উঃ, ভদ্রলোককে কসাইয়ের মত জবাই করা হয়েছে! কিরীটী মৃদুকণ্ঠে বললে, একেবারে পাশবিক হত্যা! দেখ দেখ সু, তরবারিটায় বোধ হয় খুব শীঘ্রই শান দেওয়া হয়েছিল। বলতে বলতে কিরীটি ঘরের একটিমাত্র জানালার দিকে এগিয়ে জানালাটিকে অনেকক্ষণ ধরে পরীক্ষা করে বাইরের দিকে ঝুকে দেখেশুনে বললে, প্রায় চল্লিশ ফিট নীচে ট্রাম রাস্তা দেখা যাচ্ছে। এখান থেকে কারও লাফিয়ে নীচে যাওয়া বা প্রবেশ করা সম্পূর্ণ অসম্ভব। কিরীটী কিছুক্ষণ ঘরের মধ্যে হাত দুটো ‘মুষ্টিবদ্ধ করে পায়চারি করতে লাগল, তারপর সহসা এক সময় কার্পেটের রক্ত এড়িয়ে মৃতদেহের কাছে হ্যাঁটু গেড়ে বসে ভাল করে কুঁকে কি যেন পরীক্ষা করতে লাগল। এমন সময় ওপাশের দরজাটা খুলে গেল। একটা লোকের মাথা দেখা গেল।
ম্যানেজারবাবু যেন কী বলতে যাচ্ছিলেন, কিরীটী বাধা দিল, ও আমার লোক-হরিচরণ। কী খবর হরিচরণ? ঐ পথ দিয়ে কেউ বেরিয়েছে?
আজ্ঞে না।
বেশ। নজর রাখ।
মাথাটা অদৃশ্য হয়ে গেল।
ঐ দরজা দিয়ে এ-ঘর থেকে। হলঘরে যাওয়া যায়, না ম্যানেজারবাবু?
আজ্ঞে হ্যাঁ। ম্যানেজারবাবু মৃদুস্বরে জবাব দিলেন। জানালায় একটা লাল রংয়ের সিস্কের পর্দা টাঙানো ছিল, হাওয়ায় সেটা পতপত করে শব্দ করছিল।
আসুন ডাক্তার, মাথাটা একটু পরীক্ষা করা যাক। বলতে বলতে কিরীটী চুলের গোছা ধরে কাটা মুণ্ডটা তুলে ধরল। তারপরে দুজনে অনেকক্ষণ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেটা পরীক্ষা করল। এটা এখানেই থাক। বলে আবার মুণ্ডুটা যথাস্থানে নামিয়ে রাখল।
কুমারসাহেব একপাশে ভূতের মত নির্বক নিঝুম হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন; কিরীটী তাঁর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, দেখুন তো কুমারসাহেব, ঐ তরবারিখানা এই ঘরেরই একখানা কিনা?
কুমারসাহেব মৃদু কণ্ঠে জবাব দিলেন, আজ্ঞে হ্যাঁ।
মজার ব্যাপার, কিরীটী বলতে লাগল, এইরকম ধারালো চকচকে তলোয়ারগুলো দিয়ে ঘর সাজিয়ে রেখেছেন—এইভাবে খুনের সাহায্য করতেই নাকি কুমারসাহেব?
জবাবটা দিলেন ম্যানেজারবাবু, আজ্ঞে, উনি একজন উঁচুদরের আর্টিস্ট। পিতামহ ও প্রপিতামহের গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতিটা উনি এমনি ভাবে সাজিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছেন।
চমৎকার যুক্তি, একেবারে অকাট্য! মৃদুস্বরে কিরীটী শুধু বললে, কিন্তু সে যাক গে, এই হতভাগ্য মৃত ব্যক্তিকে চেনেন। আপনি?
আজ্ঞে হ্যাঁ ইনি আমাদের কুমারসাহেবের নবনিযুক্ত সেক্রেটারি মিঃ শুভঙ্কর মিত্র। ম্যানেজারবাবু জবাব দিলেন।
আজ রাত্রে আপনি একে এই ঘরে ঢুকতে দেখেছিলেন?
আজ্ঞে না, সন্ধ্যার পরে ওঁর সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয়েছিল, তারপর আর হয়নি।
কোথায় দেখা হয়েছিল?
কাছাকাছি অভ্যাগতদের অভ্যর্থনার জন্য অপেক্ষা করছেন।
ওঁর সঙ্গে আর কে কে ছিল?
প্রফেসার কালিদাস শৰ্মা আর দীনতারণবাবু। দীনতারণবাবু তার একটু পরেই চলে যান।
বেশ, এবারে আপনি দয়া করে বাইরে গিয়ে প্রফেসার কালিদাস শর্মাকে একটু ডেকে আনুন। তিনি কিছু জানেন না, কোন কথা তাকে বলবেন না, শুধু বলবেন কুমারসাহেব একটিবার তাকে ডাকছেন।
ম্যানেজার ঘর থেকে নিঃশব্দে বের হয়ে গেল।
তারপর ডক্তার, আপনার এ ব্যাপারটাকে কী মনে হয়? কিরীটী প্রশ্ন করল।
ডাঃ চট্টরাজ বললেন, দেখ রায়, এ ধরনের হত্যা করাটা এমন কিছু আশ্চর্য ব্যাপার নয়। এক্ষেত্রে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, হত্যাকারীর খুন করবার ইচ্ছা ছিল এবং ধারালো অস্ত্ৰ হাতের কাছে পেয়ে সেই ইচ্ছাই এই ভয়ঙ্কর হত্যায় পরিণত হয়েছে। কে বলতে পারে, হয়তো খুনীর মনে রক্ত দেখবার পিপাসা জেগেছিল! তারপরই এই খুন।
দয়া করে একটু ভেবে দেখুন ডাক্তার, যতদূর সব দেখেশুনে মনে হয়, এক্ষেত্রে খুনটা হঠাৎ একটা ইচ্ছার বশবর্তী হয়ে হয়নি। খুব সাবধানের সঙ্গে এবং আগে থেকে ভেবেচিন্তেই এই খুন করা হয়েছে। চেয়ে দেখুন, মৃতদেহের positionটা দেখেও কি আপনার মনে কোন কিছুই আসছে না?
মৃত্যুদেহ দেখে এইটুকু কেবল বোঝা যায়, খুনের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্তও হত্যাকারী ও নিহত ব্যক্তির মধ্যে পরস্পরের কোন রকম হাতাহাতি বা ঝটাপটি হয়নি!
নিশ্চয়ই না, মৃতদেহের position থেকে স্পষ্টই মনে হয়। পিছন থেকে আচমকা কেউ ওঁকে ধারালো অস্ত্ৰ দিয়ে আঘাত করেছে, যে সময় হয়তো বেচারী কোন কারণে টেবিলটার ওপর ঝুঁকে পড়ে কিছু করতে যাচ্ছিল। তাছাড়া এক্ষেত্রে আর একটা জিনিস বিশেষ করে লক্ষ্য করবার আছে। টেবিলের ঠিক ওপরে দেওয়ালে ঝুলানো যে ঢাল-তলোয়ার আছে, মেঝে থেকে ওর উচ্চতা প্রায় আট-ন ফিট হবে এবং একথা যদি ধরে নেওয়াই হয় মৃতদেহের হাতে ধরা ঐ ধারালো তলোয়ারটা সামনের ঐ দেওয়ালে টাঙানো ঢালের অন্য পাশ থেকে নামিয়ে নেওয়া হয়েছে, তাহলে নিশ্চয়ই টেবিলের ওপরে উঠে দাঁড়াতে হয়েছিল দেওয়ালে টাঙানো তলোয়ারটা হত্যাকারীকে নামাতে, কেননা অতখানি লম্বা কোন মানুষ হতে পারে না। শুধু তলোয়ারটা নামাতেই নয়, সেই তলোয়ার দিয়ে মিঃ মিত্ৰকে খুন করতে হলে মিঃ মিত্রকে নিশ্চয়ই সুবোধ শিশুটির মত গলাটা বাড়িয়ে দিতে হয়েছিল। আর তা যদি না হয়ে থাকে, অর্থাৎ মিঃ মিত্রের অজান্তেই যদি তাঁকে খুন করা হয়ে থাকে, তবে বলতে হয় মিঃ মিত্র অন্ধ ও কালা, চোখেও তিনি কোন কিছু দেখতে পাননি, কানেও কোন শব্দ শুনতে পাননি। কিন্তু কুমারসাহেবের মত একজন ধনী গণ্যমান্য লোকের প্রাইভেট সেক্রেটারী যে কালা ছিলেন এ কথাই বা বলা যায় কী করে? বলতে বলতে কিরীটী সহসা কুমারসাহেবের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলে, কী কুমারসাহেব, আপনিই বলুন না, আপনার সেক্রেটারি কি সত্যিসত্যিই অন্ধ আর কালা ছিলেন নাকি?