বিশ্বাস করুন বাবু, কালীর দিব্বি—
প্রচণ্ড একটা ধমক দিয়ে উঠল সুদর্শন, এই চুপ রও! সুধাকান্ত, নীচের থেকে সার্জেন্টকে ডেকে আন, ওকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে যাক থানায়।
দোহাই বাবু আপনার—আমি আড়ি পেতেছিলাম—
কেন?
আজ্ঞে—
সুদর্শন বিপাশার দিকে তাকাল, লোকটা কতদিন আপনাদের এখানে আছে বিপাশা দেবী?
আমি আমার স্বামীর মুখে শুনেছি, বিপাশা বললে, আমার শ্বশুরমশাইয়ের আমলের লোক–
আপনাদের বিয়ে কতদিন হয়েছে?
মাস আষ্টেক—
আপনার শ্বশুরমশাই—
পরেশই জবাব দিল, আজ্ঞে তার তো মাথা খারাপ–রাঁচিতে পাগলাগারদে আছেন।
তাই নাকি বিপাশা দেবী! সুদর্শনের প্রশ্ন বিপাশাকে।
হ্যাঁ।
কতদিন আছেন তিনি সেখানে?
তা প্রায় শুনেছি উনিশ বছর।
বলেন কি—অনেকদিন তাহলে! তা কি হয়েছিল হঠাৎ পাগল হয়ে গেলেন কেন?
শুনেছি একটা দুর্ঘটনার কিছু পরেই তার মস্তিষ্ক বিকৃতির লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করে—অনেক চিকিৎসা হয়, কিন্তু দিন দিন ক্রমশ অবনতি ঘটায়—আমার শ্বশুরের এক বোেন তাকে পাগলাগারদে পাঠিয়ে দেন।
কি দুর্ঘটনা—
বিপাশা তখন তার স্বামীর মুখে থেকে যা শুনেছিল সব বলে গেল।
তাহলে আপনার স্বামী কি দুর্ঘটনা ঘটেছিল, যাতে আপনার শ্বশুরমশাইয়ের মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটে, তা বলেন নি?
তিনি বলেছেন—তিনি জানেন না।
হঠাৎ পরেশের দিকে তাকিয়ে ঐসময় সুদর্শন প্রশ্ন করল, তুমি তো এ বাড়ির অনেকদিনের পুরানো লোক, তুমি জান না?
আজ্ঞে শুনেছি গিন্নীমা হঠাৎ মারা যাওয়াতেই কত্তাবাবু যেন কেমন হয়ে যেতে লাগলেন দিনকে দিন চুপচাপ ঘরের মধ্যে অন্ধকারে বসে থাকতেন একা একা—আপনমনে বিড় বিড় করে কি সব বলতেন, তারপরই একেবারে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেলেন, কেবল চেঁচাতেন–রাক্ষুসী—ডাইনী—বেশ্যা!
রাক্ষুসী, ডাইনী, বেশ্যা!
আজ্ঞে।
কাকে বলতেন?
তা তো জানি না বাবু—
তোমার গিন্নীমাকে দেখেছ?
আজ্ঞে না—আমি তার মারা যাবার এক বছর পরে এ-বাড়িতে এসেছি—
তা তুমি কার কাছে ঐ কথা শুনলে পঞ্চানন?
পিসিমার মুখে।
পিসিমা এখন কোথায়?
তিনি বছর কয়েক আগে মারা গেছেন। সেই থেকেই এত বড় বাড়ির মধ্যে আমি আর দাদাবাবুই ছিলাম—বৌদিমণিও সেদিন এলেন।
পরেশ!
আজ্ঞে—
যাও তুমি এবারে নীচে যাও—আমি না ডাকা পর্যন্ত আসবে না উপরে, মনে থাকে যেন–আবার আমাদের কথা শোনবার চেষ্টা করলে বা উপরে এলে সঙ্গে সঙ্গে তোমাকে গ্রেপ্তার করে চালান দেব।
পরেশ মাথা নিচু করে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। ক্রমশ পরেশের পায়ের শব্দ মিলিয়ে গেলা
বিপাশা দেবী—আপনার ও রজতবাবুর মধ্যে আলাপ পরিচয় ছিল বিবাহের পূর্বে সেকথা মিঃ বক্সী জানেন না?
জানে।
জানেন?
হ্যাঁ। বিবাহের পূর্বে চার-পাঁচ বৎসর আমাদের মধ্যে আলাপ ও ঘনিষ্ঠতা ছিল—
একটা কথা বলব কিছু মনে করবেন না। আমি কিন্তু আপনাদের ঐ পরেশ ভৃত্যটিকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছি না!
বিপাশা কোন কথা বলবার আগেই অনন্য এসে ঘরে ঢুকল ঐ মুহূর্তে।
বিপাশার দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল।
এঁরা লালবাজার থেকে আসছেন সুদর্শনবাবু—সুধাকান্তবাবু—
ভ্রূ দুটো কুঞ্চিত করে অনন্য প্রশ্ন করে, লালবাজার থেকে কেন?
সুদর্শন বললে, বসুন মিঃ বক্সী, আমি বলছি—আমরা রজতবাবুর ব্যাপারে—
রজতবাবু তো সুইসাইড করেছেন–
না, তিনি খুন হয়েছেন।
কি বলছেন সুদর্শনবাবু—খুন? তাঁকে মার্ডার করা হয়েছে!
হ্যাঁ–ব্রুটালি মার্ডার! নিষ্ঠুর হত্যা। বিপাশা দেবী আপনি একটু এ ঘর থেকে যান—আপনার স্বামীকে আমার কিছু জিজ্ঞাস্য আছে।
আমাকে?
হ্যাঁ—যান বিপাশা দেবী–
না—ওর যাওয়ার দরকার নেই—তুমি বোস বিপাশা—
বিপাশা একটু যেন বিব্রত বোধ করে—তাহলেও ঘর ছেড়ে চলে যায় না। অনন্য বললে, বলুন কি জিজ্ঞাসা আছে আপনার? কিন্তু আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না অফিসার, রজতবাবু যদি খুনই হয়ে থাকেন, আপনারা যা বলছেন তার সঙ্গে আমাদের কি সম্পর্ক থাকতে পারে?
আপনাদের দুজনকেই রজতবাবু চিনতেন—
হ্যাঁ—সামান্যই পরিচয় ছিল।
সেটা হয়ত আপনার সঙ্গে ছিল, কিন্তু আপনার স্ত্রী তার দীর্ঘদিনের পরিচিত ছিলেন—
কে বললে?
আমরা শুনেছি।
কার কাছে শুনলেন?
সরিৎবাবু ও তার বোনের কাছ থেকে।
তাঁরা কে?
চেনেন না তাদের?
না।
সত্যিই বলছেন চেনেন না?
না। এই প্রথম নাম দুটো আপনার মুখ থেকে শুনলাম।
তাই বুঝি! শুনেছি আপনার মা নাকি কি এক দুর্ঘটনায় মারা যান! কথাটা কি সত্যি?
হ্যাঁ–
তা কি দুর্ঘটনায় মারা যান তিনি?
জানি না।
বেশ—এবারে বলুন তো—যে শনিবার রাত্রে রজতবাবু খুন হন–সেদিন যে সকালবেলা তিনি দশটা সোয়া দশটার সময় এখানে এসেছিলেন তা আপনি নিশ্চয়ই শুনেছেন!
না তো—
পরেশ আপনাকে বলেনি?
পরেশ!
হ্যাঁ–সে আপনাকে বলেছিল কথাটা।
Absurd! কে বললে? সে আমাকে কোন কথা বলেনি।
যদি বলি পরেশই বলেছে—
পরেশ বলেছে! অনন্যর গলার স্বরটা সহসা যেন কেমন মিনমিনে হয়ে আসে।
হ্যাঁ—পরেশ। কি, বলেনি সে?
হ্যাঁ—মানে ঐ রকমই কি যেন বলেছিল পরেশ?
কখন বলল?
অফিসে আমাকে গিয়ে বলে এসেছিল দুপুরে—
এবারে বলুন, আপনি নীলাকাশে গিয়ে রজতবাবুর সঙ্গে দেখা করেছিলেন?
বিপাশা স্থিরদৃষ্টিতে তখন স্বামীর মুখের দিকে চেয়ে আছে, তার সমস্ত মুখটা তখন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে।
না, না—রজতবাবুর সঙ্গে আমি দেখা করতে যাব কেন? তাছাড়া লোকটাকে আমি অত্যন্ত ঘৃণা করি।
ঘৃণা করেন?
হ্যাঁ–-ও কি একটা ভদ্রলোক—একটা ছোটলোক—