অতঃপর তখনকার মত সুদর্শন বিদায় নিল।
সুব্রত এতক্ষণ একটা কথাও বলেনি। এবারে বললে, আচ্ছা কিরীটী, এমনও তো হতে পারে—সরিৎবাবু যে স্টেটমেন্ট দিয়েছেন তা সব নয়—
কি রকম?
মানে সরিৎবাবু যা বলেছেন তার বন্ধু সম্পর্কে সেটা সব নয়-বন্ধু যখন, তখন আবার অনেক কিছুই হয়ত রজবাবু সম্পর্কে জানেন তিনি—জানাটাও স্বাভাবিক এবং ব্যাপারটা তারই ওখানে ঘটেছে বলে হয়ত অনেক কিছু বলেন নি–চেপে গেছেন অনেক কথা।
কথাটা তোর হয়ত মিথ্যা নয় সুব্রত—কথাটা আমার মনে হয় নি—তুই সুদর্শনকে বললি কেন! আমার মাথার মধ্যেকার গ্রে সেলগুলো সত্যিই বোধ হয় বয়সের দরুন অ্যাট্রফি করে গেছে। নচেৎ–
না—কিরীটী রায় এখনও কিরীটী রায়–casually ব্যাপারটা আলোচনা করছিলি বলেই হয়ত এতক্ষণ কথাটা তোর মনে হয়নি–
কৃষ্ণা এসে ঐসময় ঘরে ঢুকল। বললে, সুদর্শনবাবু এসেছেন?
হ্যাঁ, এসেছিল। এইমাত্র চলে গেল।
তা হঠাৎ এতদিন পরে!
সুব্রতই বললে, বেচারা একটা জটিল মামলায় জড়িয়ে পড়েছে।
খুনোখুনির কোন ব্যাপার নিশ্চয়ই!
সুব্রত হাসতে হাসতে বললে, অবিশ্যি সুদর্শনের ধারণা তাই।
কি রকম?
এক ভদ্রলোক চারতলা থেকে নীচে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছেন—তার তদন্ত করতে গিয়ে সুদর্শনের ধারণা হয়েছে—ওটা তা নয়—একটা মার্ডার। হত্যা!
শকুনের দৃষ্টি সব সময় ভাগাড়ের দিকে, কৃষ্ণা বললে।
তুমি কি মনে কর কৃষ্ণা, কিরীটী মৃদু হেসে বললে, পুলিশ কেবল খুন-ডাকাতি খুঁজেই বেড়ায়!
তা ছাড়া কি? যত সব নৃশংস ব্যাপার!
না কৃষ্ণা, ওরা সদাসতর্ক চোখ মেলে আছে বলেই সমাজের আর দশজন নিশ্চিন্ত হয়ে আছে, ওরা যে সোসাইটির কত বড় উপকার করে
বুঝেছি আর ওদের গুণকীর্তন গাইতে হবে না! সুদর্শন তোমাকে সক্রিয় করে গেছে। তা ঘটনাটা সত্যি কি বল তো সুব্রত?
সুব্রত তখন সংক্ষেপে ঐদিনকার সকালবেলার আলোচনার সারাংশটা বিবৃত করে গেল। সব শুনে কৃষ্ণা বললে, সুদর্শন বোধ হয় ঠিকই অনুমান করেছে।
তোমারও ধারণা তাহলে—
হ্যাঁ খুন—পরিষ্কার মার্ডার। দুটি পুরুষ-দুটি নারী। গণ্ডগোেল ঐ চার মূর্তিকে নিয়েই।
কি রকম? সুব্রত শুধালে।
রজতশুভ্র, অনন্য বক্সী–বিপাশা আর বকুল। কি গো, তুমি যে একেবারে চুপচাপ? কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললে কৃষ্ণা।
ভাবছি—
কি, শুনি?
পুরুষ না নারী?
নারী কখনই নয়–
তা হলে তো তোমার মতে ঐ অনন্য বক্সীই রজতশুভ্রর গলায় ফাঁস দিয়ে চারতলার ব্যালকনি থেকে ঠেলে ফেলে দিয়েছে।
আমি কি তাই বলছি! আমি বলেছি কেবল গোলমালটা ঐখানেই—
কিন্তু তাই যদি হয়ে থাকে–অর্থাৎ যদি অনন্য বক্সীই হয়—তার রয়েছে স্ট্রং অ্যালিবাই— বালিগঞ্জ সারকুলার রোড আর পার্ক স্ট্রীটে যেমন যথেষ্ট ব্যবধান—তেমনি সে ব্যবধান অতিক্রম করে গেলেও সরিৎবাবুর ফ্ল্যাটে অত রাত্রে আকস্মিক প্রবেশ নিশ্চয়ই রজতশুভ্র (যদি অবিশ্যি তাই হয়ে থাকে) নিশ্চয়ই ভাল চোখে দেখেননি—হৃষ্টমনেও ব্যাপারটা মেনে নিতে পারেন নি।
কেন শুনি? কৃষ্ণার প্রশ্ন।
বুঝলে না—পরস্পর তো পরস্পরের প্রেমের রাইভ্যাল ছিলেন!
কৃষ্ণা বললে, তাই হয়তো একটা ড়ুয়েল লড়ে গেছেন দুজনে সেই রাত্রে ঐ ফ্ল্যাটে—
সুব্রত বললে, ফলে একজনের মৃত্যু।
কৃষ্ণা ঝাঝিয়ে ওঠে, কেন–হতে পারে না?
পারবে না কেন, পারে পারে কিন্তু একটা কথা ভুলে যাচ্ছ রজতশুভ্র ছিলেন একজন আর্মি অফিসার। আগ্নেয়াস্ত্র নিশ্চয়ই কিছু একটা তাঁর কাছে ছিল—সেক্ষেত্রে কিরীটী বললে, দেখ তুমি যাই বল—
কৃষ্ণা বললে, অনন্য বক্সীর উপরে আমার সন্দেহ হচ্ছে—
অর্থাৎ তাহলে এই দাঁড়াচ্ছে, কিরীটী বললে, অনন্য বক্সীর মনের মধ্যে তার স্ত্রী বিপাশা দেবীর প্রণয়ীর সম্পর্কে একটা দ্বন্দ্ব ছিল। সে দ্বন্দ্বটা ধূমায়িত হতে হতে পর্বতের আকার ধারণ করেছিল—অ্যারাবিয়ান নাইটের সেই গল্প, কলসীর থেকে ধোঁয়া বেরুতে বেরতে এক দৈত্যের আকার ধারণ করেছিল–
কৃষ্ণা হেসে ফেলে।
হাসছ কি–কিছুই বিচিত্র নয়। মানুষের মন না মতি। তোমার ইঙ্গিতটা সত্যিই রীতিমত তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু আপাতত এক পেয়ালা কফি হলে মন্দ হত না।
সকাল থেকে ক’কাপ হয়েছে জান?
এত ভোলা মন নয় আমার—এবারে হলে হবে পঞ্চম।
১০. সুদর্শনের মনের মধ্যে
সুদর্শনের মনের মধ্যে রজতশুভ্রর ব্যাপারটা কিছুটা সংশয়ের মধ্যে দোল খাচ্ছিল, কিন্তু কিরীটীর ওখান থেকে বের হয়ে জীপে উঠে বসতে বসতে একটা সুস্পষ্ট কর্মপন্থা তার মনের মধ্যে দানা বেঁধে উঠতে থাকে। তাকে আবার নীলাকাশে যেতে হবে সি আই ডি অফিসার সুধাকান্তকে সঙ্গে করে। সুধাকান্ত লোকটার বয়েস খুব বেশী হয়নি, এখনও ৩৪ ৩৫ হবে—চাকরিতে বছর দশেক ঢুকেছে, কিন্তু যেমন বুদ্ধিমান তেমনি কর্মঠ ও করিৎকর্মা। লালবাজারে ফিরে এসে সুদর্শন প্রথমেই সুধাকান্তর খোঁজ নিল। সে ঐসময় তার ঘরেই ছিল।
সুদর্শন মল্লিক ডেকেছে শুনে সুধাকান্ত তার অফিস ঘরে এসে ঢুকল, ডেকেছেন স্যার?
হ্যাঁ, সুধাকান্ত—বোস। আমার সঙ্গে এক জায়গায় তোমাকে যেতে হবে।
কখন যেতে হবে বলুন।
আপত্তি যদি না থাকে তো এখুনি যেতে চাই—
বেশ চলুন।
দুজনে এসে আবার জীপে উঠে বসল। সুদর্শনই ড্রাইভারকে নীলাকাশে যেতে বলল।
সেদিন কি একটা পাবলিক হলিডে। অফিস-আদালত ছুটি।
সরিৎকে তার ফ্ল্যাটেই পাওয়া গেল।
সরিৎই নয় কেবল–বকুলও ছিল। বকুল পাটনায় তখনও ফিরে যায়নি। আগামীকাল রাত্রের ট্রেনে সে ফিরে যাবে কথা হয়েছে।