ড্রাইভার রতন সিং গাড়ি চালাচ্ছিল।
পিছনের সীটে পাশাপাশি বসেছিল অনন্য আর বিপাশা। বিপাশার একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে টেনে নিয়ে অন্ধকারে অনন্য বিপাশার সরু সরু নরম নরম আঙুলগুলো নিয়ে খেলা করছিল নিঃশব্দে আপন মনে।
বিপাশা!
বল।
আমার এই ব্যাধি কি কোন দিনই সারবে না?
কেন সারবে না—ডাঃ দাশগুপ্ত অত বড় ডাক্তার—দেখো তুমি, ঠিক সুস্থ হয়ে উঠবে।
আচ্ছা উনি তো ঘুমের একটা ওষুধ দেবেন বলছিলেন—লিখে দিলেন না?
আমাকে বলে দিয়েছেন।
দিয়েছেন?
হ্যাঁ।
ওষুধটা তাহলে দোকান থেকে নিয়ে নাও না।
দরকার হবে না আজই, আমাকে দুটো ক্যাপসুল দিয়ে দিয়েছেন–বলেছেন আজ আর কাল খাবার পর পরশু সকালে ফোনে জানাতে।
কিছুই হবে না—দেখো ঠিক রাত দুটোয় ঘুম ভেঙে যাবে।
না, দেখো ভাঙবে না।
তুমি জান না বিপাশা—আমি জানি ঘুম ঠিক ভেঙে যাবে, আর সেই কুয়াশাটা চারপাশ থেকে অক্টোপাসের মত অষ্টবাহু মেলে আমাকে তার কুক্ষিগত করবে। তারপর সেই চাপা ফিসফিস কণ্ঠস্বর—যাও, যাও—এগিয়ে যাও–
না, কিছু আর হবে না দেখো, বিপাশা জোরগলায় যেন বলে কথাটা।
বিপাশা!
কি! একটা কথা এতদিন তোমায় কখনও বলিনি, আজ বলছি—
কি কথা?
আমি–আমিও বোধ হয় শেষ পর্যন্ত বাবারই মত—
ছিঃ, কি আবোল-তাবোল চিন্তা কর বল তো!
আবোল-তাবোল নয়, আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি ধীরে ধীরে আমি সেই দিকেই এগিয়ে চলেছি—টু দ্যাট এন্ড–
ফের ঐসব আজেবাজে কথা যদি তুমি বল, আমি আর তোমার সঙ্গে কথা বলবো না।
রাগ করো না বিপাশা—আমার ওপরে তুমি রাগ করো না, তুমি রাগ করলে আমি কোথায় যাব!
কেন তুমি ঐসব তাহলে বল?
আর বলব না।
ওদের গাড়িটা একসময় এসে গেট দিয়ে ঢুকে পোর্টিকোর সামনে দাঁড়াল। দারোয়ান রামভরোসে এগিয়ে এল।
সাব—
কি হয়েছে?
একজন সাহেব সন্ধ্যের দিকে এসেছিলেন—
কে–কি নাম–কিছু বলেছে?
না। কেবল আপনার আর মাঈজীর খোঁজ করছিলেন—
বসতে বললি না কেন? অনন্য বলল।
বলেছিলাম কিন্তু বসলেন না, বললেন, আবার আসবেন।
অনন্য শুধায়, কিরকম দেখতে সাহেবকে?
খুব লম্বা-চওড়া চেহারা, চোখে চশমা, মুখে পাইপ—
ঠিক আছে, তুম গেট বন্ধ কর দো।
রামভরোসে চলে গেল সেলাম জানিয়ে।
ওদের আসার সাড়া পেয়ে পুরাতন ভৃত্য পরেশ এসে দরজা খুলে ইতিমধ্যে দাঁড়িয়েছিল।
দুজনে ভিতরে প্রবেশ করল।
০৩. চারতলা এই বিরাট বাড়ি
চারতলা এই বিরাট বাড়িটায় স্বামী-স্ত্রী ছাড়া ঠাকুর-চাকর-আয়া জনা পাঁচেক ছিল। চাকরবাকরেরা নিচের তলাতেই কিছুটা অংশ অধিকার করে আছে। তাছাড়া নিচের তলায় বিরাট। একটা হলঘরের মত—তার এক পাশ দিয়েই চারতলা পর্যন্ত সিঁড়িটা উঠে গিয়েছে, হলঘরটার মধ্যে ঢুকলেই চারপাশে চোখে পড়ে স্টাফ করা কতকগুলো জন্তুজানোয়ার—বাঘ, রয়েল বেঙ্গল, চিতা আর শিংওয়ালা হরিণ। অরিন্দম বক্সীর শিকারের সখ যেমন ছিল, রাইফেল চালাতেও তেমনি ছিলেন তিনি সুদক্ষ। জীবনে অনেক শিকার করেছেন তিনি। আর তারই স্মৃতিচিহ্ন ঐ বাড়িটার মধ্যে চারিদিকে ছড়ানো। হঠাৎ ঐ হলঘরে, বিশেষ করে রাত্রিবেলা প্রবেশ করলে গা যেন কেমন ছমছম করে ওঠে। বিরাট বিরাট জানালাগুলো সব সময়ই প্রায় বন্ধ থাকায় দিনের বেলাতেও সেখানে একটা আলোছায়ার লুকোচুরি চলে যেন। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠলে একটা চওড়া বারান্দা—তার সংলগ্ন পাশাপাশি খানচারেক বড় সাইজের ঘর এবং মধ্যে একটি হলঘর। ঐ দোতলার হলঘরটিই অরিন্দম বক্সীর পারলার ছিল। সেকেলে মেহগনি পালিশ সেগুন কাঠের ভারী ভারী সব ফার্নিচার বিরাট একটি টেবিল ডিম্বাকৃতি, ভারী ভারী খানকয়েক সেকেলে চেয়ার গদীমোড়া। তারই একপাশে অনন্য বক্সীর বাবা অনিন্দ্য বক্সী বার কাউন্টার তৈরি করেছিলেন। কাউন্টারের দুপাশে কাঁচের আলমারিতে এখনও কিছু বোতল সাজানো আছে—হুইস্কি, ব্র্যান্ডি, শেরি, বার্গন্ডি।
অনিন্দ্য বক্সীকে রাঁচী মেনটাল হাসপাতালে স্থানান্তরিত করার পর থেকে ঐ আলমারি দুটো আর খোলা হয় না-চাবি দেওয়াই আছে। মেঝেতে পুরু কার্পেট বিছানো। অনন্য ঐ ঘরে বড় একটা ঢোকে না—ঢোকবার তার প্রয়োজনও হয় না। পুরাতন ভৃত্য পরেশ প্রত্যহ ঐ ঘরটা ও ফার্নিচারগুলো ঝাড়পোঁচ করে, তাই সব ঝকঝক করে। অনন্য ও বিপাশার পিছনে পিছনে। পরেশও সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে আসে। দোতলায় খান-দুই ঘর নিয়ে স্বামী-স্ত্রী থাকে। একটা বেডরুম, অন্যটা তাদের সিটিংরুম। সিটিংরুমটা অনন্য আধুনিক কিছু ফার্নিচার কিনে সাজিয়ে নিয়েছিল। অন্য একটি ঘরে অনিন্দ্য লাইব্রেরি করেছিলেন। আলমারি ভর্তি সব দেশী-বিলাতী লেখকদের বই আর অনিন্দ্যর আইনের বই। ঐ লাইব্রেরি ঘরটাও বন্ধ থাকে সর্বদা। অন্য ঘরটিকে অনন্য ডাইনিংরুম করেছিল। তিনতলা ও চারতলার ঘরগুলো সবর্দা তালাবন্ধই থাকে। বিপাশা এ বাড়িতে আসবার পর মধ্যে মধ্যে ঘরগুলো খুলে ঝেড়ে ঝেড়ে পরিষ্কার করে রাখে পরেশকে দিয়ে। বাড়ির পশ্চাৎদিকে কিছুটা জমি আছে নানা গাছগাছালি আছে সেখানে। সামনের অংশে ছোট্ট একটি লন মত। সেখানেও কিছু ফুলের গাছ আছে—মালী নিতাই সব দেখাশুনা করে।
অনন্য ও বিপাশা এসে তাদের ঘরে ঢুকল।
পরেশ বললে, মা, গরম জল দেব কি বাবুর বাথরুমে?
বিপাশা বললে, হ্যাঁ, দাও।
ঐদিনই রাত্রির আহার শেষ করে অনন্য গিয়ে শয়নঘরের সংলগ্ন ব্যালকনিতে বসে ছিল একটা বেতের চেয়ারে। বিপাশা শাড়ি বদল করে সেখানে এসে স্বামীর পাশে দাঁড়াল। মেন গেটের বাইরে সামনের রাস্তাটা ঐ ব্যালকনি থেকে অনেকটা চোখে পড়ে। রাত দশটা মত হবে—রাস্তার ইলেকট্রিক আললাগুলো দেখা যাচ্ছে। মধ্যে মধ্যে একটা-আধটা গাড়ি এদিক থেকে ওদিকে ছুটে যাচ্ছে।