কি মনে হয়েছিল?
এই সেই—আমার জীবনপাত্র যার আবির্ভাবে পূর্ণ হয়ে উঠবে, ধন্য হবে। এতদিনে তার দেখা পেলাম।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ বিপাশা, আমার সমস্ত অন্তরাত্মা যেন বার বার সেদিন আমাকে বলতে লাগল, ও আমার ও আমার—ওকে না পেলে আমার সব মিথ্যা। আচ্ছা বিপাশা–
কি?
তোমার কিছুই মনে হয়নি—প্রথম দিন আমাকে দেখে?
না।
কিছুই মনে হয়নি?
তোমার দুচোখের মুগ্ধ দৃষ্টি কেবল—
আর কিছু না? সেই মুগ্ধ দৃষ্টির মধ্যে আর কিছু তুমি খুঁজে পাওনি?
বলতে পারেনি সেদিন বিপাশা এবং কেবল সেইদিনই কেন পরবর্তী কালেও কখনও বলতে পারেনি—তারও মন বলেছিল, কোথায় ছিলে এতদিন তুমি, আসোনি কেন? কেন এত দেরি করে এলে?
বিপাশা সেই প্রথম দিনে প্রথম দর্শনেই অনন্যকে ভালবেসেছিল।
অনন্য, তোমাকে আমি সেই প্রথম দেখার দিন থেকেই ভালবেসেছিলাম, বিপাশা বলেছিল। অনন্য খুব ঘন ঘন তাদের বাড়িতে আসত না, মধ্যে মধ্যে আসত আর আসত যখন তার বাবা নিবারণ চক্রবর্তী বাড়িতে থাকতেন না।
অনন্য যে তাদের বাড়িতে আসে রজতশুভ্রর দৃষ্টি এড়ায় নি এবং একদিন ও আর অনন্য যখন বসে গল্প করছে, হঠাৎ এসে ঘরে ঢুকল রজতশুভ্র। সন্ধ্যা নামছে, আলো নিভে আসছে, বাইরে দরজার গোড়ায় রজতশুভ্রর গলা শোনা গেল, বিপাশা! ডেকেই রজতশুভ্র ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল।
বিপাশা তাড়াতাড়ি উঠে সুইচ টিপে ঘরের আলোটা জ্বেলে দেয়।
এঁকে তো চিনতে পারছি না! রজতশুভ্রর প্রশ্নের মধ্যে যেন একটা অসংশয়ের দাবি স্পষ্ট হয়ে ওঠে, চেয়ে আছে রজতশুভ্র অনন্যর দিকে।
ও অনন্য—অনন্য বক্সী!
দেখিনি তো ওকে আগে এ বাড়িতে কখনও?
বাবার বন্ধুর ছেলে–
হুঁ। বিপাশা, তোমার সঙ্গে আমার একটা কথা ছিল, রজতশুভ্র বললে।
বল না কি কথা–
রজত বিপাশার মুখের দিকে একবার তাকাল, তারপর বললে, ঠিক আছে, কাল সকালে একবার আমাদের বাড়িতে আসবে?
কাল সকালে কলেজ-ফাংশনের রিহার্সেল আছে–সময় হবে না। বিপাশা বললে।
কখন বেরুবে? রজতশুভ্রর প্রশ্ন।
সকাল আটটায়। বিপাশা বললে।
আচ্ছা চলি। রজতশুভ্র ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
অনন্য বললে, তোমাদের কলেজের ফাংশন কবে বিপাশা?
সামনের শনিবার, বিপাশা বললে।
আমায় নিমন্ত্রণ করবে না?
তুমি যদি আমার অভিনয় দেখে হাসো? বিপাশা মৃদু হেসে বললে।
অভিনয় করকে তুমি?
হ্যাঁ, অভিজ্ঞানশকুন্তলম নাটক—
তুমি নিশ্চয়ই শকুন্তলা!
কি করে বুঝলে?
বিপাশার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে অনন্য বললে, আমাকে কিন্তু একটা কার্ড দিয়ে আর টিকিট যদি হয় তো টিকিট কাটব।
টিকিট কাটতে হবে না। কার্ড দেব তোমাকে আমি।
অনন্য উঠে পড়ে। বললে, আজ চলি।
অনন্য কিন্তু রজত সম্পর্কে একটা কথাও জিজ্ঞাসা করেনি। রজতশুভ্র কিন্তু করেছিল দিন দুই পরেই দেখা হতে, খুব বড়লোকের ছেলে বুঝি!
কে? কার কথা বলছ?
ঐ যে অনন্য বক্সী না কে!
তা ঠিক জানি না, তবে শুনেছি ওর ঠাকুর্দা খুব বড় একজন ব্যারিস্টার ছিলেন, প্রচুর ইনকাম। ছিল তার, বালিগঞ্জ সারকুলার রোডে বিরাট বাড়ি।
প্রায়ই যাও সেখানে—তাই না?
এখনও যাইনি। শান্ত গলায় বললে বিপাশা।
কেন, অনন্য বক্সী যাবার কথা বলেননি তোমাকে?
না।
যাক শোন, একটা কথা কয়েকদিন থেকেই তোমাকে বলব বলব ভাবছিলাম—
কি কথা?
আমাদের ব্যাপারটা এবারে পাকা করে ফেলতে চাই। আমি আর্মিতে জয়েন করছি, তাই ব্যাপারটা–
আমাদের ব্যাপার!
হ্যাঁ, বিয়ের ব্যাপারটা–
বিয়ে!
তুমি যেন আকাশ থেকে পড়লে বিপাশা?
কতকটা তাই–
কয়েকটা মুহূর্ত চুপ করে থেকে রজতশুভ্র বললে, যাক গে, এখন মাটিতে পা দিলে—এবার। জবাব দাও আমার কথাটার
কিসের জবাব—কোন কথার?
তোমার বাবার সঙ্গে ভাবছি দেখা করে বলব, কিন্তু তার আগে তোমারও জানা দরকার, তাই
না–
বিপাশা!
হ্যাঁ, বিয়ের কথা আমি এখনও ভাবিনি রজত!
তাইনা আমাকে বিয়ে করতে তোমার অমত?
রজত, ওসব কথা থাক। কথাটা এখানেই থামিয়ে দেবার চেষ্টা করে বিপাশা।
বিপাশা, কথাটা আমার জানা আজ দরকার।
তোমাকে বিয়ে করার কথা আমি ভাবতেই পারছি না।
ভাবতেই পারছ না কেন, জিজ্ঞাসা করতে পারি কি?
কেন আবার কিভাবতে পারছি না তাই বললাম—
অনন্য বক্সীকেই তাহলে তুমি বিয়ে করবে?
ওসব কথা আমাদের মধ্যে কখনও হয়নি আজ পর্যন্ত।
আমি কি তোমার অযোগ্য?
সেকথাও আমি বলিনি—
তবে?
রজত, আমার যা বলার ছিল আমি বলেছি—আর কিছুই আমার বলবার নেই।
কিন্তু আমি কথাটা মন থেকে মুছে ফেলতে পারব না!
রজত, বন্ধুর মত এখানে আসতে পার তো এস, না হলে–
না হলে?
এস না।
তুমি বোধ হয় ভুল করলে বিপাশা—
ভাববার সময় তুমিও পাবে—আমিও পাব–কাজেই কার ভুল সেটা ধরা পড়বেই একদিন!
বেশ।
অতঃপর রজতশুভ্র চলে গিয়েছিল। পনেরো দিন আর আসেনি।
এবং ঐ পনেরো দিনে বিপাশার একবারও রজতশুভ্রর কথা মনে হয়নি।
দেখা হল আরও মাসখানেক পরে।
সেদিনটা আরও বিপাশার বিশেষ করে মনে আছে এই জন্য যে ঠিক ঐদিনই সন্ধ্যার কিছু আগে এসে অনন্য বলেছিল, একটা কথা বলব ভাবছি বিপাশা তোমাকে কয়েকদিন থেকেই–
বিপাশা কয়েকটা মুহূর্ত অনন্যর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপরই মৃদু হেবে বলে, কি কথা?
অনন্য ইতিপূর্বে যা কোন দিনই করেনি, ওর কাছেও খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে আসেনি এবং স্পর্শও করেনি—তাই করল। ও যে সোফাটায় বসেছিল অনন্য ঠিক তার পাশেই সোফাটার উপর এসে ওর একখানা হাত নিজের হাতের মধ্যে তুলে নিয়ে মৃদু কোমল কণ্ঠে বললে, কথাটা কিন্তু কিছু নতুন নয় বিপাশা।