ঘুমের ওষুধ?
হ্যাঁ।
ওতে কিছু হবে না ডাঃ দাশগুপ্ত—
কে বলল হবে না? ডাঃ দাশগুপ্ত বললেন।
হবে না আমি জানি। রাত ঠিক দুটোয় ঘুমটা আমার ভেঙে যায়—ওষুধ খেলেও এবং না খেলেও। ঘুমের ওষুধে কোন কাজ হবে না ডাঃ দাশগুপ্ত।
বেশ তো আপনি দেখুন না কটা দিন খেয়ে, আমি যে ওষুধ আপনাকে দিচ্ছি—
খেতে বলছেন খাব। কিন্তু আমি জানি কোন লাভ হবে না খেয়ে। অনন্যর কণ্ঠস্বরে কেমন। যেন একটা ক্লান্তি ও হতাশা।
চলুন বাইরের ঘরে যাওয়া যাক। ডাঃ দাশগুপ্ত চেয়ার থেকে উঠে পড়লেন, আসুন—
ঐ ঘর থেকে দুজনে বের হয়ে এল।
একটা চেয়ারের উপরে চুপচাপ বসেছিল বিপাশা। অনন্যর স্ত্রী। চমৎকার সুন্দরী, স্বাস্থ্যবতী তরুণী, পাতলা ছিপছিপে গড়ন। পরনে একটা সাদা শাড়ি চওড়া জড়িপাড়-হাতে দু-গাছা করে সরু সোনার চুড়ি—গায়ে একটা স্কার্ফ জড়ানো।
বসুন মিঃ বক্সী—
ডাঃ দাশগুপ্তের নির্দেশে অনন্য তার স্ত্রীর পাশের খালি চেয়ারটার ওপর উপবেশন করল।
অনন্য বলল, এক গ্লাস জল পেতে পারি?
নিশ্চয়ই–বলে ডাঃ দাশগুপ্ত কলিংবেলটা টিপলেন। একজন বেয়ারা এসে ঘরে প্রবেশ করল। সুখলাল, এক গ্লাস পানি লাও–
সুখলাল ঘরের বাইরে চলে গেল।
বিপাশা ঐ সময় বলল, সব কিছু বলেছ তো ডাঃ দাশগুপ্তকে?
জবাব দিলেন ডাঃ দাশগুপ্তই বিপাশার প্রশ্নের, বললেন, হ্যাঁ।
ওর এমন কেন হয় ডাঃ দাশগুপ্ত? বিপাশা প্রশ্ন করে।
আপনাকে আমার কিছু জিজ্ঞাস্য আছে মিসেস বক্সী।
বিপাশা ডাঃ দাশগুপ্তের মুখের দিকে তাকান, আমাকে!
হ্যাঁ।
বলুন–
আচ্ছা এ ধরনের মনের বিকারটা আপনি কতদিন লক্ষ্য করছেন আপনার স্বামীর মধ্যে মিসেস বক্সী?
মাস আষ্টেক ধরে। মানে বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই ওর ঐরকম হচ্ছে।
তার আগে ছিল না কিছু?
উনি তো বলেন ছিল না, বিপাশা বলল।
কতদিন বিয়ে হয়েছে আপনাদের?
আট মাসের কিছু বেশী—
বিয়ের পর থেকেই তাহলে বলছেন?
কতকটা তাই–বিয়ের কুড়ি বাইশ দিন পর থেকেই–বিপাশা বলল।
সুখলাল ঐ সময় ট্রের ওপর জলভর্তি একটা কাঁচের গ্লাস হাতে ঘরে এসে ঢুকল।
অনন্য গ্লাসটা ট্রের ওপর থেকে তুলে নিয়ে চোঁ-চোঁ করে এক নিঃশ্বাসে জলটা খেয়ে নিল।
সুখলাল শূন্য গ্লাসটা নিয়ে ঘর থেকে বের করে গেল।
ডাঃ দাশগুপ্ত যেন কি ভাবছিলেন, অনন্যর দিকে আবার তাকালেন, অনন্যর মুখের উপরে যেন একটা ক্লান্তির হতাশার দুশ্চিন্তার ছায়া।
অনন্য কেমন যেন ঝিমানো গলায় বলল, প্রতিটি রাত যে আমার কাছে কি ভয়াবহ এক দুঃস্বপ্ন বহন করে আনে—আপনাকে বোঝাতে পারব না ডাঃ দাশগুপ্ত। রাত্রি যেন আমার কাছে এক ভীতি!
বিয়ের আগে তাহলে আপনার ঐ দুঃস্বপ্নটা ছিল না মিঃ বক্সী!
কী বললেন? না, এমন স্পষ্ট ছিল না—
এখন যেরকম আপনার মনে হয়, বিয়ের আগে কখনও আপনার সেরকম মনে হয়নি?
একেবারে মনে হয়নি তা নয়, কদাচিৎ কখনও-সখনও হয়েছে—
আচ্ছা একটা কথা মিঃ বক্সী, কখনও কোন বিশেষ মুহূর্ত বা বিশেষ ঘটনা আপনার কি মনে পড়ে যার সঙ্গে মনের ঐ ব্যাপারটার কোন যোগাযোগ আছে বলে আপনার মনে হয়?
না, সেরকম কিছু মনে পড়ে না।
আপনি বলছিলেন, রাত ঠিক দুটোয় ঘুমটা আপনার ভেঙে যায়—
হ্যাঁ।
ঠিক আছে, ঐ সময় যাতে ঘুম না ভাঙে সেই ব্যবস্থা আমি করব—
আমি জানি ডাঃ দাশগুপ্ত, তা হবে না। যত চেষ্টাই আপনি করুন, রাত ঠিক দুটোয় ঘুম আমার ভেঙে যাবেই আমি জানি
সেরকম না হলেই তো হল!
পারবেন না—পারবেন না। অনেক ঘুমের ওষুধ দিয়ে আগেও অনেক ডাক্তার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু পারেন নি। ডাঃ দাশগুপ্ত, একটা কথা কি জানেন?
কি?
আমি আর আমার জন্য ভাবি না—আর এও আমি জানি—
কি জানেন?
ঐ—ঐ ফাঁসটাই একদিন আমার গলায় চেপে বসবে, আমার শ্বাসরোধ করবে। যা হবার হোক, আমি আর ভাবতে পারি না—আপনি শুধু আমার স্ত্রী বিপাশাকে ওর মানসিক দুশ্চিন্তাটা যাতে যায় ও সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে তার একটা ব্যবস্থা করে দিন–
বিপাশা ঐ সময় বাধা দিয়ে বলে ওঠে, কেন, আমার কি হয়েছে? আমি তো সুস্থ স্বাভাবিক আছি।
না, তুমি নেই। ওর কথা বিশ্বাস করবেন না ডাঃ দাশগুপ্ত, আমার চিন্তায় ও সারারাত জেগে থাকে। আট মাস আগে ওর যা চেহারা ছিল, আজ তার আর কিছুই নেই। আট মাস আগে যারা
ওকে দেখেছে আজ তারা ওকে দেখলে বোধ হয় চিনতেও পারবে না।
না, না ডাঃ দাশগুপ্ত, ওর কথা বিশ্বাস করবেন না। বিপাশা, কেন তুমি অমন করছ, ওঁকে জানতে দাও তোমার কথাটা—ওঁর জানা দরকার
আমার কিছু হয়নি ডাঃ দাশগুপ্ত, আপনি ওকে সুস্থ করে দিন। বিয়ের আগে ও যেমন ছিল তেমনি করে দিন। ওর কষ্ট সত্যিই আমি আর সহ্য করতে পারছি না। বিপাশার গলার স্বর যেন কান্নায় বুজে আসতে চায়।
ডাঃ দাশগুপ্ত বিপাশার মুখের দিকেই তাকিয়ে ছিলেন—সত্যিই সুন্দর দেখতে ভদ্রমহিলা— কিন্তু তার সে সৌন্দর্য যেন মেঘে ঢাকা পড়েছে।
মিঃ বক্সী!
বলুন।
আপনি তো চাকরি করেন?
জবাব দিল বিপাশা, বলল, হ্যাঁ, উনি একটা ব্যাঙ্কের বড় অফিসার।
ডাঃ দাশগুপ্ত বললেন, তাহলে তো বেশ রেসপনসিবিল পোস্টেই আছেন উনি!
হ্যাঁ–বিপাশা বলল।
মিঃ বক্সী, ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড—একটু পাশের ঘরে যাবেন, ওঁকে আলাদা ভাবে কিছু প্রশ্ন করতে চাই।
বেশ তো করুন। আমি যাচ্ছি।
অনন্য উঠে পাশের ঘরে চলে গেল।
মিসেস বক্সী?
বলুন।
আমি কিছু প্রশ্ন আপনাকে করব, আপনি কিন্তু কিছু না লুকিয়ে আমার সব প্রশ্নগুলোর জবাব দেবেন—দেবেন তো?