রজতশুভ্রর হাবভাবে কথায় বার্তায় সব সময়েই সেটা প্রকাশ হয়েই পড়ত—কিন্তু সতর্ক থাকত বিপাশা সর্বদা, রজতকে কখনও এতটুকু প্রশ্রয় দেয়নি। কথাটা কখনও তার মনেও হয়নি। রজতকেও সে-কথাটা জানিয়ে দিয়েছিল বিপাশা—অনন্যকে ভালবাসে সে, একদিন তাদের বিয়ে হবে। বিপাশার বাবা নিবারণ চক্রবর্তী ছিলেন অনিন্দ্য বক্সীর দীর্ঘকালের বন্ধু—সেই সূত্রেই দুই বাড়ির লোকেদের মধ্যে যাতায়াত ছিল। বিপাশার সঙ্গে ক্রমশ অনন্যর ঘনিষ্ঠতা যখন বেড়ে উঠতে থাকে—নিবারণ চক্রবর্তী কিন্তু একদিন মেয়েকে ডেকে একটা কথা বলেছিলেন। সেদিনের সেই কথাতেই বিপাশা বুঝতে পেরেছিল, অনন্যর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা নিবারণ চক্রবর্তী ঠিক পছন্দ করেন না।
খুকী, একটা কথা অনেকদিন থেকেই তোকে বলব বলব ভাবছি—
কি কথা বাবা?
তুই কি তোর মনস্থির করে ফেলেছিস?
কি বিষয়ে?
অনন্য সম্পর্কে?
হ্যাঁ, আমরা বিয়ে করব।
ঠিকই করে ফেলেছিস যখন—
কি তুমি বলতে চাও বল না বাবা?
না, থাক—
থাকবে কেন, বল?
ওর বাবা কেন পাগল হয়ে গেলেন জানিস?
না, ও কখনও বলেনি সেকথা আর আমিও জিজ্ঞাসা করি না।
জিজ্ঞাসা যখন করিস নি, থাক গে সেকথা—
বাবা!
কি রে?
তোমার কি ইচ্ছা নয় ওর সঙ্গে আমার বিয়ে হয়?
ছেলের মত ছেলে ও, সব দিক দিয়েই সুপাত্র—
তবে?
নিবারণ চক্রবর্তী আর কোন কথা বলেন নি।
কথাটার ঐখানেই সমাপ্তি ঘটেছিল।
আজ মনে পড়ছে বিপাশার, বিয়ের আগে অনন্য তার মায়ের মৃত্যুর কথাটা বলেছিল এবং বলেছিল একদিন কি, এক দুর্ঘটনায় নাকি তার মৃত্যু হয় তার বেশী সেও কিছু বলেনি, ও নিজেও জিজ্ঞাসা করেনি জিজ্ঞাসা করবার কথাও তার মনে হয়নি। কিন্তু আজ ডাঃ দাশগুপ্ত কথাটা জিজ্ঞাসা করেছিলেন কি দুর্ঘটনা। ডাঃ দাশগুপ্তের চেম্বার থেকে ফিরে আসা অবধি সেই কথাটাই কেন না জানি মনে হচ্ছে বিপাশার। কি এমন দুর্ঘটনায় তার শাশুড়ির মৃত্যু হয় আর কেনই বা স্ত্রীর মৃত্যুর কিছুদিন পরেই অনিন্দ্য বক্সী—তার শ্বশুরের মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটল? অনন্য তাকে একদিন কথায় কথায় বলেছিল, বাবা তার মাকে অত্যন্ত ভালবাসতেন—সেরকম ভালবাসা নাকি সচরাচর বড় একটা দেখা যায় না, তাই তিনি স্ত্রীর অকালমৃত্যুর আঘাতটা সহ্য করতে পারেন নি এবং তার মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটে!
অবিশ্বাস করবার মত কিছু নেই কথাটার মধ্যে–হতেও পারে অমন।
অনেকক্ষণ ধরে স্নান করে বিপাশার যেন কেমন শীত-শীত বোধ হয়। বাথরুমে থেকে বের হয়ে এল বড় ভোয়ালেটা গায়ে জড়িয়ে। ঐ অবস্থাতেই শয্যার পাশে গিয়ে স্বামীকে লক্ষ্য করল—অনন্য ঘুমিয়ে পড়েছে। আসলে কোন নতুন ঘুমের ওষুধ দেয়নি বিপাশা অনন্যকে, লিপাটন ক্যাপসুল একটা দিয়েছিল—ডাঃ দাশগুপ্তর পরামর্শ মতই ওষুধের নামটা বলেনি ওকে–ডাঃ দাশগুপ্ত যেমন বলে দিয়েছেন তেমনি বলেছে বিপাশা।
শাড়ি ব্লাউজ পরে বিপাশা এসে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়াল। আবছা নীল আলোতেই সে চিরুনি দিয়ে চুলটা আঁচড়ায়, গায়ে একটু স্প্রে দিল।
ইদানীং রাত্রে বড় একটা ঘুমায় না বিপাশা। রাত দুটোর পরে ঠিক জেগে ওঠে, অনন্য–কয়েকদিন ঘুম-ঘুম চোখেই শয্যা থেকে নেমে সিঁড়ি দিয়ে অনন্য ছাতে উঠে গিয়েছিল। ঐ সময়টা সম্পূর্ণ জ্ঞান থাকে না ওর, তাই ডাক্তারের নির্দেশ ছিল বিপাশা যেন তার স্বামীকে যথাসম্ভব চোখে চোখে রাখে। ঘরের দরজা ভিতর থেকে ওরা বন্ধ করেই শুত।
প্রথম যে-রাত্রে বিপাশা ব্যাপারটা জানতে পারে—হঠাৎ ওর ঘুমটা দরজার লক খোলার শব্দেই ভেঙে গিয়েছিল, ও দেখতে পায় অনন্য শয্যা থেকে নেমে দরজার দিয়ে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলছে; দরজা খুলতে দেখে ও প্রশ্ন করে, দরজা খুলে কোথায় যাচ্ছ অনন্য এত রাত্রে?
স্বামীর দিক থেকে কোন সাড়া এল না।
আবার ও বলে, কি হল, দরজা খুলছ কেন এত রাত্রে?
দ্বিতীয়বারেও স্বামীর দিক থেকে কোন সাড়া না পেয়ে ও সঙ্গে সঙ্গে শয্যা থেকে উঠে পড়ে, অনন্য ততক্ষণ দরজা খুলে বের হয়ে গিয়েছে ঘর থেকে।
বিপাশা রীতিমত বিস্মিত হয়। স্বামীর পিছনে পিছনে বিপাশাও ঘর থেকে বের হয়ে আসে।
হাত পাঁচেক দূরে অনন্য।
অনন্য সিঁড়ির দিকে চলেছে এগিয়ে পায়ে পায়ে। কেমন যেন শ্লথ মন্থর গতি চলার। পা যেন ঠিক সমতালে পড়ছে না।
পিছন থেকে আবারও ডাকে বিপাশা, অনন্য-অনন্য!
অনন্য সাড়া দেয় না। অনন্য সোজা সিঁড়ি দিয়ে তিনতলায় উঠতে থাকে।
এত রাত্রে তিনতলায় কি করতে যাচ্ছে অনন্য? নিঃশব্দে অনুসরণ করে বিপাশা অনন্যকে।
অনন্য একটার পর একটা সিঁড়ি ভেঙেই চলেছে উপরের দিকে তিনতলা থেকে চারতলা তারপর ছাত। ছাতে পৌঁছে অনন্য সোজা রেলিংয়ের দিকে এগিয়ে চলে।
রেলিংয়ের উপরে ভর দিয়ে অনন্য নিচের দিকে ঝুঁকে পড়তেই বিপাশা যেন ঝাঁপিয়ে পড়ে অনন্যকে দুহাতে বুকের মধ্যে জাপটে ধরে চেঁচিয়ে ওঠে, অনন্য?
অনন্যর শরীরে তখন যেন মত্ত হাতির শক্তি। দুহাতে প্রাণপণে বুকের ওপরে জাপটে ধরে বিপাশা চেঁচায়, অনন্য—অনন্য? কি–কি করছ–কি হয়েছে?
কে?
আমি—আমি বিপাশা।
বিপাশা!
হ্যাঁ!
ছাতে কেন?
তুমিই তো এলে। চল নিচে।
চল—
নিচে চলে আসে দুজনে।
খাটের ওপর বসে অনন্য। বলে, জল দাও।
এক গ্লাস জল পান করে একচুমুকে অনন্য যেন কতকটা সুস্থ হয়।
কি হয়েছিল—উপরে ছাতে গিয়েছিল কেন?
সেই কুয়াশাটা— কুয়াশা!
হ্যাঁ, সেই কুয়াশাটা যেন আমাকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যাচ্ছিল—সেই দড়ির ফাঁসটা যেন আমার গলায় চেপে বসেছিল আর—সেই কণ্ঠস্বর আমাকে আমাকে বোধ হয় শেষ পর্যন্ত গলায় ফাঁস দিয়েই মরতে হবে বিপাশা–