কি–কি বললেন?
আজ্ঞে শালার খুব অসুখ খবর পেয়েছিলাম, তাই ঘণ্টা দুয়েকের ছুটি চেয়েছিলাম বাবুর কাছে তিনি বললেন, রাতের মত তিনি আমাকে ছুটি দিচ্ছেন—সকালে এলেই হবে—তিনি বাইরে রাত্রে খেয়ে নেবেন।
দিদিমণি বকুল আসেনি?
আজ্ঞে না, দিদিমণি তো আসেন নি!
তার তো গতকালই আসার কথা ছিল সকালের গাড়িতে গয়া থেকে!
ঠিক ঐ মুহূর্তে একটি ২৬।২৭ বৎসরের তরুণী এসে ঘরে ঢুকল, দাদা!
কে? বকুল?
হ্যাঁ। ট্রেনটা কিছু লেট ছিল, দাদা—রজতকে দেখছি না—রজত আসেনি? তার তো দুদিন আগেই আসার কথা ছিল তোমার এখানে, আমাকেও তাই লিখেছে চিঠিতে–
সরিৎ যেন বোবা। কি জবাব দেবে ছোট বোন বকুলের প্রশ্নের, বুঝতে পারে না।
বকুল আবার প্রশ্ন করে, রজত আসেনি দাদা?
বকুল!
ঐ সময় দোরগোড়ায় কয়েক জোড়া জুতোর শব্দ পাওয়া গেল।—মিঃ সরিৎ ব্যানার্জি আছেন?
কে? আমি পার্ক স্ট্রীট থানার সেকেন্ড অফিসার-ভিতরে আসতে পারি? আসুন অফিসার।
পুলিশ অফিসার মিঃ অরুণ লাহিড়ী ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করলেন। বয়েস ত্রিশ-বত্রিশের বেশী হবে না। বেশ উঁচু লম্বা বলিষ্ঠ চেহারা। পরনে সাদা ইউনিফর্ম। চোখে চশমা। একজন সার্জেন্ট সঙ্গে।
আপনিই ফোন করেছিলেন?
হ্যাঁ, আমিই সরিৎ ব্যানার্জী—আসুন।
নীচে ডেড বডি দেখলাম—তা আপনি ঐ ভদ্রলোককে চিনতেন নাকি? পরিচয় ছিল আপনাদের? এ ফ্ল্যাটবাড়ির কেউ কি?
না, বসুন।
এই ফ্ল্যাটবাড়িতে থাকতেন না উনি? অফিসার একটা সোফায় বসতে বসতে বললেন।
না। উনি একজন আর্মি অফিসার—আমার বন্ধু রজতশুভ্র চক্রবর্তী নাম।
দাদা! একটা অস্পষ্ট চিৎকার বের হয়ে আসে বকুলের কণ্ঠ চিরে।
যুগপৎ পুলিশ অফিসার ও সরিৎ ঐ চিৎকারে আকৃষ্ট হয়ে বকুলের দিকে তাকাল। বকুলের সমস্ত মুখটা যেন কেমন রক্তশূন্য ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে।
কার—কার কথা বলছ তোমরা? কার ডেড বডি? দাদা কথা বলছ না কেন?
বকুল—কি বুঝি বলবার চেষ্টা করে সরিৎ, কিন্তু পারে না।
কি কি হয়েছে দাদা রজতের? বকুলের কণ্ঠে উৎকণ্ঠা ঝরে পড়ল।
ইনি? অফিসার প্রশ্ন করে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন সরিতের দিকে।
আমার ছোট বোন বকুল ব্যানার্জী—গয়া থেকে এইমাত্র আসছে। বকুল, রজত চারতলা থেকে নীচে লাফিয়ে পড়ে সুইসাইড করেছে!
না, না—
সরিৎ উঠে গিয়ে বোনকে জড়িয়ে ধরে। ব্যাপারটা এখনও বুঝতে পারা যাচ্ছে না বকুল—রজতের রক্তাক্ত ডেড বডিটা নীচের কমপাউন্ডের ধারে পড়ে আছে—আমি একটুক্ষণ আগে রাউরকেল্লা থেকে ফিরে ট্যাক্সি থেকে নেমে দেখতে পেয়ে থানায় ফোন করেছিলাম।
বকুল থরথর করে কাপছিল, সরিৎ তাকে ধরে সোফার ওপরে বসিয়ে দিয়ে নিজেও পাশে বসল।
নীচে কমপাউন্ডে তখন সমস্ত ফ্ল্যাটবাড়ির লোক ভিড় করেছে। পুলিস তাদের সরাতে ব্যস্ত। অস্ফুট একটা গুঞ্জন। রজতের মৃতদেহটা তেমনিই পড়ে ছিল।
সেকেন্ড অফিসার মিঃ লাহিড়ী প্রশ্ন করেন সরিৎকে, আপনার বন্ধু কবে এসেছিলেন এখানে?
আমি দিনপাঁচেক আগে কোম্পানির কাজে রাউরকেল্লা গিয়েছিলাম—আজই সকালে ফিরছি—ওর আসার কথা ছিল গত পরশু, মানে শনিবার–
পঞ্চানন তখন বললে, আজ্ঞে না, শুক্রবার ভোরেই উনি এসেছিলেন।
মিঃ লাহিড়ী বললেন, আজ সোমবার উনি তাহলে তিন দিন আগে এসেছিলেন। এখানেই ততা ছিলেন, তাই না?
হ্যাঁ–সরিৎ বলে।
আর কেউ ছিল এখানে?
না। ঐ সারভেন্ট পঞ্চানন ছিল—পঞ্চাননকে দেখিয়ে দিল সরিৎ।
মিঃ লাহিড়ী পঞ্চালনের দিকে তাকালেন, তোমার নাম পঞ্চানন?
আজ্ঞে পঞ্চানন বেরা—
তুমি কিছু বলতে পার?
আজ্ঞে আমি গতকাল সন্ধ্যা ছটা নাগাদ চলে গিয়েছিলাম বৌবাজারে—
তুমি তাহলে ছিলে না এখানে?
না স্যার—
তাহলে দেখা যাচ্ছে কাল রাত্রে আপনার বন্ধু এই ফ্ল্যাটে একাই ছিলেন! পাশের ফ্ল্যাটে কে থাকেন? কি তার নাম?
সরিৎ বললে, বাঁদিকে ১৩ নম্বরে থাকেন একজন দক্ষিণদেশীয় ভদ্রলোক—মিঃ পাঙ্গু, একটা অফিসের চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট—তার স্ত্রী ও ছোট ছোট দুটি ছেলে আর ১৫নং ফ্ল্যাটে ডানদিকে থাকেন মিঃ গোয়েল—একজন পাঞ্জাবী ভদ্রলোক—পাইলট, তার স্ত্রী ও দশ বছরের একটি মেয়ে–
হুঁ। আপনি কতদিন এই ফ্ল্যাটে আছেন?
বছর চারেক হবে।
আপনি একাই?
না, আমার স্ত্রী আছেন—
তিনি?
দিন-পনেরো হল দিল্লী গেছেন তার মা-বাবার কাছে।
রজতবাবুর সঙ্গে আপনার কতদিনের পরিচয়?
দশ বারো বছরের পরিচয়—একসঙ্গে বঙ্গবাসী কলেজে আমরা চার বছর পড়েছিলাম— সেই থেকেই পরিচয়।
আর আপনার বোনের সঙ্গে?
তাও অনেক দিনের—
তবু কতদিন হবে?
ও বরাবরই আমার কাকার কাছে থেকে পাটনায় পড়াশুনা করত—মধ্যে মধ্যে ছুটিতে কলকাতায় আসত তখুনি পরিচয় হয়—তাও ধরুন বছর পাঁচেক তো হবেই
আপনার বন্ধু নিশ্চয়ই বিবাহিত ছিলেন না?
না। সামনের অগ্রহায়ণে—ওদের মানে বকুলের সঙ্গে রজতের বিয়ে হবে ঠিক হয়ে ছিল—
মিঃ লাহিড়ী আর একবার বকুলের দিকে তাকালেন।
বকুল প্রস্তর-প্রতিমার মত সোফাটার উপরে বসেছিল মাথাটা নীচু করে।
আচ্ছা মিঃ ব্যানার্জী, আপনার কি মনে হয় ব্যাপারটা?
মনে তো হয় সুইসাইডই, কিন্তু—
মৃতদেহের গলায় একটা সরু কালো কর্ড বাঁধা আছে গিট দিয়ে, নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন? করেছি।
এমনও তো হতে পারে—
কি?
কেউ ওঁর গলায় ফাঁস দিয়ে নীচে ফেলে দিয়েছে–মিঃ লাহিড়ী বললেন।
কিন্তু তা কে দেবে আর কেনই বা দেবে?
কেউ দিতেও পারে তো–ধরুন ওঁর কোন শত্রু! এটা হয়ত আদৌ সুইসাইড নয়—হোমিসাইড—মার্ডার!