হ্যাঁ বলেছিলে–কিন্তু—
কিন্তু কি?
আমি বিশ্বাস করতে পারি নি। ঠিক আছে তুমি যাও—
খোলা-মনে কথাটা বলছ তো রজত?
হ্যাঁ—তুমি যাও—তবে আমারও বোধ হয় আর অন্য পথ রইল না।
রজত!
তোমাকে ছাড়া আমার পক্ষেও বাঁচা সম্ভব নয়—আমি—হ্যাঁ দেখতে পাচ্ছি—এখন আমার সামনে একটি পথই আর আছে–সুইসাইড।
না না! আর্ত চিৎকার করে উঠেছিল অস্ফুট কণ্ঠে বিপাশা।
হ্যাঁ–বিপাশা তাই।
না না—এসব তুমি কি বলছ রজত। ছিঃ ছিঃ, একজন পুরুষমানুষ হয়ে।
তুমি আর এখানে থেকো না বিপাশা, রজত বললে, যাও। বাড়ি যাও। একে আজকের সকালের ব্যাপারে আমি রীতিমত লজ্জিত হয়ে আছি—তারপর যদি তোমার স্বামী জানতে পারেন তুমি এখানে এসেছ—না, না—তুমি যাও বিপাশা। বাড়ি যাও। আমার মন বড় দুর্বল—আমার মত যদি আবার বদলে যায়—যাও তুমি।
আসি তাহলে
হ্যাঁ—এস। আমার একটা অনুরোধ রেখো। আজকের দিনটার কথা ভুলে যেয়ো।
বিপাশা আর কথা বাড়ায়নি। ঘর থেকে বের হয়ে এসেছিল এবং দরজা খুলতেই তার মনে। হল যেন কে একজন দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিল—চট করে সরে গেল। এবং করিডোর দিয়ে হন হন করে হেঁটে চলে গেল সিঁড়ির দিকে।
গতরাত্রের ব্যাপারটার মধ্যে কোন গুরুত্ব দেয়নি বিপাশা কিছু মনেও হয়নি অন্যরকম। অন্যমনস্ক ছিল সেভেবেছিল আশেপাশের ফ্ল্যাটেরই কেউ হয়ত হবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে। তা নয়–কেউ হয়ত ভেজানো দরজায় কান পেতে ঘরের মধ্যে তাদের কথা শোনবার চেষ্টা করছিল, আড়ি পেতেছিল। পিছন থেকে লোকটাকে যতটা দেখেছিল-লম্বা সুটপরা লোকটা। সত্যিই যদি ঐ ফ্ল্যাটবাড়ির কেউ না হয়ে থাকে তো–কে হতে পারে লোকটা–আর কেনই বা তাদের কথা শোনবার চেষ্টা করছিল আড়ি পেতে। বড় ঘুম পাচ্ছে।
বিপাশা আর ব্যালকনিতে দাঁড়ায় না। ব্যালকনির দরজাটা বন্ধ করে ঘরের মধ্যে এসে ঢুকল। ঘরের উজ্জ্বল আলোটা নেভাললা—মৃদু নীলাভ রাত—বাতিটা জ্বলছে। মৃদু নীলাভ আলোয় ঘরের মধ্যে সব যেন কেমন ঝাপসা ঝাপসা।
শয্যার পাশে এসে দাঁড়াল। অনন্য গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন।
বিপাশা এসে সোফাটার উপর বসল। ঘুমে যেন চোখের পাতা দুটো একেবারে সীসের মত ভারী হয়ে আসছে। ঘুমাব না—ঘুমাব না করতে করতেও কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল বিপাশা বসেবসেই। হঠাৎ ঘুমটা তার ভেঙে যায়—গলার উপরে একটা চাপ পড়ছে। এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াল—যে হাত দুটো তার গলা টিপে ধরেছিল সেই হাত দুটো গলা থেকে সরিয়ে দেয়, কে–
এ কি! সামনে দাঁড়িয়ে তার স্বামী অনন্য। চট করে এগিয়ে গিয়ে সুইচ টিপে ঘরের উজ্জ্বল আলোটা জ্বেলে দিল বিপাশা।
সত্যই অনন্য–স্লিপিং স্যুট পরিধানে অনন্য দাঁড়িয়ে।
বিপাশা! মৃদু ফিসফিস গলায় অনন্য যেন ডাকল।
তুমি-তুমি—
বিপাশা!
তুমি আমার গলা টিপে ধরেছিলে অনন্য? তুমি-তুমি—
আমিনা তো, না, না–না–
হ্যাঁ—জোরে গলা টিপে ধরেছিলে তুমি আমার—
অনন্য ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে তখন স্ত্রী বিপাশার মুখের দিকে।
আ—আমি তোমার গলা টিপে ধরেছিলাম! অনন্য আমতা আমতা করে বললে।
হ্যাঁ—
মনে নেই—মনে নেই। মনে করতে পারছি না তো কিছু। বিশ্বাস কর বিপাশা—আমি—
বিপাশা অনন্যর হাত ধরে সোফাটার উপরে এনে বসাল আর দ্বিতীয় বাক্য ব্যয় না করে।
অনন্য—
বল।
একটা কথার জবাব দেবে?
কি কথার জবাব চাও?
বল আগে যা জিজ্ঞাসা করব তার সত্য জবাব দেবে।
দেব, বল এবারে কি তোমার প্রশ্ন, অনন্য বলল।
তোমার মার মৃত্যু কিভাবে হয়েছিল?
কেন তুমি তো জান, একটা দুর্ঘটনায়।
কি সে দুর্ঘটনা?
আমি তখন ছোট ছিলাম—তোমায় তো বলেছি।
ছোট থাকলেও নিশ্চয়ই শুনেছ পরে—কারও না কারোর মুখে—সত্যি কি হয়েছিল, কি কারণে তার মৃত্যু হল?
না—শুনিনি।
শোন নি?
না, না—কেন এক কথা বার বার জিজ্ঞাসা করছ বিপাশা। বলছি তো শুনিনি।
আমি জানতে চাই—কি এমন দুর্ঘটনায় তোমার মার মৃত্যু হয়েছিল যাতে করে তোমার বাবা। পাগল হয়ে গেলেন, পরেশ হয়ত জানে–
জানি না। দেখ আমি জানলে তো বলব। জানি না। কথাটা বলতে বলতে হঠাৎ অনন্য কেমন। যেন গম্ভীর হয়ে গেল। বাকি রাতটা কেউ আর কারও সঙ্গে কথা বললে না। দুজনে দুটো সোফায় মুখোমুখি বসে রইল। বাইরে রাত ঝিমঝিম করতে থাকে।
০৯. বেলা তখন সোয়া আটটা হবে
সকালবেলা—বেলা তখন সোয়া আটটা হবে। কিরীটী ঐদিনকার সংবাদপত্রের পাতা ওলটাতে ওলটাতে দ্বিতীয় কাপ চায়ের আস্বাদ গ্রহণ করছিল, পাশে বসে সুব্রত। জংলী এসে বললে, মল্লিক সাহেব এসেছেন।
কে? সুদর্শন? যা নিয়ে আয়।
একটু পরে জংলীর পিছনে পিছনে এসে ঘরে প্রবেশ করল সুদর্শন।
আরে এস, এস ভায়া—তারপর বল কি খবর, অনেক দিন পরে এলে।
সুদর্শন বসতে বসতে বললে, আপনি তো দাদা আজকাল বড় একটা কারও সঙ্গে দেখাই করেন না শুনতে পাই।
কিরীটী মৃদু মৃদু হাসে।
সুদর্শন বললে, তাই অযথা বিরক্ত করতে আসি না।
বুঝতে পারছি, তা সাবিত্রীর খবর কি?
সে যথারীতি সংসার আর ছেলে নিয়ে আছে—সামনের বছরে ছেলেকে ভর্তি করতে হবে, কোথায় কেমন করে ভর্তি করবে সেটাই এখন তার সর্বক্ষণের চিন্তা।
হ্যাঁ—আজকাল ছেলেমেয়েদের পড়ানো যা একটা প্রবলেম হয়েছে। তা তোমার হঠাৎ আগমনের হেতুটা কি বল?
দিনপাঁচেক আগে একটা নিউজ বের হয়েছে কাগজে, দেখেছেন কিনা জানি না। পার্ক স্ট্রীটের একটা ম্যানসননীলাকাশ নাম, তার চারতলার ফ্ল্যাট থেকে–
মনে পড়ছে না, তা কি সুইসাইড বুঝি—
তাহলে তো গণ্ডগোল মিটেই যেত।