বকুল পূর্ববৎ নীরব।
হ্যাঁ–আপনাকে দেখেই আমি চিনতে পেরেছিলাম। কিরীটী আবার বললে।
হ্যাঁ—আমি শনিবার সন্ধ্যায় প্লেনেই এসেছি–মিনমিন গলায় বকুল বললে।
তারপর বোধ হয় সোজা এখানে আসেন, রজতবাবুর সঙ্গে দেখা করতে–অবশ্য সবটাই আমার অনুমান।
না।
কি, না?
আমি পরের দিন দশটায় এখানে আসি।
কেন, আপনি তো জানতেন রজতবাবু এখানে আছেন! আপনার আগেই এসে পৌঁছে যাচ্ছেন। তবে সেদিনই এলেন না কেন? তার জন্যই তো কলকাতায়—তাই নয় কি–
বকুল আবার চুপ। মুখে কোন কথা নেই।
বকুল দেবী, আপনার ডান হাতের কবজিতে ছোট্ট একটুকরো অ্যাড়হিসিভ প্ল্যাস্টার লাগানো আছে দেখছি—কি হয়েছে, কেটে গেছে বুঝি কবজির কাছে?
হ্যাঁ—মানে—
তা কেমন করে কাটল? কিসে কাটল? হাতে তো দেখছি—এক হাতে একগাছা লাল রংয়ের—বোধ হয় প্ল্যাস্টিকের চুড়ি, অন্য হাতের চুড়িটা কোথায় গেল?
অন্যটা ভেঙে গেছে আজ সকালে বেসিনে হাত ধুতে গিয়ে—
কিরীটী পকেট থেকে লাল প্লাস্টিকের ভাঙা চুড়ির অংশটা কাগজের মোড়ক খুলে বের করে বললেন, দেখুন তো বকুল দেবী, এটা আপনার সেই ভাঙা চুড়িরই অংশ কিনা!
বকুলের দুচোখের দৃষ্টি ভাঙা প্লাস্টিকের চুড়ির অংশটার প্রতি স্থিরনিবদ্ধ। বকুল যেন একেবারে বোবা হয়ে গিয়েছে।
এটা কোথায় পাওয়া গিয়েছে জানেন বকুল দেবী, এই ঘরেরই মেজেতে—আর কবে এটা পাওয়া গিয়েছে জানেন, সোমবার সকালে ঘর ঝাঁট দেবার সময় মেজেতে। বকুল দেবী, এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন—আপনি আপনার চুড়িটার ভাঙা সম্পর্কে যা বললেন এইমাত্র, সেটা সত্য নয়! এবারে বলুন, কখন কেমন করে চুড়িটা আপনার ভেঙেছিল?
বকুল পূর্ববৎ স্তব্ধ।
এই ভাঙা চুড়ির টুকরা কি প্রমাণ করছে জানেন?
কিরীটীর কণ্ঠস্বর ঋজু ও কঠিন। সে বলতে লাগল, আপনি পরের দিন সকাল দশটা সাড়ে দশটায় নয়, অনুমান যদি আমার মিথ্যা না হয় তো—আপনি শনিবার রাত্রেই কোন এক সময় এই ফ্ল্যাটে এসেছিলেন–
না, না,—একটা চাপা আর্তনাদ যেন বের হয়ে এল অকস্মাৎ বকুলের কণ্ঠ চিরে।
হ্যাঁ, এসেছিলেন—আপনি এসেছিলেন সেই শনিবার রাত্রেই সত্যকে অস্বীকার করে কোন লাভ হবে না। সত্যকে চাপা দেবার চেষ্টা করলেও তা প্রকাশ পাবেই।
হ্যাঁ–হ্যাঁ—অস্ফুট চিৎকার করে বকুল বলে ওঠে, হ্যাঁ এসেছিলাম বকুলের সর্বশরীর তখন থর থর করে কাঁপছে।
রজতবাবুকে আপনি ভালবাসতেন—
বাসতাম। বাসতাম কিন্তু আমি জানতাম না—জানতে পারিনি মানুষটা এত নীচ—একটা জানোয়ারজানেন সে আমাকে একলা ফ্ল্যাটের মধ্যে পেয়ে হঠাৎ সে আমার উপরে বলাৎকার করবার চেষ্টা করে, আমি প্রাণপণে বাধা দেবার চেষ্টা করি—শেষটায় আমার এক প্রচণ্ড ধাক্কায় সে গিয়ে ছিটকে পড়ে সোফার ধারে লাগে মাথায়, জ্ঞান হারায়, আমি—আমি তখন তার গলায় যে কারে বাঁধা মাদুলীটা ছিল সেটা তার গলায় ফাঁস লাগিয়ে তার শ্বাসরোধ করি—
হত্যা করলেন শ্বাসরোধ করে তাকে?
হ্যাঁ–হত্যা করে আমি বের হয়ে যাই—মৃতদেহটা মেঝের ওপর পড়ে থাকে।
কিন্তু আপনি জানেন না বকুল দেবী–রজতবাবুর তখনও মৃত্যু হয় নি—হি ওয়াজ সিম্পলি অ্যানকনসাস—নট ডেড!
না–না, সে মরে গিয়েছিল। আমি জানি সে মরে গিয়েছিল শ্বাসরুদ্ধ হয়ে।
না, তার মৃত্যু ঘটে ওপর থেকে নীচে কমপাউন্ডে ফেলে দেবার জন্য এই চারতলা থেকে–
বিশ্বাস করুন কিরীটীবাবু, আমি তাকে ফেলে দিইনি নীচে–
আমি তা বিশ্বাস করি, কিরীটী শান্ত গলায় বললে, সেটা আপনার পক্ষে আদৌ সম্ভবপর ছিল না। অত বড় একটা লাশকে তুলে নিয়ে ব্যালকনি থেকে নীচে ফেলে দেওয়া আপনার ক্ষমতায় কুলাত না—
সুদর্শন ঐ সময় বললে, তবে কে-কে ফেলে দিল নীচে রজতবাবুর অচৈতন্য দেহটা ব্যালকনি থেকে নীচের কমপাউন্ডে?
বকুল দেবী ননস্যাম ওয়ান এলস্। অন্য অন্য কেউ।
পঞ্চানন কি? সুদর্শনের প্রশ্ন।
না। সে তো সেসময় ছিলই না—আমি তার মুভমেন্টস্ খোঁজ করে জেনেছি সে নয়। তবে কে বকুল দেবী জানেন সেটা উনিই বলুন কে সে? কিরীটী বললে।
আমি–জানি না।
জানেন। জানেন আপনি বকুল দেবী, বলুন কে—কে সে?
আমি চলে গিয়েছিলাম জানি না–
জানেন আপনি—আপনি সব দেখেছেন সেরাত্রে পরের ব্যাপারটা, কারণ আপনি তারও পরে এখান থেকে গিয়েছিলেন—
জানি না আমি জানি না। বকুল সহসা কান্নায় ভেঙে পড়ল।
কিরীটী কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। বকুল কাঁদছে সোফার ওপরে উপুড় হয়ে পড়ে।
চল সুদর্শন—কিরীটী বললে।
দাদা–
হ্যাঁ চল–লিভ হার অ্যালোন, লেট হার ক্রাই!
কিরীটী আর সুদর্শন ঘর থেকে বের হয়ে এল এবং নীলাকাশে পুলিশের প্রহরা রেখে এসে জীপে উঠে বসল।
জীপ ছেড়ে দিল। দুজনাই চুপ।
১২. আকাশে ত্রয়োদশীর চাঁদ
দাদা–সুদর্শন ডাকল।
কি, বল।
বকুল দেবীই তাহলে হত্যাকারিণী রজতবাবুর?
না।
কিন্তু–
বকুল দেবীর অবিশ্যি ধারণা শ্বাসরোধেই রজতশুভ্রর মৃত্যু ঘটেছে, কিন্তু তা নয়। জ্ঞান হারিয়েছিলেন মাত্র রজতশুভ্র-বকুল দেবী উত্তেজনার মাথায় রজতবাবুর গলার কারটা দিয়ে তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করতে চাইলেও রজতবাবুর মৃত্যু তাতে ঘটেনি।
তাহলে কে সে—কে হত্যাকারী?
বকুল দেবী রজতবাবু অজ্ঞান হয়ে পড়ায় ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন হতভম্ব হয়ে হয়ত বসে ছিলেন, আর তখুনি জোরে বেলটা বোধ হয় বেজে ওঠে ভয় পেয়ে বকুল দেবী পাশের ঘরে সম্ভবত আত্মগোপন করলেন, পাছে ধরা পড়ে যান। দরজাটা খোলাই ছিল—সেই খোলা দরজাপথে এবারে হত্যাকারী ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল। লোকটা কে এবং কি করছে—অতঃপর আমার অনুমান, দরজার আড়ালে থেকে বকুল দেবী সবই দেখেছেন সেরাত্রে।