দাদাবাবু!
কে?
আজ্ঞে আমি পরেশ। পরেশ এসে সামনে দাঁড়াল।
ভ্রূ কুঞ্চিত করে তাকাল অনন্য পরেশের দিকে–বিরক্ত কণ্ঠে বললে, কি হয়েছে?
দুজন বাবু এসেছেন—
কে বাবু?
একজন মনে হল সেই পুলিশ অফিসার—অন্যজনকে চিনতে পারলাম না।
ব্যালকনির আলোটা তখনও জ্বালানো হয়নি—অন্ধকার। নীচের বাগানে অন্ধকারে ঝোপে ঝোপে একঝাক জোনাকি আলোর বিন্দু ছড়িয়ে উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে।
আপনমনেই অনন্য বললে, আবার পুলিশ কেন! যা এইখানেই ডেকে আন—
পরেশ চলে গেল।
একটু পরেই সুদর্শনের সঙ্গে কিরীটী এসে ব্যালকনিতে প্রবেশ করল। বিপাশা ইতিমধ্যে ব্যালকনির আলোটা জ্বেলে দিয়েছিল।
নমস্কার। সুদর্শন বললে, অনন্যবাবু, আপনাকে আবার একটু বিরক্ত করতে এলাম।
বসুন—অনন্য বললে।
সুদর্শন বললে, এঁকে আপনি চিনবেন হয়তনাম হয়ত শুনে থাকবেন—কিরীটী রায়।
কিরীটী নামটা শুনেই বিপাশা যেন কেমন ভীতিবিহ্বল দৃষ্টিতে ওর মুখের দিকে তাকাল।
সুদর্শন আবার বললে, পুলিশের বড়কর্তা মিঃ গুপ্তর নির্দেশেই উনি এখানে এসেছেন—
কেন? অনন্য শুধাল।
ক্যাঃ চৌধুরী যিনি কয়দিন আগে নীলাকাশের চারতলার ফ্ল্যাট থেকে–
বুঝেছি, তা আমার কাছে কেন মিঃ মল্লিক! তাছাড়া আপনি তো একবার এসেছিলেন—আমার যা বলবার সবই তো সেদিন বলেছি—
জবাব দিল কিরীটী, জানি অনন্যবাবু, সুদর্শন ও সুধাকান্তর মুখ থেকে সবই আমি শুনেছি—
তবে—তবে আবার এসেছেন কেন?
আমাদের আরও কিছু জানা দরকার, কিরীটী বললে।
কিন্তু আমি তো আর কিছু জানি না।
আপনার স্ত্রী বিপাশা দেবী—শুনেছি আমরা, যেদিন ক্যাঃ চৌধুরী মারা যান সকাল দশটা সোয়া-দশটা নাগাদ তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন।
হ্যাঁ।
কি কথাবার্তা হয়েছিল সে-সময় বিপাশা দেবীর তার সঙ্গে? কথাটা বলে কিরীটী সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল বিপাশার মুখের দিকে।
অনন্য যেন কি বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তাকে থামিয়ে দিয়ে বিপাশাই বললে, আমাকে রজত জোর করে এখান থেকে নিয়ে যেতে এসেছিল—
আঃ, বিপাশা থাম—অনন্য বাধা দেবার চেষ্টা করে।
অনন্য, ওঁদের জানা দরকার ব্যাপারটা—হ্যাঁ, শুনুন কিরীটীবাবু, অনন্যোপায় হয়েই তখন তাকে আমি নিরস্ত করি সন্ধ্যায় তার ওখানে যাব বলে—
গিয়েছিলেন আপনি? কিরীটীর প্রশ্ন। হারাত সোয়া আটটা নাগাদ
দেখা হয়েছিল তার সঙ্গে আপনার?
হ্যাঁ—বলে, কি কথাবার্তা হয়েছিল উভয়ের মধ্যে বিপাশা একে একে বলে গেল এবং এও বললে, ঘর থেকে বেরুবার মুখে কাকে আড়ি পাততে লক্ষ্য করেছিল।
তাকে চিনতে পারেন নি?
না।
অনন্যবাবু?
কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল অনন্য।
আপনি তো পরেশের মুখ থেকেই জানতে পারেন ক্যাঃ চৌধুরীর আসার কথা!
হ্যাঁ।
তারপর আপনি কি করলেন?
আমি ব্যাপারটায় কোন গা দিই নি—
দেন নি?
না।
কেন?
কারণ ব্যাপারটায় কোন গুরুত্ব দেওয়া দরকার মনে করি নি।
আপনি সেরাত্রে কখন বাড়ি ফেরেন?
রাত সোয়া বারোটা নাগাদ বোধ হয়। একটা পার্টি ছিল, পার্টি সেরে ফিরি।
আপনি ক্যাঃ চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করেন নি?
না।
কিন্তু আমাদের সংবাদ অন্যরকম—
মানে? আপনি গিয়েছিলেন নীলাকাশে—
না—না-অনন্য বলে ওঠে।
বিপাশার কণ্ঠ হতে একটা অস্ফুট শব্দ বের হয় ঐ সময়।
দেখুন অনন্যবাবু, অস্বীকার করে কোন লাভ নেই। আপনি গিয়েছিলেন আমরা জানি। কি, যান নি?
আমি–
বলুন কখন গিয়েছিলেন—নীলাকাশের দারোয়ান আপনাকে যেতে দেখেছে সাড়ে আটটা নাগাদ–
হ্যাঁ, আমি গিয়েছিলাম—
অনন্য–অস্ফুট চিৎকার করে ওঠে যেন বিপাশা।
হ্যাঁ বিপাশা—তুমি তখন ঘরের মধ্যে রজতবাবুর সঙ্গে কথা বলছিলে—
কেন—কেন গিয়েছিলে? বিপাশা বললে, তুমি তাহলে আমাকে বিশ্বাস করতে পারনি অনন্য!
তোমাকে আমি বিশ্বাস করি বিপাশা–তুমি বিশ্বাস কর—
তবে–তবে কেন গিয়েছিলে সেখানে একটা চাকরের কথা শুনে?
অনন্য বললে, রজতের সঙ্গে একটা শেষ বোঝাপড়া করব বলেই গিয়েছিলাম, অন্য কোন কারণে নয়, তুমি বিশ্বাস কর—
দেখা হয়েছিল আপনাদের? কিরীটীর প্রশ্ন।
না।
কিরীটী বললে, দেখা হয়নি—দেখা না করেই চলে এসেছিলেন ক্যাঃ চৌধুরীর সঙ্গে?
তার কোন প্রয়োজন আছে বলে মনে করিনি। তাই আর দেখা করিনি শেষ পর্যন্ত।
তবে আবার দ্বিতীয়বার গিয়েছিলেন কেন, যদি আর দেখা করার কোন প্রয়োজনই বোধ করেন কি?
কে বললে আবার আমি গিয়েছিলাম? অনন্যর গলার স্বরে কেমন যেন একটা দ্বিধাসংকোচ।
ঐ দারোয়ানই বলেছে যে, আবার–হ্যাঁ, আবার অনেক রাত্রে সেখানে আপনি গিয়েছিলেন মিঃ বক্সী।
অনন্য একেবারে চুপ।
কি, জবাব দিন আমার প্রশ্নের। কখন গিয়েছিলেন আবার দ্বিতীয়বার সে রাত্রে নীলাকাশে সরিৎবাবুর ফ্ল্যাটে?
রাত সাড়ে এগারোটায়—কিন্তু–
কি?
ফ্ল্যাটের দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে দেখি ঘরের মধ্যে নেই রজত, বাথরুমের দরজা খোলা—ব্যালকনির দরজাটাও খোলা—তা হলেও প্রথমটায় বাথরুমে ঢুকে দেখি, তারপর ব্যালকনিতে ঢুকে দেখি—
কি, কি দেখলেন?
রজত পড়ে আছে ব্যালকনিতে, সে—সে তখন মৃত। আমি আর এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়াইনি, ছুটে নিচে পালিয়ে আসি। বিশ্বাস করুন কিরীটীবাবুরজতকে আমি হত্যা করিনি। হয়ত হয়ত বেঁচে থাকলে তাকে আমি হত্যাই করতাম, কিন্তু—
তারপর বেশ কিছুক্ষণ স্তব্ধতা। হঠাৎ যেন একটা পাষাণভার স্তব্ধতা ঘরের মধ্যে জমাট বেঁধে ওঠে।
স্তব্ধতা ভঙ্গ করল পুনরায় কিরীটীই। সে বললে, অনন্যবাবু, আপনার মার কিভাবে মৃত্যু ঘটেছিল নিশ্চয়ই আপনি জানেন?