আমাকে নিয়ে যেতে! মানে?
হ্যাঁ। আমার কাছে আম্বালায় নিয়ে যাব বলেই এসেছি। কোয়াটার্সও পেয়ে গিয়েছি, সব সাজিয়ে গুছিয়ে এসেছি।
ওরা কেউ লক্ষ্য করে না, দোতলার একটা জানলার খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে একজোড়া চোখের শ্যেনদৃষ্টি ওদের উপরে স্থিরনিবন্ধ হয়ে আছে। সে দুটো চোখ পরেশের।
তোমার স্পর্ধা তো কম নয়—চাপা বিরক্তিভরা কণ্ঠস্বরে বললে বিপাশা।
স্পর্ধার এর মধ্যে কি আছে! তুমি আমার—আর কারও নয়, তাই তোমাকে নিয়ে যেতে : এলাম।
আনি অনন্যর বিবাহিত স্ত্রী। আমাদের বিবাহ হয়েছে—কথাটা নিশ্চয়ই তোমার মনে আছে।
মনে থাকবে না কেন, বিবাহ হয়েছে তাতে হয়েছে কি তুমি আমার, আর কারও না, আমি মানি না—আমি তা হতে দিতে পারি না।
রজত! চল আর দেরি কোরো না—তৈরী হয়ে নাওট্যাক্সি আমি বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছি।
বিপাশা স্থির পাষাণমূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকে, অপলক দৃষ্টিতে মাত্র হাত দুই-তিন ব্যবধানে দণ্ডায়মান রজতশুভ্রর মুখের দিকে চায়।
লোকটা তামাশা করছে না তো! নিছক একটা পরিহাস—কিম্বা লোকটা সত্যি সত্যিই পাগল। হয়ে গিয়েছে।
কি হল—বোবা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলে কেন? এস—যেমন আছ তেমনিই চলে এস।
মনে হচ্ছে—
কি মনে হচ্ছে?
তোমার নিশ্চয়ই মাথা-খারাপ হয়ে গিয়েছে, মনে হচ্ছে আমার।
আর না না সম্পূর্ণ সুস্থনরম্যাল আমি। আমাদের বংশে কেউ পাগল নেই আর ছিলও না কেউ কোনদিন।…কি হল, এখনও দাঁড়িয়ে রইলে কেন?
চলে যাও এখান থেকে–
চলে তো যাবই—অনন্য বক্সীর এই ভূতুড়ে বাড়িতে আমি থাকতে আসিনি—চল আমরা এখুনি বের হয়ে যাই।
চলে যাও রজত!
অবশ্যই যাব—তবে তোমাকে নিয়ে, এস—
তুমি যাবে না? চাকর-দারোয়ানকে ডাকব?
তাতে কোন লাভ হবে না। তোমাকে না নিয়ে এখান থেকে আমি যাচ্ছি না।
পরেশ! গলা তুলে ডাকল বিপাশা।
রজতশুভ্র পকেট থেকে একটা পিস্তল বের করল, আমি প্রস্তুত হয়েই এসেছি বিপাশা-কারও বাধা দেবার সাধ্য নেই আমাকে। বাধা কেউ দিতে এলে তার নির্বুদ্ধিতাই প্রকাশ পাবে।
রজত! বিপাশার গলা ঋজু–কঠিন।
হ্যাঁ, তোমাকে নিয়েই আমি যাব। এস–লেট আস গো!
পরেশ প্রস্তুত হয়েই ছিল—তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল বিপাশার ডাক শুনে।
বৌদিমণি, আমাকে ডাকছ?
বাবুকে এখুনি একটা ফোন করে দে চলে আসবার জন্য–
পরেশ বোধ হয় ফোন করবার জন্যই সিঁড়ি দিয়ে উঠতে থাকে, কিন্তু পশ্চাৎ থেকে বাধা। দিল রজত—ওহে পরেশচন্দ্র, দাঁড়াও—দেখছ এটা হাতে আমার কি—এগিয়েছ কি গুলি চালাব!
পরেশ! বিপাশা বললে, যা বললাম তাই কর—যাও—ফোন করে দাও।
পরেশ, যাবার চেষ্টা করলে গুলি চালাব! রজতশুভ্র বললে।
ঠিক আছে আমিই যাচ্ছি, বলে বিপাশা সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল।
বিপাশা, কেন একটা সিন ক্রিয়েট করবার চেষ্টা করছ! চলে এস আমার সঙ্গে—
যেতেই হবে আমাকে? বিপাশা বললে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে শান্ত গলায়। যেন কিছুই হয়নি।
হ্যাঁ, যেতেই হবে, বললে রজতশুভ্র।
কিন্তু এই মুহূর্তে এইভাবে তো তা সম্ভব নয় রজত
কেন সম্ভব নয়। কাপড়জামার তোমার অভাব হবে না—
একজন স্ত্রীলোকের কাপড়জামাই কি সব!
তবে আর কিসের প্রয়োজন তোমার?
যেতে হলে আমাকে একবার দোতলা থেকে ঘুরে আসতে হবে—
বোধ হয় অনন্য বক্সীকে একটা ফোন করতে হবে, তাই কি?
না, ফোন আমি করব না-তোমাকে কথা দিচ্ছি।
শোন বিপাশা, তোমার সঙ্গে আমি পরিহাস করছি না কিন্তু—
আমার একটা কথার জবাব দেবে রজত?
বল কি কথা!
জোর করে তুমি আমার দেহটা অধিকার করতে পার এই মুহূর্তে পিস্তলের হুমকি দেখিয়ে আমাকে তোমার সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে, কিন্তু আমার স্বামী তোমাকে মুক্তি দেবে না–তাকে তুমি জান না!
কি করবে—আইন আদালত—
হ্যাঁ। তুমি অস্বীকার করতে চাইলেও দেশে যখন আইন বলে একটা বস্তু এখনও আছে—
তাতে কোন লাভ হবে না–বলে হাসে রজতশুভ্র।
লাভ হবে না? না।
হাসতে হাসতেই বললে রজত, কারণ আমি জানি তুমি আমার স্বপক্ষেই সাক্ষী দেবে— তাও জান?
জানি বৈকি, সে বিশ্বাসটুকু না থাকলে কি এখানে তোমাকে নিতে আসতাম! চল মিথ্যে কেন দেরি করছ–
আমাকে তুমি বিশ্বাস কর?
তা করি।
তোমার সঙ্গে আমাকে যেতে হবে এই তো তোমার ইচ্ছা!
হ্যাঁ।
কোথায় তুমি আছ–তোমাদের বাড়িতে কি?
না—
তবে কোথায়?
এক বন্ধুর ফ্ল্যাটবাড়ির চারতলার ফ্ল্যাটে পার্ক স্ট্রীটে—আপাতত সেখানে আমি একাই আছি।
ঠিক আছে সন্ধ্যার ঠিক পরেই তোমার ওখানে আমি যাচ্ছি–তুমি চলে যাও।
কথা দিচ্ছ?
হ্যাঁ, দিচ্ছি।
বেশ, আমি চললাম—ঠিক সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত ফ্ল্যাটে আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব মনে থাকে যেন। ফ্ল্যাট বাড়িটার নাম নীলাকাশ, চারতলায় ১৪নং ফ্ল্যাট–
ঠিক আছে—
রজতশুভ্র হাতের পিস্তলটা পকেটে রেখে বললে, মনে থাকে যেন, সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত সময় দিলাম। হলঘর থেকে বের হয়ে গেল অতঃপর রজতশুভ্র।
বিপাশা তখন আর যেন দাঁড়াতে পারছে না সোজা হয়ে—তার মাথার মধ্যে কেমন যেন ঝিম ঝিম করছে, সারা শরীরটা যেন কাপছে। হাত বাড়িয়ে বিপাশা সিঁড়ির রেলিংটা শক্ত মুঠিতে চেপে ধরল। প্রাণপণে সিঁড়ির রেলিংটা চেপে ধরে নিজের পতনটা রোধ করবার চেষ্টা করে বিপাশা।
বৌদিমণি! পরেশ ডাকল।
কেমন যেন অসহায় শূন্য দৃষ্টিতে পরেশের মুখের দিকে তাকাল বিপাশা।
বাবুকে একটা ফোন করে দিন।
বিপাশা পরেশের কথার জবাব দিল না—অসংলগ্ন শিথিল পায়ে সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে দোতালায় উঠে গেল। কিছুই যেন তখন সে আর ভাবতে পারছে না। এখন সে কি করবে? কি করা উচিত? নিজের শোবার ঘরে এসে ঢুকে একটা সোফায় অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। রজতকে সে কথা দিয়েছে আজ সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে সে তার ফ্ল্যাটে যাবে। যদি সে না যায়, রজত কি করবে–কি সে করতে পারে? কিন্তু অনন্য–তার স্বামীকে সব কথা তার অবশ্যই বলা দরকার। আবার যদি রজত এখানে এসে হাজির হয়—অনন্যর ফিরতে ফিরতেও সেই রাত সাড়ে সাতটা পৌনে আটটা। অনেক দেরি হয়ে যাবে না কি!
০৭. পরের দিন শেষরাত্রের দিকে
পরের দিন শেষরাত্রের দিকে নীলাকাশ আটতলা ফ্ল্যাট বাড়িটার কমপাউন্ডের ধার ঘেঁষে প্রথম একজন ট্যাক্সি ড্রাইভারই মৃতদেহটা আবিষ্কার করে রজতশুভ্রর, তার গাড়ির হেডলাইটের আলোয়। ভাল করে তখনও ভোরের আলো ফুটে ওঠেনি। একটা আলো-আঁধারের অস্পষ্টতা পাতলা চাদরের মত যেন চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে সর্বত্র।