দেব।
আপনাদের বিবাহিত জীবন কেমন?
আমরা খুব সুখী দম্পতি। উনি আমাকে অত্যন্ত ভালবাসেন।
সেটা তো বুঝতেই পেরেছি। আচ্ছা বিয়ের আগে আপনাদের পরস্পরের মধ্যে আলাপ পরিচয় ছিল কি?
হ্যাঁ, ওকে আমি চার বছর ধরে জানি—
তার মানে আপনারা পরস্পর পরস্পরকে চার বছর ধরে জানেন?
হ্যাঁ।
খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল আপনাদের মধ্যে, তাই না?
তা ছিল বৈকি—
একটা অত্যন্ত ডেলিকেট প্রশ্ন করব—
বেশ তো করুন।
বিয়ের আগে আপনাদের পরস্পরের মধ্যে মানে বুঝতেই পারছেন কি আমি জানতে চাই–
বুঝেছি–হ্যাঁ, আমরা তো জানতামই পরস্পর পরস্পরকে বিবাহ করব, তাই–কিন্তু তা হলেও আপনি যেটা মীন করছেন, দেহের দিক থেকে সেরকমের ঘনিষ্ঠতা কখনও আমাদের মধ্যে বিয়ের আগে হয়নি—
হয়নি?
না। ওর ধ্যান-ধারণাটা ঠিক আর দশজন পুরুষের মত নয়, ও বলত—
কি?
দেহের শেষপ্রান্তে উপনীত হয়ে পরস্পর পরস্পরের মধ্যে যে জানাজানি একজন পুরুষ ও স্ত্রীলোকের মধ্যেও বলত, বিয়ের আগে সেটা কাম্য নয়, আনন্দেরও নয়—
কেন?
ওর ধারণা ছিল—তাহলে তো পরস্পর পরস্পরকে জানার আর কিছুই বাকি রইল না। দেহের দিক থেকে দেউলিয়া হয়ে যাবার মত বিয়ের আগে নির্বুদ্ধিতা নাকি আর কিছু নেই।
ডাঃ দাশগুপ্ত বিপাশার কথাগুলো শুনে মৃদু মৃদু হাসছিলেন। এবং এবারে সম্পূর্ণ অন্য প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা মিসেস বক্সী, ঐ মিঃ বক্সী ছাড়া আপনার আর কোন পুরুষ-বন্ধু মানে আর কারও সঙ্গে জানাশোনা ছিল না বিয়ের আগে?
হ্যাঁ, ছিল—
কে সে?
রজতশুভ্র–ভবানীপুরে আমাদের পাড়াতেই থাকত—তার সঙ্গেও খুব ঘনিষ্ঠ ভাবে মিশেছি আমি একসময়।
অনন্যবাবু সেটা জানতেন?
জানতেন বৈকি।
রজতশুভ্রকে নিয়ে কোনদিন কোন কথা আপনার স্বামী বলেন নি?
না।
বুঝতে পারছি আপনার প্রতি অনন্যবাবুর বিশ্বাস খুব গভীর ছিল। আচ্ছা, আপনার স্বামীর আপনি ছাড়া অন্য কোন বান্ধবী ছিলেন?
বলতে পারব না।
মানে–জানেন না?
ছিল না বলেই আমার মনে হয়, আর থাকলে সেটা নিশ্চয়ই আমি জানতে পারতাম।
ওঁর আর কোন ভাই বোন আছেন?
না, বাপ-মায়ের ও একই ছেলে—
ওর মা-বাবা বেঁচে আছেন?
মা নেই আর ওর বাবা-মানে আমার শ্বশুরমশাই—বিপাশা হঠাৎ যেন থেমে গেল।
বলুন?
আমার শ্বশুরের মাথার গোলমাল আছে শুনেছি—
পাগল?
হ্যাঁ, রাঁচীতে মেন্টাল অ্যাসাইলামে আছেন—
কতদিন হবে?
শুনেছি আমার শাশুড়ির মৃত্যুর পরই ওঁর মাথার গোলমাল দেখা দেয়—একটা কথা আপনাকে বোধ হয় বলা আমার উচিত ডাঃ দাশগুপ্ত, আমার শাশুড়ির মৃত্যুর ব্যাপারটা ঠিক স্বাভাবিক নয়, যতদূর আমি শুনেছি–
কি হয়েছিল তাঁর–মানে কিসে মৃত্যু হয় আপনি নিশ্চয়ই জানেন!
বিশদভাবে ঠিক জানি না ব্যাপারটা–
জানেন না?
না। এইটুকু শুধু জানি—মানে ওর মুখেই একদিন শুনেছিলাম—বলতে বলতে বিপাশা যেন ইতস্তত করে থেমে যায়।
বলুন—থামবেন না!
আমার শাশুড়ির নাকি কি একটা দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছিল।
দুর্ঘটনা!
হ্যাঁ। অসাধারণ সুন্দরী ছিলেন নাকি আমার শাশুড়ি, ওর যখন বছর দশ এগারো বয়েস তিনি দুর্ঘটনায় মারা যান।
কি হয়েছিল ঠিক জানেন কিছু?
না।
আপনার স্বামীকে কথাটা কখনও জিজ্ঞাসা করেন নি?
না।
কেন?
কারণ বুঝতে পেরেছিলাম, মায়ের অস্বাভাবিক মৃত্যুটা ওর মনের মধ্যে একটা প্রচণ্ড আঘাত, হেনেছিল। তাই পারতপক্ষে ওর মার সম্পর্কে কখনও কোন প্রশ্নই আমি করিনি।
ডাঃ দাশগুপ্ত যেন কি ভাবছিলেন, আর কোন প্রশ্ন করলেন না।
বিপাশা প্রশ্ন করল, ডাঃ দাশগুপ্ত!
বলুন।
আমার স্বামী আবার আগের মত সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে উঠবেন তো?
মনে তো হয়—
মনে তো হয় বলছেন কেন?
কথাটা কি জানেন মিসেস বক্সী, ওঁর, মানে আপনার স্বামীর মনের মধ্যে কোন কিছুর প্রতিক্রিয়া খানিকটা কুয়াশার মত ঝাপসা হয়ে আছে—যে কুয়াশাটা উনি কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারছেন না, সেটার ঠিক ঠিক বিশ্লেষণে না পৌছানো পর্যন্ত—অবিশ্যি আমি চেষ্টা করব, যাতে উনি আবার আগের মত সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারেন তবে আপনার স্বামীর কোঅপারেশন চাই সর্বাগ্রে এবং শুধু ওঁর নয়, আপনারও–
আমাকে কি করতে হবে বলুন?
কেসটা আমাকে একটু ভাবতে দিন মিসেস বক্সী, দিন পনেরো পরে আবার আসবেন আপনার স্বামীকে নিয়ে কিছুদিন পর পর আমি ওঁকে নিয়ে সিটিং দেবো!
আসব।
অতঃপর আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর ডাঃ দাশগুপ্তর নিকট হতে বিদায় নিয়ে বিপাশা ওঁর ঘর থেকে বের হয়ে এল।
০২. ওল্ড বালিগঞ্জ সারকুলার রোডে
ওল্ড বালিগঞ্জ সারকুলার রোডে একটা আটতলা ফ্ল্যাটবাড়ির পাশেই বক্সীর বাড়ি। চারতলা বাড়ি। বাড়িটা তৈরি করেছিলেন অনন্য বক্সীর বাবার বাবা অরিন্দম বক্সী বার-এট-ল। অরিন্দম বক্সী ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের একজন নামজাদা ব্যারিস্টার। প্রচুর ইনকাম ছিল তাঁর। এক মেয়ে এক ছেলে—অনন্য বক্সীর বাবা অনিন্দ্য বক্সী আর শ্রীমতী।
অনন্য বক্সীর বাবা অনিন্দ্য বক্সীও বিলাত গিয়েছিলেন ব্যারিস্টারি পড়তে, কিন্তু ব্যারিস্টার হয়েই ফিরে এসেছিলেন কয়েকটা বছর সেখানে স্ফুর্তি করে। অবিশ্যি ব্যারিস্টারি পাস করবার প্রয়োজনও ছিল না তার কারণ বাপের ঐ বাড়ি ছাড়াও প্রচুর ব্যাঙ্ক-ব্যালেন্স ছিল এবং সেটা একজনের পক্ষে যথেষ্ট। অনন্যর মা প্রতিমা নামেও প্রতিমা ছিলেন, দেখতেও যেন প্রতিমার মত—যে কলেজে পড়তেন প্রতিমা, সেখানকার কলেজ-বিউটি ছিলেন তিনি।
অনিন্দ্য বক্সীর হবি ছিল গলফ আর পিংপংকলকাতা শহরের একটা নামজাদা ক্লাবের মেম্বার ছিলেন তিনি। অবিশ্যি সবই পরে ডাঃ দাশগুপ্ত একটু একটু করে প্রশ্ন করে করে অনন্য বক্সীর মুখ থেকেই শুনেছিলেন। আরও একটা ব্যাপার, অনিন্দ্য বক্সীর নেশা ছিল মদ্যপান। স্কচের একজন যাকে বলে কনোসিয়োর ছিলেন তিনি। বাড়ির মধ্যেই একটা বার তৈরি করেছিলেন। ক্লাবে তিনি কিন্তু মদ্যপান করতেন না—মদ্যপান করতেন গৃহে ফিরে। এবং একা নয়—সে সময় তার সঙ্গিনী হতেন তার স্ত্রী প্রতিমা। প্রতিমা অবিশ্যি দু-এক পেগের বেশী কোনদিনই পান করতেন না, কিন্তু মধ্যরাত্রি পর্যন্ত চালিয়ে যেতেন অনিন্দ্য বক্সী।