নতুন নয়!
না, বহু পুরাতন এবং বহুবার ইতিপূর্বে বহু পুরুষ বহু নারীর সামনে উচ্চারণ করেছে কথাটা–
অনন্যর কথার ধরন ঐরকমই ছিল।
মৃদু হেসে বিপাশা বললে, তবু শুনি সেই বহু পুরাতন কথাটাই না হয়!
তোমাকে আমি ভালবাসি—
তাই বুঝি! তা কবে থেকে বুঝলে? পালটা হেসে বিপাশা প্রশ্ন করে।
কোন নির্দিষ্ট দিনে নয়—
তবে?
দিনে দিনে বুঝেছি, সমস্ত হৃদয় দিয়ে আমার বুঝেছি, আচ্ছা বিপাশা, তুমি?
কি, আমি?
তুমিও কি—
সেটা আজও যদি বুঝতে না পেরে থাক তাহলে আমার মুখের কথাটা শুনেই কি আর বুঝতে পারবে?
যাক, নিশ্চিন্ত হলাম।
ভয় ছিল বুঝি?
না ভয় নয়—
তবে?
একটা ভীরু সংশয় ছিল—
এখন আর নেই তো?
না, আর সেইজন্যেই সাহস করে এতদিন তোমার কাছে উচ্চারণ করতে গিয়েও উচ্চারণ করতে পারিনি।
অনন্য বিপাশার আঙুলগুলো নিজের আঙুলের মধ্যে নিয়ে খেলা করছিল—বিপাশা বলল, কিন্তু বাবাকে কথাটা জানাতে হবে তো–
তা তো হবেই, আর আশঙ্কা সেখানেও একটা আছে—
আশঙ্কা!
হ্যাঁ, নিবারণ কাকা যদি না বলেন?
তা বললেই বা—
সত্যিই বলছ বিপাশা?
হুঁ।
আজ তাহলে আমি চলি।
অনন্য বিপাশার হাতের মুঠোয় মৃদু একটা চাপ দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। বিপাশা কিন্তু যেমন বসেছিল তেমনিই সোফাটার উপর বসে রইল, এবং কতক্ষণ যে ঐভাবে বসে ছিল তার খেয়াল নেই, হঠাৎ রজতশুভ্রর কণ্ঠস্বরে তার চমক ভাঙল—যাক, একাই আছ তাহলে? আমি ভেবেছিলাম হয়ত–
এতদিন যে আসনি রজত! বিপাশা বললে।
বাঃ, সেদিন বলে গেলাম না—তোমাকে ভাববার সময় দিয়ে যাচ্ছি! রজতশুভ্র এসে সোফায় বিপাশার পাশে বসল, তারপর, মতি স্থির করেছ তো?
মতি স্থির আমার অনেক দিন আগেই হয়ে গিয়েছে–
অনেক দিন–কবে?
অনেক দিন আগে।
তাহলে কালই আমি তোমার বাবার কাছে কথাটা বলি? পরশু আমি ট্রেনিংয়ে যাচ্ছি—ফিরব। দুমাস বাদে, তারপর–
তুমি আর্মিতে জয়েন করলে?
হ্যাঁ কমিশনড অফিসার—সেকেন্ড লেফটেনান্ট হয়ে।
তা আর্মিতে গেলে কেন?
আর্মিতে ঢোকবার আমার বরাবরের ইচ্ছা তুমি তো জানতে বিপাশা। ওসব কথা থাক তাহলে কালই তোমার বাবাকে বলতে বলি কথাটা আমার বাবাকে?
আমার জবাব তো সেদিনই তোমাকে দিয়ে দিয়েছি আমি—
সে মত তোমার তাহলে এখনও বদলায়নি?
না।
অনন্য বক্সীকেই তাহলে তুমি বিয়ে করছ?
হ্যাঁ।
বিয়ের দিনটাও বোধ হয় ঠিক হয়ে গিয়েছে।
এখনও হয়নি।
একটা কথা বোধ হয় তুমি জান না—অনন্য বক্সীর বাবা পাগল, রাঁচির পাগলা গারদে আজ অনেক বছর ধরে আছেন।
জানি।
জান?
হ্যাঁ, অনন্যই তা আমায় বলেছে—
লোকে কি বলে জান?
লোকে তো লোকের সম্পর্কে অনেক কথাই বলে—সব শুনতে গেলে কি চলে?
অনন্য বক্সীর মায়ের কিসে মৃত্যু হয়েছিল বোধ হয় তুমি জান না—
জানব না কেন? একটা দুর্ঘটনায়—
সে দুর্ঘটনাটা হচ্ছে—ওর বাবা ওর মাকে হত্যা করেছিল!
না, না, এ মিথ্যে কথা–
অনন্য বক্সীকেই জিজ্ঞাসা করে দেখো কথাটা সত্যি কি মিথ্যে! যাক গে আমি যাচ্ছি, আর যাবার আগে একটা কথা বলে যাই—আমি তোমাকে ভুলতে পারব না। আর অন্যের অঙ্কশায়িনী তুমি হলেও প্রতি মুহূর্তে আমার মনে পড়বে—অন্য এক পুরুষ জোর করে তোমার ওপর বলাৎকার করছে, তোমাকে রেপ করছে।
০৫. রজতশুভ্র ঘর থেকে বের হয়ে গিয়েছিল
কথাগুলো বলে রজতশুভ্র ঘর থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। সেদিনকার রজতশুভ্রর সেই কথাগুলোর সঙ্গে কি অপরিসীম ঘৃণা আর আক্রোশ যে জড়িয়ে ছিল, সেটা কি বিপাশা বুঝতে পারেনি?
পেরেছিল। আর তাই যেন সে একেবারে পাথর হয়ে গিয়েছিল।
কথাটা আজও ভুলতে পারেনি বিপাশা—আর সেই কথাটাই যেন আজ বিপাশার মনে পড়েছিল ডাঃ দাশগুপ্তের চেম্বারে বসে তার কথার উত্তর দিতে দিতে হঠাৎ রজতশুভ্রর কথাটা বলতে গিয়ে।
ঐ সঙ্গে বিপাশা বলে এসেছে, কি একটা দুর্ঘটনায় অনন্যর মার, মৃত্যুর কিছুদিন পরেই অনন্যর বাবার মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটে।
ডাঃ দাশগুপ্ত কি দুর্ঘটনা জিজ্ঞাসা করায় সে বলেছে সে জানে না।
রজতশুভ্রর মুখে সেদিন সেই কথাটা শোনবার পর বিপাশার বহুবার মনে হয়েছে, অনন্যকে সে কথাটা জিজ্ঞাসা করবে কিন্তু পারেনি।
একটা সংকোচ—যেন একটা দ্বিধা বার বার তার কণ্ঠ চেপে ধরেছে। সে আজও আশা করে আছে অনন্যই একদিন তাকে মার সব কথা বলবে। কি দুর্ঘটনা হয়েছিল কিভাবে সত্যি সত্যি তার মৃত্যু হয়েছে—আর অনন্য যে বলবেই সে বিষয়েও সে স্থিরনিশ্চিত।
বাইরে আকাশে মেঘ করছে হয়ত বৃষ্টি নামবে। একপশলা বৃষ্টি হলে মন্দ হয় না। বিশ্রী গুমোট চলেছে কদিন ধরে।
একটা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা হাওয়া বিপাশার চোখেমুখে এসে ঝাপটা দেয়—মনে হয় তার দূরে বোধ হয় কোথাও বৃষ্টি নেমেছে। বিপাশা বারান্দা থেকে ভিতরে চলে এল ঘরে। ব্যালকনির দরজাটা বন্ধ করে দিল। মৃদু নীলাভ আলোয় শয্যায় নিদ্রিত স্বামীর মুখের দিকে তাকাল বিপাশা। অনন্য গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
এমনি করে যদি ও ঘুমোতে পারে, যদি ওর ঘুম আজ অন্যান্য রাত্রের মত না। ভাঙে-ভগবান তাই করো, তাই করো–
পায়ে পায়ে শয্যার একেবারে নিকটে এগিয়ে এল।
হঠাৎ অনন্যর ঘুম ভেঙে যায়—ঢং ঢং করে ঘরের দেওয়াল-ঘড়িতে রাত্রি দুটো ঘোষিত হল। চমকে ওঠে বিপাশা।
অনন্য শয্যা থেকে নামছে বিপাশা বুঝতে পারে ওর দিকে তাকিয়েই, অনন্যর চোখে ঘুমের ঘোর—ডাঃ দাশগুপ্তের পরামর্শমতই বিপাশা অন্যান্য রাত্রের মত প্রথমটায় নীরব সাক্ষীমাত্র না থেকে দুহাতে ওর একটা হাত চেপে ধরে বললে, কি কি হল অনন্য—অনন্য, ঘুম থেকে উঠে বসলে কেন অনন্য—অনন্য