কিন্তু ব্যাপারটা কেমন যেন বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না অফিসার!
কেন?
প্রথমত ও যে দুতিন দিনের জন্য এখানে আসছে—কারও তা জানবার কথা নয়। তাছাড়া ওর বিশেষ পরিচিত জন কেউ এখানে এ শহরে ছিল বলেও জানি না। তাছাড়া ওকে কে-ই বা মার্ডার করতে যাবে আর কেনই বা করবে!
কি জানি মিঃ ব্যানার্জী, ব্যাপারটা আত্মহত্যা বলে যেন আমার মনে হচ্ছে না। আচ্ছা রজতবাবুর আর কোন পরিচিতজন এ শহরে আছেন যাদের আপনারা জানেন?
দাদা!
বকুলের ডাকে সরিৎ বোনের মুখের দিকে তাকাল।
অনন্য চৌধুরী আর স্ত্রী বিপাশা—
বিপাশা!
হ্যাঁ, অফিসার এককালে শুনেছি বিপাশা ওর পাশের বাড়িতেই থাকত—পরিচয়ও ছিল ওদের পরস্পরের মধ্যে যথেষ্টবকুল বললে।
অনন্য চৌধুরী বিপাশার কে? অরুণ লাহিড়ী প্রশ্ন করলেন।
বিপাশার সঙ্গে রজতের একসময় যথেষ্ট পরিচয় ছিল–কিন্তু আট নয় মাস হবে, অনন্য চৌধুরীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর আমি যতদূর জানি—ওদের পরস্পরের দেখাসাক্ষাৎ হয়নি—
আচ্ছা বকুল দেবী?
বকুল তাকাল অরুণ লাহিড়ীর মুখের দিকে।
আপনার সঙ্গে শুনলাম রজতবাবুর বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিল—আপনারা পরস্পরের পরিচিত অনেকদিনের—বিপাশার কথা আপনি কিছু জানেন, যে মেয়েটির কথা এইমাত্র শুনলাম।
শুনেছিলাম কয়েকবার রজতের মুখে বিপাশার নাম এবং একসময় ওদের সঙ্গে কিছুটা ঘনিষ্ঠতাও রজতের হয়েছিল শুনেছি, কিন্তু বছর তিন-চার আগে অনন্য চৌধুরীর সঙ্গে বিপাশার আলাপ পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হবার পর আগের সে সম্পর্ক পরস্পরের মধ্যে ছিল না বলেই জানি।
অতঃপর অরুণ লাহিড়ী উঠে দাঁড়ালেন, চলি মিঃ ব্যানার্জী। হয়ত আবার আসব মানে আসতে হতে পারে কথাগুলো বলে অরুণ লাহিড়ী ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
সরিৎ এতক্ষণে যেন ভাল করে তাকাল বোনের দিকে। বকুল কেমন যেন অসহায়ের মত বসে আছে সোফাটার ওপরে। শিথিল হাত দুটি কোলের ওপরে ন্যস্ত। জানালা-পথে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে।
বকুল! সরিৎ মৃদু কণ্ঠে ডাকল।
বকুল সরিতের ডাকে ওর দিকে মুখ তুলে তাকাল। বিষণ্ণ ক্লান্ত—কেমন যেন অসহায় দৃষ্টি।
তা কটা দিন এখানে থাকবি তো?
না।
কেন রে?
ভাল লাগছে না দাদা, ভাবছি কালই রাত্রের ট্রেনে ফিরে যাব। তুমি দেখ যদি একটা রিজার্ভেশন পাও—
ট্রাভেল এজেন্সির সাহায্যে সেটা পেতে হয়ত কষ্ট হবে না কিন্তু ছুটি নিয়ে এসেছিস যখন, থাক না কটা দিন এখানে।
এখানে থাকলে রজতের কথা বেশী করে মনে পড়বে দাদা। আমাকে তুমি বাধা দিয়ো না দাদা, আমাকে যেতে দাও বকুলের চোখের কোল দুটো ছলছল করছে সরিৎ লক্ষ্য করে।
সরিৎ আর কোন কথা বলে না। তার মাথার মধ্যে তখন পুলিস অফিসারের কথাগুলোই যেন ঘোরাফেরা করছে। তার ধারণা রজতকে কেউ হত্যা করেছে! রজতের গলায় বাঁধা কালো। সরু কৰ্ডটা দেখেই হয়ত কথাটা অফিসারের মনে হয়েছে। সত্যিই তো, ঐ কর্ডটা গলায় কোথা থেকে এল? আর কর্ডটা তার গলায় অমন করে গিট দিয়ে বাঁধা ছিল কেন? রজত সুইসাইড যদি করে থাকে, ঐ কর্ডটার তাৎপর্য কি?
দাদা!
বকুলের ডাকে সরিৎ বোনের মুখের দিকে তাকাল।
তুমি দেখেছ কিনা জানি না কখনও, কিন্তু আমি দেখেছি—
কি দেখেছিস?
রজতের গলায় একটা সরু সিল্কের কর্ডে একটা মাদুলী বাঁধা ছিল—
তাই নাকি?
হ্যাঁ। একবার ও জলে ড়ুবে যায়—ওর যখন পাঁচ বছর বয়স—ওর বাবার গুরুদেব অপঘাত মৃত্যুকে এড়াবার জন্য কালো কর্ডে একটা মাদুলী বেঁধে ওর গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন, সেই থেকেই ওটা ছিল ওর গলায়। আমাকে ও বলেছিল। কিন্তু সেটা ওর গলায় পিছন থেকে অত টাইট করে গিঁট দিয়ে বাঁধা কেন?
না বকুল, অফিসার যা বলে গেলেন—আমারও সন্দেহ তাই, মনে হচ্ছে হয়ত তার কথাই ঠিক। কেউ ওকে হত্যাই করে গলায় ফাঁস দিয়ে হয়ত নীচে ফেলে দিয়েছে ব্যালকনি থেকে।
তাই যদি হয়ে থাকে, রজত কি বাধা দেয়নি সে-সময়?
হয়ত একাধিক লোক ছিল। ব্যাপারটা সত্যিই মাথার মধ্যে যেন আমার আসছে না।
অরুণ লাহিড়ী মৃতদেহটা হোমি-সাইডাল স্কোয়াড আসার অপেক্ষায় প্রহরায় রাখার একটা ব্যবস্থা করে তাঁর জীপে উঠে বসলেন। থানা দূরে নয়-কাছেই। থানায় পৌঁছে বড়বাবু ও. সি.-র ঘরে গিয়ে ঢুকলেন।
ঐ থানার ও. সি. সুবিনয় ঘোষ তখন লালবাজার হোমিসাইড স্কোয়াডের বড় অফিসার সুদর্শন মল্লিকের সঙ্গে কথা বলছিলেন।
থানা থেকেই মিঃ মল্লিককে ফোন করা হয়েছিল।
এই যে অরুণবাবু আসুন-মল্লিকসাহেব স্পটে যাবার জন্য রওনা হচ্ছিলেন! স্পট থেকে চলে এলেন কেন?
আমি এতক্ষণ স্যার হোমিসাইডাল স্কোয়াডের অপেক্ষায় থেকে ডে বডিটা পাহারায় রেখে আপনাকে একটা খবর দিতে এলাম।
মল্লিক বললেন, যে অফিসারটিকে স্পটে পাঠাব ভেবেছিলাম—খোঁজ নিতে গিয়ে শুনলাম সে গতকাল মাঝরাত্রে একটা রেইডের ইনফরমেশন পেয়ে সেই যে বেলঘরিয়ায় গিয়েছে এখনও ফেরেনি—তখন আমি নিজেই চলে এলাম। চলুন না আমার সঙ্গে স্পটে আর একবার।
চলুন।
দুজনে ও. সি.-র ঘর থেকে বের হয়ে জীপে গিয়ে উঠে বসলেন। অরুণ লাহিড়ী আর সুদর্শন মল্লিক।
জীপে যেতে যেতেই অরুণ লাহিড়ী মোটামুটি ভাবে সুদর্শন মল্লিককে ব্যাপারটা বলে গেলেন এবং তাঁর মতে ব্যাপারটা যে একটা হত্যাকাণ্ড তাও বললেন।
আপনার মনে হচ্ছে ব্যাপারটা এ কেস্ অফ মার্ডার, মিঃ লাহিড়ী?
হ্যাঁ স্যার, সুইসাইড বলে তো আমার মনে হচ্ছে না।
হুঁ। কর্ডের ব্যাপারটা সত্যিই সাস্পিসাস! কর্ডটা গলায় শক্ত করে গিঁট দিয়ে বাঁধা কেন?
০৮. জীপ এসে ওদের নীলাকাশের কম্পাউন্ডে
জীপ এসে ওদের নীলাকাশের কম্পাউন্ডে প্রবেশ করল। সেখানে তখন আরও ভিড় জমেছে, প্রহরারত পুলিস ভিড় সামলাতে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে যেন। সুদর্শন মল্লিকই এগিয়ে গিয়ে সকলকে প্রচণ্ড ধমক দিয়ে সরিয়ে দিলেন, অরুণ লাহিড়ীও সাহায্য করলেন তাঁকে। ক্যামেরাম্যান একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল ভিড়ের জন্য। সেও এবারে এগিয়ে এল। তদন্ত শেষ করতে ও নানা অ্যাংগেলে ফটো তুলতে ঘণ্টাখানেক লাগল। সুদর্শন মল্লিক একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলেন, অত উঁচু থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করবার জন্য পড়লে, মাটিতে আছড়ে পড়বার পর দেহের যে পোজিশন থাকা উচিত তা নেই, যেমন তেমনি মাথার খুলিটা ফেটে যাওয়া ছাড়া অন্য কোন ইনজুরিও চোখে পড়ল না তার। সর্বশেষে ঐ ধরনের দুর্ঘটনায় যতটা রক্তপাত হওয়া উচিত তাও নজরে পড়ল না। সামান্য রক্ত জমাট বেঁধে আছে মাথার নীচে। উপরের তলায় গিয়ে সরিৎ ও তার বোনের সঙ্গেও কিছু কথাবার্তা বললেন সুদর্শন মল্লিক।