অনন্য যেন একেবারে পাথর। কেবল বিপাশার মুখের দিকে সে চেয়ে আছে। অসহায় বিষণ্ণ দৃষ্টি।
বিপাশা এ সময় বললে, একটা দুর্ঘটনায় আমার শাশুড়ি–
প্রশ্নটা আপনাকে করিনি, কিরীটী বললে, করেছি আপনার স্বামী অনন্যবাবুকে। জবাবটাও তার কাছ থেকে চাই। বলুন অনন্যবাবু, আমি যে প্রশ্ন করেছি তার জবাবটা দিন।
একটু আগে বিপাশাকে যে কথাগুলো বলেছিল অনন্য, কিরীটীকেও সেই কথাগুলোই বলে গেল ধীরে ধীরে।
সব শুনে কিরীটী বললে, এখন আপনার বাবা কেমন আছেন?
একেবারে শান্ত, তবে কারোর সঙ্গে কথা বলেন না। কাউকে চিনতেও পারেন না। চুপচাপ একটা চেয়ারে বসে থাকেন সর্বক্ষণ সেলের মধ্যে। আর হাতে একটা সুতো নিয়ে কেবল পাকান।
কবে তাঁর সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল?
আমাদের বিয়ের মাসখানেক আগে বিয়ে করছি কথাটা বলতে গিয়েছিলাম তাকে। কিন্তু বাবা আমার দিকে তাকালেনও না—একটা কথাও বললেন না।
কিরীটী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রুমালটা আর প্লাস্টিকের চুড়ির টুকরোটা পকেটে থেকে বের করে বিপাশার দিকে তাকিয়ে বললে, দেখুন তো বিপাশা দেবী, এ দুটো চিনতে পারেন?
না।
এগুলো কোথায় পাওয়া গিয়েছে জানেন? নীলাকাশে সরিৎবাবুর ফ্ল্যাটের মেঝেতে! ভাল করে পরীক্ষা করে দেখুন আবার বিপাশা দেবী, এটা একটা লেডিজ রুমাল-এর এক কোণে ইংরাজী অক্ষরে লাল সুতো দিয়ে লেখা একটা ইংরাজী অক্ষর বি।
বিপাশা—অনন্য স্ত্রীর মুখের দিকে তাকাল, তোমার রুমাল না ওটা?
না—শান্ত দৃঢ় গলায় জবাব দিল বিপাশা।
কিরীটী বললে, এই প্লাস্টিকের চুড়ির টুকরো–
আমি কখনও হাতে চুড়িই পরি না—দেখছেন না আমার হাতে সোনার বালা ছাড়া কোন চুড়ি নেই! আর কিছু আপনার জিজ্ঞাস্য আছে মিঃ রায়?
একটা প্রশ্ন আর করব—রজতবাবু আপনাকে চিঠি লিখতেন—আর আপনিও জবাব দিতেন
মধ্যে মধ্যে
সে লিখত কিন্তু আমি তার একটা চিঠিরও কোন জবাব দিইনি—হাতে এলেই ছিড়ে ফেলে দিতাম।
ধন্যবাদ—আর আপনাকে বিরক্ত করব না—চলি-নমস্কার—চল সুদর্শন—
দুজনে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
ওখান থেকে সোজা সুদর্শন আর কিরীটী এল নীলাকাশে। রাত তখনও বেশী হয়নি, নয়টা হবে।
ডোর-বেল বাজাতেই ভৃত্য এসে দরজা খুলে দিল।
সুদর্শনের পরনে ছিল পুলিশের ইউনিফর্ম—পঞ্চানন একটু যেন হকচকিয়ে যায় ওদের দেখে।
সুদর্শন বললে, সরিৎবাবু আছেন?
আজ্ঞে না, তিনি তো এখনও ফেরেন নি। পঞ্চানন বললে।
তার বোন?
হ্যাঁ, দিদিমণি আছেন।
তাকেই তাহলে খবর দাও। বলবে লালবাজার থেকে মিঃ মল্লিক এসেছেন—
খবর দিতে হল না-বকুল ওদের গলা শুনেই বের হয়ে এসেছিল ঘর থেকে। বকুলের পরনে সাধারণ একটা মিলের শাড়ি-চুল রুক্ষ। চোখ দুটো যেন কিছুটা ফোলা-ফোলা।
বকুল দেবী, আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল। সুদর্শনই বললে।
আসুন—
কিরীটী আর সুদর্শন ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল।
বসুন।
সরিৎবাবু এখনও ফেরেন নি?
না-দাদা তার এক বন্ধু আগরপাড়ায় খুব অসুস্থ তাকে দেখতে গেছে। ফিরতে রাত হবে বলে গেছে।
সুদর্শন নিজে সোফার উপরে বসতে বসতে বললে, বসুন বকুল দেবী।
কিরীটী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বকুলকে লক্ষ্য করছিল। রোগা পাতলা চেহারা, বর্ণশ্যাম কিন্তু চোখেমুখে একটা চমৎকার আলগা শ্ৰী আছে। বিশেষ করে চোখ দুটি সত্যিই সুন্দর। বকুল কিন্তু বলা সত্ত্বেও বসে না–দাঁড়িয়েই থাকে।
বসুন বকুল দেবী।
দাদাও নেই—আপনারা কাল আসবেন, বকুল বললে।
কিরীটীর পূর্ব নির্দেশমত সুদর্শন বললে, কাল প্রয়োজন হলে আবার আসতেই হবে, তবে এসেছি যখন আপনার সঙ্গে কথাটা সেরে যাই—
আমার সঙ্গে—
হ্যাঁ-বসুন না।
বকুল সামনের সোফাটায় বসল। পঞ্চানন দাঁড়িয়ে তখনও। সুদর্শন তাকে চোখের ইঙ্গিতে ঘর ছেড়ে যেতে বললে। পঞ্চানন চলে গেল।
বকুল দেবী–কথা শুরু করল কিরীটী, আপনি আমাকে হয়ত চেনেন না—আমার নাম—
পূর্বে দেখা কখনও না হলেও আপনাকে আমি চিনতে পেরেছি, বকুল বললে।
চিনতে পেরেছেন?
হ্যাঁ—আপনি কিরীটী রায়বকুলের গলাটা যেন কিরীটীর মনে হল একটু কেঁপে গেল।
বকুল দেবী-রজতবাবুর সঙ্গে তো আপনার বিবাহ স্থির হয়ে গিয়েছিল, তাই না? কিরীটী বললে।
হ্যাঁ, এই মাসেই বিয়ে হওয়ার কথা ছিল।
আপনি কলকাতায় কবে আসেন?
রবিবার সকালে।
কোন্ ট্রেনে?
কেন বলুন তো!
না, তাই জিজ্ঞাসা করছি—কোন ট্রেনে?
পাঞ্জাব এক্সপ্রেসে—
কটার সময় এসে হাওড়ায় পৌঁছান।
ভোর সাতটায়।
তারপর সোজা এখানে চলে আসেন বোধ হয়?
হ্যাঁ।
কিন্তু আপনি তো এখানে এসে পৌছান বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ। আপনার হাওড়া থেকে। এখানে ট্যাক্সিতে আসতে সাড়ে তিন ঘণ্টা সময় লাগল?
হ্যাঁ—মানে অন্য জায়গায় পথে একটু কাজ সেরে আসতে দেরি হয়ে গেছে—
আপনি কিন্তু ঠিক সত্য কথাটা বলছেন না বকুল দেবী, কিরীটী শান্ত গলায় বললে।
মানে–কি বলতে চান আপনি-আমি মিথ্যা বলছি!
মিথ্যা না বললেও সত্য কথাটা আপনি বলছেন না।
আমি মিথ্যা বলিনি—সত্যিই বলছি–
বকুল দেবী—আমার দুটো চোখ যদি মিথ্যা না দেখে থাকে তো–আপনি এসেছেন রবিবার নয়–শনিবার সন্ধ্যায় এবং ট্রেনে নয়—প্লেনে!
কি বলছেন কিরীটীবাবু?
আমি সে সময় এয়ারপোর্টে ছিলুম—যে প্লেনে আপনি এসেছেন শনিবার, সেই প্লেনেই। পাটনা থেকে আমার এক বন্ধুর আসার কথা ছিল, তাকে রিসিভ করতে গিয়েছিলাম। এয়ারপোর্টে।
বকুল যেন একেবারে বোবা। পাথর।
কিরীটী বলতে লাগল শান্ত গলায়, হয়ত আপনিও লক্ষ্য করেছেন, একটা মোটামত ভারী গোঁফওয়ালা দামী স্যুট পরা হাতে একটা অ্যাটাচি কেস এক ভদ্রলোককে, যিনি ঠিক আপনার সঙ্গে সঙ্গে এসে প্লেন থেকে নেমে লাগেজের জন্য, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন কি মনে পড়ছে—আমার সেই বন্ধুটি দিল্লীর পুলিশের একজন বড়কর্তা এবং তিনিও আমার কথার সত্যতা প্রমাণ করবেন, কারণ তিনিও একবার একজনকে দেখলে বড় একটা ভোলেন না।