না।
তবে?
সে রজতকে মৃত দেখে সঙ্গে সঙ্গে ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে যায়-অনন্য নির্দোষ।
আপনারা—তাহলে কি আপনারাই দুজনে মিলে—
হ্যাঁ, আমরাই তখন দুজনে পরামর্শ করে রজতের মৃতদেহটা ধরাধরি করে ব্যালকনি থেকে নীচে ফেলে দিই—
অথচ আপনি জানেন না, জানতেও পারেন নি রজতবাবু তখনও বেঁচেই ছিলেন।
বেঁচে ছিল রজত? নানা, তা হতেই পারে না।
হ্যাঁ, বেঁচে ছিলেন।
আমি—আমিই তাহলে রজতকে হত্যা করেছি, কারণ আমারই পরামর্শে বকুল সম্মত হয়ে আমাকে সাহায্য করেছিল-রজতকে ব্যালকনি থেকে নীচে ফেলে দিতে–
আমার মতে কিন্তু তা নয়—
বিপাশা স্তব্ধ অনড় হয়ে বসেছিলেন।
তাঁর দিকে তাকিয়ে কিরীটী বললে, আপনি চেয়েছিলেন রজতবাবুর হাত থেকে মুক্তি বিপাশা দেবী, আর বকুল দেবী চেয়েছিলেন তাঁর প্রগাঢ় ভালবাসার প্রতি রজতবাবু যে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন তার সঙ্গে প্রেমের একটা অভিনয় করে চলেছিলেন এতদিন ধরে, তার বদলা নিতে ক্রোধে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে। আপনারা হয়ত রজতের দেহটা নীচে ফেলে দেবার পরামর্শও করেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফেলতে পারেননি—দুজনে আপনারা রজতকে ঐ অবস্থায় ঘরের মধ্যে ফেলে রেখে ঘর থেকে বের হয়ে গিয়েছিলেন—
বিপাশা যেমন স্তব্ধ হয়ে বসেছিল, তেমনিই বসে রইল।
হঠাৎ কিরীটী বললে, চল সুদর্শন!
সুদর্শন একটা কথাও বলল না, কিরীটীর নির্দেশমত উঠে দাঁড়াল। দুজনে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
আর বিপাশা যেমন বসেছিল তেমনি বসে রইল।
জীপে উঠে সুদর্শন প্রশ্ন করল, কে তাহলে রজতের অচৈতন্য দেহটা ব্যালকনি দিয়ে নীচে ফেলে দিল দাদা?
কিরীটী মৃদু হেসে বললে, এখনও বুঝতে পারনি!
না।
বোঝা উচিত ছিল—আগাগোড়া সমস্ত ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখ, দেখবে হত্যাকারী কে–
সত্যি বলছি, এখনও ব্যাপারটা দুর্বোধ্য ঠেকছে দাদা। তবে কি অনন্যবাবুই পরে আবার ফিরে এসে—
না।
তবে? কে ফেলল নীচে রজতবাবুর দেহটা?
মনে কর না, ব্যাপারটা নিছক একটা সুইসাইড ছাড়া আর কিছুই নয়। তিনি সুইসাইড করে বিপাশাকেও মুক্তি দিয়ে গিয়েছেন এবং হয়ত সেই সঙ্গে অনন্যবাবুর কমপ্লেকস যেটা তার বাপমার ব্যাপারকে কেন্দ্র করে উঠেছিল, সেটারও অবসান করে দিয়ে গিয়েছেন—
কি রকম?
এবারে হয়ত অনন্যবাবু বুঝতে পারবেন, বিপাশা তাকে সত্যিই ভালবাসেন। রজতবাবু তাঁর জীবনের পাতা থেকে একেবারে মুছে গিয়েছে চিরকালের মত। এবং বকুল দেবীও একটা শয়তানের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে বেঁচে গেছেন।
কিন্তু তাহলে কি রিপোর্ট দেবেন?
এটা একটা সুইসাইড—আমি তাই বলব।
তাহলে বিপাশা ও বকুল দেবী
না, ওঁরাই ধরাধরি করে রজতের অচৈতন্য দেহটা ব্যালকনি থেকে নীচে ফেলে দিয়েছিলেন–
তাহলে ঐ কথা আপনি বললেন কেন?
সুদর্শন, কেন যে ও-কথা বলে এলাম, আজ তুমি না বুঝলেও একদিন হয়ত বুঝতে পারবে বুঝতে পারবে ঐ কথা বলা ছাড়া কিরীটী রায়ের সামনে আর দ্বিতীয় কোন পথ ছিল না।
প্রৌঢ় বয়সে পৌঁছে বুঝতে পারছি, সব কিছুর উপরে একজন আছেন–তিনি যেমন পাপীকে শাস্তি দেন, তেমনি ক্ষমাও করেন পাপীকে। তার এক চোখে অনুশাসনের প্রতিজ্ঞা, অন্য চোখে ক্ষমার অশ্রু। ভুলে যাও–ভুলে যাও সব ব্যাপারটা—
দাদা, এতদিন জানতাম কিরীটী রায়ের কাছে অন্যায়ের পাপের কোন ক্ষমা নেই কিন্তু আজ বুঝলাম, এত বড় ক্ষমা বোধ হয় একমাত্র কিরীটী রায়ের পক্ষেই সম্ভব।
ওরে না না—আমিও মানুষ—দোষ-গুণ-ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়েই তোমাদের কিরীটী রায়।
গাড়ি তখন কিরীটী বাড়ির সামনে পৌঁছে গিয়েছে।
কিরীটী গাড়ি থেকে নেমে গেল।
আকাশে ত্রয়োদশীর চাঁদ মৃদু আলোর ঝরনা দিয়ে যেন পৃথিবীকে স্নান করিয়ে দিচ্ছিল।