সহসা দুহাতে স্বামীকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে বিপাশা না, না—ওগো না।
০৪. বিপাশা রাত্রে ঘুমোয় না
সেই—সেই রাত্রির পর থেকেই বিপাশা রাত্রে ঘুমোয় না। সারাটা রাত জেগে থাকে। আর প্রায়ই ঘুম থেকে উঠে সোজা সিঁড়ি বেয়ে অনন্য ছাতে চলে যায়-বিপাশা তখন ওর পিছনে পিছনে গিয়ে ধরে আনে। মাঝপথেও অনন্যকে ফিরিয়ে অনাবার চেষ্টা করেছে বিপাশা, কিন্তু পারেনিমত্ত হাতীর শক্তিতে যেন ঐ সময়টা বলীয়ান হয়ে ওঠে অনন্য—ঐ সময়টা অনন্যর কোন জ্ঞানই থাকে না যেন।
সেই থেকেই রাত জাগার অভ্যাস করেছিল বিপাশা। দিনে ঘুমোয় এবং রাত্রে জেগে থাকে। বিপাশা সর্বক্ষণ দুটি চক্ষু মেলে। প্রথম প্রথম অসুবিধা হত—এখন আর হয় না। শেষরাত্রির। দিকে ঘুমায় বিপাশা।
স্বামীর দিকে আবার তাকাল বিপাশা। মনটা যেন তার কি এক মমতায় আপ্লুত হয়ে ওঠে। ঘুমোচ্ছে—গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন অনন্য। পাখার হাওয়ায় মাথার চুলগুলো কপালের ওপর এসে পড়ছে। গভীর স্নেহে বিপাশা অনন্যর ললাটে একটি চুম্বন দিল—আলতো ফাঁক দুটি ওষ্ঠ ওর ললাট স্পর্শ করে। অনন্য জানে না যে বিপাশা ইদানীং সারাটা রাত জেগে অতন্দ্র দৃষ্টিতে তারই দিকে তাকিয়ে থাকে। ঘরের যে দরজাটা দক্ষিণের ব্যালকনির সঙ্গে সংযুক্ত সে দরজাটা খুলে রাখলে চমৎকার হাওয়া আসে ঘরে কিন্তু খুলে রাখে না বিপাশা দরজাটা—ঐ অনন্যর জন্যই। ঘড়ির দিকে তাকাল বিপাশা, রাত সাড়ে এগারোটা। দুটো বাজতে এখনও অনেক দেরি।
রাত দুটোর আগে অনন্যর ঘুম ভাঙবে না। বিপাশা বালকনির দরজাটা খুলে ব্যালকনিতে পা দিল। বিরাট একটা মাধবীলতার ঝাড় নিচ থেকে একেবারে ব্যালকনিতে এসে পড়েছে লতিয়ে।
ব্যালকনিতে পা দিতেই মৃদু একটা ফুলের সুবাস বিপাশার নাসারন্ধ্রে এসে ঝাপটা দেয়। সেই সঙ্গে এক ঝলক দক্ষিণের বাতাস যেন ওর সর্বাঙ্গে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ক্লান্ত দৃষ্টি তুলে বিপাশা তাকালো গেটের বাইরে রাস্তাটার দিকে।
মধ্যে মধ্যে রাত্রির ক্লান্ত মুহূর্তগুলি কাটাবার জন্য যখনই ও এসে ঐ ব্যালকনিতে দাঁড়ায়রাত্রির ঐ রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে থাকে।
গাড়ির চলাচল কমে যায়।
আজ ডাঃ দাশগুপ্তর কথাগুলো বিপাশার আবার মনে পড়ে। ডাঃ দাশগুপ্ত কেন ঐ প্রশ্নটা। করলেন—তারা বিবাহিত জীবনে সুখী কিনা। কেন মনে হল তার ঐ কথাটা? সত্যিই তো তাদের মত সুখী দম্পতিতার তো মনে হয় খুব কমই আছে। আরও জিজ্ঞাসা করছিলেন, ওদের বিবাহের আগে পরস্পরের মধ্যে আলাপ ছিল কিনা!
ওর বাবা নিবারণ চক্রবর্তীর অবিশ্যি এ বিবাহে খুব একটা মত ছিল না এবং সেটা তিনি প্রকাশও করেছিলেন তার কাছে, অনন্য তাকে বিবাহ-প্রস্তাব করবার পর। বলেছিলেন, খুকী, অনন্য আজ বলছিল সে তোকে বিবাহ করতে চায়—
তুমি কি বললে?
হ্যাঁ বা না কিছুই বলিনি। বলেছি—
কি বলেছ?
দুটো দিন ভাববার সময় চাই।
কেন ওকথা বললে?
আমার মনটা কেন জানি ঠিক পুরোপুরি সায় দিচ্ছে না মা এই বিবাহে।
কেন বাবা?
অনন্যর মাথার গোলমাল আছে, তা ছাড়া তার বাপেরও শুনেছি মাথায় বেশ ছি ছিল—
বাবা!
জেনেশুনে একটা পাগলের গুষ্ঠিতে—
অনন্য কিন্তু সম্পূর্ণ স্বাভাবিক—তুমি অমত কোরো না বাবা।
তুই সুখী হবি?
হ্যাঁ বাবা। রজতশুভ্র ছেলেটি—
না, বিয়ে করলে আমি অনন্যকেই করব—আর কাউকে নয়।
নিবারণ চক্রবর্তী অতঃপর আর অমত করেন নি। রজতশুভ্র-রজতশুভ্রর কথা আজ আবার মনে পড়ছে।
ছেলে হিসাবে রজতশুভ্র হয়ত অনন্যর চাইতে খারাপ ছিল না, বরং কোন কোন দিক ববেচনা করলে অনেক ভালই ছিল।
রজতশুভ্রকে বিপাশা পছন্দও করত। অনন্যর সঙ্গে আলাপ হবার অনেক আগে থাকতেই রজতশুভ্রর সঙ্গে বিপাশার আলাপ ছিল। একই পাড়ায় কাছাকাছি বাড়ি থাকায় আসা-যাওয়াও ফিল অনেক বেশী তাদের বাড়িতে রজতশুভ্রর।
অনন্য তাদের গৃহে প্রথম আসার দিনটি মনে পড়ল বিপাশার। তার বাবা সলিসিটার নিবারণ চক্রবর্তী ছিলেন অনিন্দ্য বক্সীর যাবতীয় ব্যবসা ও আইন সংক্রান্ত ব্যাপারে পরামর্শদাতা। অনিন্দ্য বক্সীকে রাঁচীতে রেখে আসার বোধ হয় বছর খানেক পরে একদিন কতকগুলো আইন সংক্রান্ত ব্যাপারে পরামর্শ নেবার জন্যই অনন্য এসেছিল তাদের গৃহে। অনন্যকে সেইদিন সে প্রথম দেখে। অনন্য আর তার বাবা তার ঘরে বসে যখন কথাবার্তা বলছিলেন–কি একটা কাজে বিপাশা তার বাবার ঢুকতেই অনন্য তার দিকে তাকাল।
নিবারণ চক্রবর্তী প্রথমটা বুঝতে পারেন নি, কি একটা কথার জবাব না পেয়ে অনন্যর দিকে তাকাতেই নিবারণ চক্রবর্তী দেখতে পেলেন বিপাশাকে। নিবারণ চক্রবর্তী বললেন, অনন্য, এ আমার মেয়ে বিপাশা। ডিগ্রী কোর্সে থার্ড ইয়ারে পড়ে সামনের বার পরীক্ষা দেবে। খুকী, ওকে তুই দেখিস নি কখনও। আমার যে বন্ধুর কথা তোকে কতদিন বলেছি—অনিন্দ্য বক্সী, তারই ছেলে—একমাত্র ছেলে অনন্য বক্সী।
অনন্য তখনও বিপাশার দিকে চেয়ে ছিল।
পরে একদিন কথায় কথায় অনন্য বলেছিল, উভয়ের মধ্যে আলাপটা জমে ওঠার পর বিপাশার একটি প্রশ্নের জবাবে।
বিপাশা বলেছিল, আচ্ছা প্রথম দিন অমন নির্লজ্জের মত বাবার সামনেই আমার মুখের দিকে চেয়েছিলে কেন?
চেয়ে থাকব না—আমার প্রথম আবিষ্কার!
সে আবার কি? বিপাশা বলেছিল।
জান বিপাশা, তোমাকে দেখার আগে অনেক মেয়েকে দেখেছি—আলাপও হয়েছে, কিন্তু সেদিন তোমাকে দেখামাত্রই যেন মনে হয়েছিল–