মাকে আমার বাবা—
ছাড় ওসব কথা।
না—তোমার জানা দরকার—আর আমারও এতদিন কথাটা না এড়িয়ে গিয়ে তোমাকে বলা উচিত ছিল—মাকে আমার বাবা–
থাক না অনন্য—যা অতীত তা ভুলে থাকাই ভাল।
না শোন—বাবা মাকে হত্যা করে এই ব্যালকনি থেকে নীচে ফেলে দিয়েছিলেন—
সত্যি বলছ?
হ্যাঁ—কারণ আমি ব্যাপারটা নিজের চোখে দেখেছিলাম।
কি বলছ তুমি?
আমার বয়স তখন কতই বা হবে—দশ কি এগারো–পাশের ঘরেই আমি ছিলাম ঘুমিয়ে, হঠাৎ মার গলার স্বরে আমার ঘুমটা ভেঙে গেল। মার গলা কানে এল। শুনলাম মা বলছেন, তুমি বিশ্বাস কর, অবিনাশ আমার আপন খুড়তুতো ভাই-কোনদিন কোন পাপ আমাদের মনের– মধ্যে জাগেনি, বাবা চিৎকার করে উঠলেন, মিথ্যা কথা, ও ছেলে আমার নয়—তাই তাকে একটু আগে আমি গলা টিপে শেষ করে দিয়েছি
সে কি–ওগো এ তুমি কি করেছ–ছি ছি-আমার–
বাবা আবার চিৎকার করে উঠলেন, পাপের শেষ আমি রাখব না—
তারপর?
আমি দরজার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলাম—দেখলাম বাবা দুহাতে মার গলা টিপে ধরলেন। মা ছটফট করতে করতে একসময় এলিয়ে পড়লেন—আর বাবা তখন মার অচেতন দেহটা দুহাতে তুলে নিয়ে গিয়ে ঘরের বাইরে এসে ব্যালকনি থেকে নীচে ফেলে দিলেন।
বিপাশা যেন একেবারে পাথর।
অনন্য একটু থেমে হাঁপাতে হাঁপাতে বলতে লাগল, পরের দিন পুলিশ এল—বাবার সঙ্গে সে-সুমকার পুলিশ কমিশনারের যথেষ্ট হৃদ্যতা ছিল। প্রায়ই তিনি আমাদের এখানে আসতেন, মার সঙ্গে বসে বসে গল্প করতেন–
তিনি–
তিনিই হচ্ছেন অবিনাশ মামা–মার আপন খুড়তুতো ভাই–যৌথ পরিবারে একসঙ্গে মানুষ হয়েছিলেন তারা। শেষ পর্যন্ত অবিনাশ মামাই ব্যাপারটা আত্মহত্যা বলে চাপা দিয়ে দেন বোধ হয়, অবিশ্যি সবটাই আমার ধারণা—আমি পুরোপুরি সব জানি না। কিন্তু ঐ দুর্ঘটনার পর থেকেই বাবা ক্রমশ যেন কেমন হয়ে যেতে লাগলেন। বেশীর ভাগই চুপচাপ—একা একা ঘরের মধ্যে বসে থাকতেন—আপনমনে বিড় বিড় করতেন আর ঘরের মধ্যে একা একা পায়চারি করতেন।
ভাবতে পার সে-সময়কার মনের অবস্থা আমার বিপাশা, রাতের পর রাত আমি ঘুমোতে পারতাম না, ঘুমোলেই দেখতাম এসে সামনে দাঁড়িয়েছে—মাথাটা ফেটে তার চৌচির হয়ে ঘিলু বের হয়ে পড়েছে—অনন্য দুহাতে মুখ ঢাকল।
বিপাশা নিঃশব্দ স্থির প্রস্তরমূর্তির মত বসে আছে।
অনন্য আবার বলতে লাগল, ক্রমশ বাবা যেন কেমন অ্যাবনরম্যাল হয়ে যেতে লাগলেন— ঐ সময় আমার পিসিমা এলেন আমাদের বাড়িতে পিসিমা আসাতে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। বাবার ঐ একমাত্র বোন, বিধবা বিবাহের তিন বৎসর পর পিসেমশাই একটা ট্রেন অ্যাকসিডেন্টে মারা যান। শ্বশুরবাড়িতেই ছিলেন পিসিমা-বাবা তাকে নিয়ে এলেন এই বাড়িতে। কিন্তু বাবা আর ভাল হলেন না। আমি যেবারে ম্যাট্রিক দিই—বাবা একেবারে ঘোর উন্মাদ হয়ে গেলেন—তখন ডাক্তারদের পরামর্শেই তাঁকে রাঁচীতে রেখে আসা হল। বুঝতেই পারছ তখন আমি বেশ বড় হয়েছি—সব বুঝতে পারি। এই বিরাট বাড়িতে তখন আমি, পিসিমা আর কিছুদিন হল বাবাকে দেখাশুনা করবার জন্য পরেশকে রাখা হয়েছিল, সেই পরেশ। পরেশ কিন্তু বাবাকে রাঁচীতে পাঠাতে চায় নি। সে বলেছিল বাবার ভাবনা কাউকে ভাবতে হবে না। সেই সর্বক্ষণ তার দেখাশুনা করবে। কিন্তু বাবা তখন রীতিমত ভায়োলেন্ট।
সেখানকার চিকিৎসায়, অনন্য বলতে লাগল, বাবার অবস্থা ক্রমশ একটু একটু ভাল হয়ে উঠতে লাগল—অনেকটা শান্ত হয়ে গেলেন। কিন্তু তারপর আর কোন প্রােগ্রেসই হয়নি! চুপচাপ ঘরের মধ্যে বসে থাকেন। আলো একেবারেই সহ্য করতে পারেন না—অন্ধকার ঘরে থাকেন। ডাক্তাররা বললেন সুস্থ আর হবেন না আগের মত, আর স্বাভাবিক হবেন না। ব্রেনের কিছু সেলস্ অ্যাট্রফি করে গিয়েছে, বাবা সেই অবস্থাতেই এখনও আছেন—বি.এ. পড়ি যখন মধ্যে মধ্যে তাঁকে দেখতে যেতাম।
তোমাকে চিনতে পারেন?
না।
আচ্ছা, ঐ যে মণির কথা বললে—সে—
আমার ছোট একটি ভাই হয়েছিল, আমার থেকে আট বছরের ছোট-বাবা তাকে গলা টিপে হত্যা করেছিলেন। এই সব কথা কতদিন তোমাকে বলব ভেবেছি, কিন্তু পারিনি বলতে। কে যেন আমার গলা টিপে ধরেছে—আমার কণ্ঠ রোধ করেছে। বাবার কথা কোনদিনই আমি ভুলতে পারিনি। আমার মনের একটা অংশ যেন বাবা অধিকার করে রেখেছেন। তারপর দেখা দিল আমার মনের মধ্যে এক ভয়–
ভয়! কিসের ভয়?
বাবা যেন আমার সামনে এসে দাঁড়ান। একমাথা কাঁচা-পাকা রুক্ষ এলোমেলো চুল—একমুখ কাঁচা-পাকা দাড়ি—আর বড় বড় দুটো রক্তচক্ষু। রাত্রে শয্যায় গিয়ে শুলেই যেন বাবার আতঙ্ক আমাকে গ্রাস করত। আর মনে হত কে যেন অন্ধকারে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ভয়ে চোখ বুজে কাঠ হয়ে পড়ে থাকতাম। দিনের বেলাটা কোন ভয় আতঙ্ক থাকত না-রাত্রি হলেই হত শুরু সেই ভয়ের বিভীষিকা। এমনি করেই চলছিল—তোমার সঙ্গে আলাপ হল ঐ সময়–কেন যেন তোমার কাছে গেলে আমার সবর্ভয় চলে যেত।
বিপাশা চেয়ে আছে নিঃশব্দে তখনও অনন্যর মুখের দিকে। আশঙ্কা অনিশ্চয়তা আর অবিশ্বাস যেন তার দুচোখের দৃষ্টিতে।
অনন্য আবার একটু থেমে বলতে লাগল, তুমি এলে এ-বাড়িতে—ভাবলাম আর বুঝি আমাকে সর্বক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকতে হবে না। দুঃস্বপ্নের পীড়ায় আমাকে বুঝি আর পীড়িত হতে হবে না। কটা দিন ভালই কাটল, কিন্তু ক্রমশ আবার যেন আগের সেই দ্বিধা, সংশয় ও ভয় আমার মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলতে লাগল একটু একটু করে। মধ্যরাত্রে ঘুম ভেঙে যেতে লাগল। ঘুমোবার চেষ্টা করতাম কিন্তু পারতাম না। মনে হত কে যেন দুহাতে ঠেলে আমাকে শয্যা থেকে তুলে দিচ্ছে। ঘরের বাইরে সিঁড়ির দিকে ঠেলছে—এক পা এক পা করে সিঁড়ি বেয়ে উঠতাম উপরে—কে যেন ঠেলত আমাকে সামনের দিকে–