রাউরকেল্লা এক্সপ্রেসটা নির্ধারিত সময়ের মিনিট কুড়ি আগেই হাওড়ায় পৌঁছে গিয়েছিল। ভাগ্যক্রমে সঙ্গে সঙ্গে একটা ট্যাক্সি পেয়ে সরিৎ সোজা নীলকাশে চলে আসে। ট্যাক্সি ড্রাইভার গেট দিয়ে সোজা কমপাউন্ডে ঢুকতেই ট্যাক্সির জোরালো হেডলাইটের আলোয় তার চোখে পড়ে সঙ্গে সঙ্গে পাম গাছটার নীচে মৃতদেহটা, কমপাউন্ডের কিনারায়। সরিৎ কিন্তু দেখতে পায়নি ব্যাপারটা। তার দুচোখ তখন ঘুমে যেন জড়িয়ে আসছিল।
ফ্ল্যাট-বাড়িটার মেইন গেটের হাত-দশেক দূরে কমপাউন্ডের ধার ঘেঁষে যে এক সারি পাম গাছ ছিল তারই প্রথম গাছটার নীচে পড়ে ছিল মৃতদেহটা।
স্যার, একটা মানুষ পড়ে আছে ঐ দেখুনট্যাক্সি ড্রাইভার বললে।
মানুষ! কোথায়? সরিৎ বললে।
ট্যাক্সির দরজা খুলে সরিৎ তখন নেমে দাঁড়িয়েছে, পৌঁছে গিয়েছে বলে।
ঐ যে দেখুন না, ঐ গাছটার নীচে!
সরিৎও দেখতে পায়–তাড়াতাড়ি এগিয়ে যায় গাছটার সামনে। শানবাঁধানোে কমপাউন্ডের ধার ঘেঁষে মাটিতে কয়েকটা পাম গাছ—তারই নীচে চিৎ হয়ে পড়ে আছে। মাথাটা চূর্ণ হয়ে গিয়েছে, চারপাশে রক্ত জমাট বেঁধে আছে কিন্তু–কে ও, কে লোকটা—চেনা-চেনা লাগছে সরিতের! সে ড্রাইভারকে বললে, গাড়ির হেডলাইটটা জ্বলুন তো? ড্রাইভার হেডলাইটটা অন করে দিল। সেই আলোয় সরিতের এবার চিনতে কষ্ট হয় না—হ্যাঁ, রজতশুভ্রই তো!
ড্রাইভারও ততক্ষণে সরিতের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল, সে বললে, মনে হচ্ছে স্যার, উপর থেকে নীচে লাফিয়ে পড়ে সুইসাইড করেছেন ভদ্রলোক!
সরিৎ তখন বোবা, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
রজতশুভ্র উপর থেকে ঝাফিয়ে পড়ে সুইসাইড করেছে, কিন্তু কেন? কেন সে সুইসাইড করবে? কয়েকদিন আগে আম্বালা থেকে সরিৎ রজতের একটা চিঠি পেয়েছিল বিশেষ কাজে দিন দুই-তিনের জন্য সে কলকাতায় আসছে এবং তার যদি কোন অসুবিধা না হয় তো সে তার ফ্ল্যাটেই উঠবে। বকুলকেও লিখেছে সে, কলকাতায় দু-চার দিনের জন্য আসতে। সেও বোধ হয় আসবে।
সরিৎও জানিয়ে দিয়েছিল রজতকে সঙ্গে সঙ্গে, মোস্ট ওয়েলকাম! তুমি আমার ফ্ল্যাটেই এসে উঠো রজত। গিন্নী আপাতত দিল্লীতে বেশ কিছুদিনের জন্য তার মা-বাবার কাছে গিয়েছে— সে সন্তান-সম্ভবা আর আমিও কোম্পানির কাজে দিন-সাতেকের জন্য রাউরকেল্লা যাচ্ছি। অতএব ফ্ল্যাট খালি। ভৃত্য পঞ্চানন রইল—তোমার কোন অসুবিধা হবে না, পঞ্চাননকে সে কথাটা জানিয়েও যাব। যদি কাজ শেষ হয়ে যায়—দেখা হবে, নচেৎ এযাত্রায় দেখা হল না। বকুল আসলে তো এখানেই উঠবে।
সব যেন কেমন এলোমেলো গোলমাল হয়ে যাচ্ছে সরিতের।
ড্রাইভারের কথায় সরিতের সম্বিৎ ফেরে যেন, ফ্ল্যাটের কেউ বোধ করি এখনও ব্যাপারটা জানতে পারেনি স্যার!
লোহার গেট খোলার শব্দ শোনা গেল। নীচের গেটের দারোয়ান রামলক্ষণ কোলাপসিবল গেটের তালা খুলছে।
রামলক্ষণ সিঁড়ির নীচেই থাকে। ফ্ল্যাটটায় সিঁড়ি এবং লিফ্ট দুই আছে। রাত সাড়ে বারোটায় লিফ্ট বন্ধ হয়ে যায়—ঐ সঙ্গে মেইন গেটও, অবিশ্যি তারপরে লিক্ট পাওয়া যায় না—তবে রামলক্ষণকে ডাকলে উঠে সে গেট খুলে দেয়।
দশতলা ফ্ল্যাটবাড়ি নীলাকাশ। বিভিন্ন সম্প্রদায় ও জাতের লোক ফ্ল্যাটগুলোতে বাস করে। ছত্রিশ রকম মানুষের আড়া। ইতিমধ্যে আলো পরিষ্কার হয়েছে—চারিদিক বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সেই আলোয়। মেইন গেট থেকে জায়গাটা হাত-দশ-পনেরোর বেশি দূর হবে না। দণ্ডায়মান ট্যাক্সি ও দুজন মানুষকে গাছের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কৌতূহলী রামলক্ষণও এগিয়ে আসে ঐদিকে এবং রজতের মৃতদেহটার প্রতি তার নজর পড়তেই সে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে, হায় রাম, এ কেয়া!
সরিতের আর একটা ব্যাপার নজরে পড়ে, একটা সরু কালো কর্ড রজতের গলায় গিঁট দিয়ে বাঁধা। পরনে রজতের দামী টেরিটের প্যান্ট ও টেরিলিনের রঙ্গিন হাওয়াই শার্ট। হাতে সোনার ঘড়ি, কজিতে বাঁধা, আর পায়ে কাবলী চপ্পল। মাথাটা ফেটে চৌচির হয়ে গিয়েছে প্রায়—চোখ দুটো যেন ঠেলে কোঠর থেকে বের হয়ে এসেছে—মুখটা সামান্য হাঁ করা—উপরের পাটির দাঁত সামান্য দেখা যাচ্ছে—জিভটাও যেন সামান্য বের হয়ে এসেছে। বীভৎস-ওদিকে তাকানো যায় না যেন! সরিৎ দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল-–চেয়ে থাকা যায় না ঐদিকে।
সরিই পার্ক স্ট্রীট থানায় ফোন করে দিয়েছিল নিজের ফ্ল্যাটে এসে। ফ্ল্যাটের দরজা ভিতর থেকে ভেজানো ছিল। তিন কামরাওয়ালা ফ্ল্যাট দুটো বেডরুম, একটা বড় আকারের লিভিং রুম। সৌখীননা মানুষ সরিৎ। তাছাড়া ভাল চাকরি করে ভাল মাহিনা পায় বেশ ভাল করে সাজানো-গোছানো ফ্ল্যাট।
পঞ্চানন কিন্তু ছিল না ফ্ল্যাটে! একটু অবাকই হয়েছিল সরিৎ পঞ্চাননকে দেখতে না পেয়ে। ফ্ল্যাট অরক্ষিত অবস্থায় ছিল। ফ্ল্যাটের আসবাবপত্র যেমন সাজানো ছিল তেমনিই সাজানো আছে—এতটুকু নাড়াচাড়া হয়নি। দুটি বেডরুমেই দরজা ভেজানো। কেবল একটা বেডরুমের বাইরের দিককার জানালা খোলা আর ব্যালকনির দরজাটা খোলা। শোবার ঘরে একটা সুটকেস–বোধ হয় রজতশুভ্রেরই।
সরিৎ একটা সোফার উপরে বসে ছিল একটা সিগ্রেট ধরিয়ে।
ভৃত্য পঞ্চানন এসে ঘরে ঢুকেই থমকে দাঁড়াল, সাহেব!
কোথায় ছিলি? সরিৎ প্রশ্ন করে।
আজ্ঞে—
ছিলি কোথায়?
আজ্ঞে বৌবাজারে আমার শালার ওখানে ছিলাম।
আমার পারমিশন ছাড়া তুই ফ্ল্যাট ছেড়ে গিয়েছিলি কেন?
আজ্ঞে আপনার বন্ধু যিনি এসেছিলেন, কাল বিকেলে তিনি বললেন—