আপনি তাহলে বলতে চান দাদা, আগে ক্যাঃ চৌধুরীকে হত্যা করা হয়েছে, তারপর ডেড বডিটা চারতলার ব্যালকনি থেকে নীচে ফেলে দেওয়া হয়েছে ব্যাপারটা আত্মহত্যা দাঁড় করবার জন্য!
হয়ত তাই—তবু কিন্তু সব কিছুর মধ্যে একটা খটকা থেকে যাচ্ছে।
খটকা!
হ্যাঁ—ফাঁসটা খুলে নিল না কেন হত্যাকারী—আর ফাঁসই লাগিয়ে যদি হত্যা করা হয়ে থাকত-ক্লোরোফর্মের প্রয়োজন হল কেন? কেবলমাত্র ফাঁস লাগিয়ে বা কেবলমাত্র ক্লোরোফর্ম নিয়েই যখন ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলা যেত, তখন দুটোরই প্রয়োজন হল কেন?
হয়ত ফাঁস লাগাবার পরে struggle করছিল ক্যাঃ চৌধুরী, তখন ক্লোরোফর্ম দেওয়া হয়েছে!
তুমি যা বলছ তা হয়ত অসম্ভব কিছু নয় ভায়া–কিন্তু তাহলে—
কি দাদা?
He or She!
মানে?
মানে হত্যাকারী কোন পুরুষ না স্ত্রীলোক। সেই প্রশ্নটাই সর্বপ্রথম মনে জাগবে। নাহে, ব্যাপারটা গোলমেলে। Complicated!
কিরীটী একটু থেমে কতকটা যেন আপনমনেই বলতে লাগল, সত্যি মানুষের মন কি বিচিত্র। আর কি বিচিত্ৰই না মানুষের ভালবাসার টানাপোড়েন। কি জান ভায়া—এখন আমি প্রায়ই ভাবি—ভালবাসার সত্যিকারের সংজ্ঞাটা কি। প্রেম কাকে বলে। শুধু কি পরস্পরের প্রতি নারীপুরুষের পরস্পরের একটা দেহগত যৌনাত্মক আকর্ষণ, না ঐ স্থূল যৌন আকর্ষণের বাইরেও কিছু আছে!
সুব্রত এতক্ষণ ওদের কথা নিঃশব্দে শুনছিল, এবারে বললে, যৌনানুভূতিকে বাদ দিয়ে ভালবাসা বা প্রেম বলে কোন বস্তুর অস্তিত্ব থাকতে পারে না কিরীটী।
না রে সুব্রত, আমি তোর কথাটা পুরোপুরিভাবে মেনে নিতে পারলাম না।
কেন?
এই বিশেষ ক্ষেত্রে আমাদের সামনে দুটি পুরুষ ও দুটি নারী আছে—অনন্য আর রজতশুভ্র-বিপাশা আর বকুল। বিপাশা যাই বিবৃতি দিন না কেন, তার হয়ত কোন এক সময় সত্যিই কিছু দুর্বলতা ছিল তার প্রতিবেশী রজতশুভ্রর উপরে এবং যেটা সে ভুলবার চেষ্টা করেছে তার জীবনে অনন্যর আবির্ভাবের পর এবং ভুললেও হয়ত একেবারে মন থেকে মুছে ফেলতে পারেনি রজতশুভ্রকেনচেৎ সে ঐ রাত্রে নীলাকাশের ফ্ল্যাটে রজতের সঙ্গে দেখা করতে যেত না।
সে তো সে গিয়েছিল, সুব্রত বললে, নিছক প্রাণের দায়ে।
অত্যন্ত দুর্বল explanation!
মানে?
সেও অনায়াসেই তার স্বামীকে সব কথা জানাতে পারত এবং সেখানে না গেলেও পারত।
তবে সময় পেল কোথায়?
কেন, বাড়িতে ফোন তো ছিল।
তার স্বামী হয়ত অন্যরকম ভাবত–বিশ্বাস করত না তাকে হয়ত পুরোপুরি।
হ্যাঁ, সেও তাই ভেবেছিল—আর ভেবেছিল এই কারণে—
কি?
তার মনের মধ্যে তখনও রজতশুভ্রর প্রতি একটা অবচেতন স্বীকৃতি ছিল। কিম্বা—
কি বল?
স্বামীর দিক থেকে তার এমন কোন ভয়ের কারণ হয়ত ছিল, যেজন্য সে স্বামীকে শেষ পর্যন্ত জানাতে সাহস পায়নি। না রে—একটা গোলমাল কোথাও জট পাকিয়ে আছে ওদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে!
গোলমাল?
হ্যাঁ—যেটা একমাত্র ওদের সঙ্গে কথা না বলে কোন মীমাংসায় পৌছানো সম্ভব নয়। সুদর্শন?
দাদা—
ওদের স্বামী স্ত্রীর সঙ্গে একবার দেখা হতে পারে না?
কেন পারবে না।
তাহলে সেই ব্যবস্থাই কর—আর—
আর কি দাদাসুদর্শন তাকাল কিরীটীর মুখের দিকে।
বকুলের আপাতত তো পাটনায় ফেরা হতে পারে না। অনুরোধে না হলে তোমার পুলিশী অধিকার জারি করতে হবে।
আপনি বলতে চান দাদা, জোর করে বলে দেব সরিৎবাবুকে কথাটা—
প্রয়োজন হলে তাই করতে হবে। কারণ—
বলুন দাদা।
না, এখন থাকit is too early! তার আগে একবার নীলাকাশের ফ্ল্যাটটা ঘুরে দেখতে চাই।
কখন যাবেন বলুন?
আজ সন্ধ্যায়ই–
ঠিক আছে আমি এসে আপনাকে নিয়ে যাব।
সেই রাত্রির পর থেকেই—যে রাত্রে অনন্য ঘুমের মধ্যে বিপাশার গলা টিপে ধরেছিল—স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের মধ্যে যেন একটা কোথায় সুক্ষ্ম চিড় ধরেছিল। মনে হচ্ছিল, দুজনই যেন দুজনার কাছ থেকে নিজেদের অজ্ঞাতেই একটু একটু করে দূরে সরে যাচ্ছে—একটা যেন পরস্পরের সম্পর্কের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম ব্যবধান রচিত হচ্ছে। অথচ দুজনাই প্রাণপণে সব কিছু ভুলে পরস্পর পরস্পরের কাছে স্বাভাবিক হয়ে ওঠবার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে প্রতিটি মুহূর্তে। কিন্তু পারছে না কিছুতেই পারছে না যেন। দুজনই দুজনার সঙ্গে কথা বলছে—কিন্তু ঠিক যতটুকু প্রয়োজন তার বেশী নয়। একটা প্রাচীর যেন ওদের দুজনার মধ্যখানে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে।
সেদিন অফিস থেকে ফিরে হাত-মুখ ধুয়ে দুজনে এসে ব্যালকনিতে বসেছিল। বিপাশা চা করে এগিয়ে দিয়েছে কাপটা অনন্যর দিকে, কিন্তু অনন্য কেমন যেন অন্যমনস্ক। নিষ্ক্রিয়ভাবে দূরে সন্ধ্যার আলোকিত রাস্তার দিকে তাকিয়ে চুপটি করে বসে আছে।
বিপাশা বললে, চা যে ঠাণ্ডা হয়ে গেল।
হ্যাঁ–হ্যাঁ, চায়ের কাপটা হাতে তুলে নিল অনন্য। দুটো চুমুক দিয়ে আবার সামনের টেবিলের ওপরে নামিয়ে রাখল।
কি, ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে তো চা! বিপাশা বললে।
না—ঠিক আছে। জবাব দিল অনন্য।
একটা কথা বলব?
কি বল না।
তোমাকে তো আমি বলেছি কেন রজতের সঙ্গে সেরাত্রে দেখা করতে গিয়েছিলাম, মনে হচ্ছে তুমি যেন আমাকে বিশ্বাস করতে পারছ না—
না, না—তা কেন?
অনন্য–সত্যি যা তাকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করলেও চাপা দেওয়া যায় না।
আমার একটা কথা তোমাকেও বলা বোধ হয় উচিত ছিল। তাই এই কটা দিন ধরে ভাবছি—
কি কথা?
আমার মায়ের ব্যাপারটা—
কোন কথা না বলে বিপাশা স্বামীর মুখের দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল।