাশবাবু! আমি বললাম।