তবে রাত্রে ওরকমটা ওর হয় কেন?
ভাল ডাক্তার দেখাও, দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে।
নলিনাক্ষই ডাঃ দাশগুপ্তের কথা বলেছিল তাকে একবার দেখাবার জন্য বলেছিল।
পরের দিন অনন্য অফিস চলে গিয়েছে।
বিপাশা স্নান সেরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে মাথায় সিঁথিতে সিঁদুর দিচ্ছিল, পরেশ এসে দরজার সামনে দাঁড়াল।
কি রে, পরেশ?
বৌদিমণি, একজন মিলিটারি সাহেব এসেছেন—
মিলিটারী সাহেব!
হ্যাঁ।
বললি না কেন বাবু নেই?
বলেছিলাম–বললেন, আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান।
আমার সঙ্গে?
হ্যাঁ।
বিপাশা অবাক হয়।
কে আবার মিলিটারী সাহেব এল আর তার সঙ্গেই দেখা করতে চায়!
বসতে দিয়েছিস?
না, নীচের হলঘরে দাঁড়িয়ে আছেন—উপরে এনে বসাব?
না, তুই যা আমি নীচেই আসছি।
পরেশ বললে, কি বলব বৌদিমণি?
বললাম তো, তুই যা আমি আসছি—
পরেশ এ বাড়িতে অনেক বছর আছে। বয়েস হয়েছে—অনিন্দ্যর আমলের লোক। বয়েস হয়েছে বলে আরও একজন ভৃত্যকে নিযুক্ত করেছিল অনন্য—সে যখন কলেজে পড়ে।
অনিন্দ্যকে যখন মস্তিষ্ক বিকৃতির জন্য রাঁচীতে পাঠান হল, সেই সময় ঐ গৃহে আরও– একজন ছিল—ভবানী দেবী। অনিন্দ্যর এক বিধবা শালী। স্ত্রীর মৃত্যুর পর অনিন্দ্য ভবানী
দেবীকে এনেছিলেন, ঐ গৃহে অনন্যকে দেখাশোনা করবার জন্য।
অনন্যর বিবাহের আগে পর্যন্ত ভবানী দেবী ঐ গৃহে ছিলেন। সংসারের সবকিছু দেখাশোনা তিনিই করতেন। বিবাহ স্থির হবার পর অনন্য তাকে কাশীতে পাঠিয়ে দেয়।
বস্তুত অনন্যর ইচ্ছাতেই ভবানী দেবী একদিন ঐ গৃহ ছেড়ে চলে যান। বিপাশা এখানে এসে ভবানী দেবীকে দেখেনি। কিন্তু জানতে পেরেছিল তার কথা।
অনন্যকে একদিন বিপাশা বলেওছিল, তোমার মাসীমাকে নিয়ে এস না। এত বড় বাড়িতে একা একা আমরা থাকি–
অনন্য বলেছিল, তোমার কি অসুবিধা হচ্ছে বিপাশা?
অসুবিধা হবে কেন! আর একজন থাকলে বাড়িটা এত শূন্য শূন্য মনে হত না। তাই বলছিলাম আর কি–
দরকার হলে রাত-দিনের জন্য একজন আয়া রেখে নাও না—অনন্য বলেছিল।
আয়া দিয়ে কি হবে–দুজন চাকর তো আছেই—
বিপাশা কথাটার আর জের টানেনি। কারণ সে বুঝেছিল ভবানী দেবীকে তাদের সংসারে আর ফিরিয়ে আনা তার স্বামীর ইচ্ছা নয়।
মনে মনে আরও ভেবেছে হয়ত অনন্য কোন কারণে ভবানী দেবীর ওপরে সন্তুষ্ট নয়। বিপাশা দ্বিতীয় বার আর ঐ মাসী-প্রসঙ্গের উত্থাপন করেনি।
সংসারের সবকিছু খুঁটিনাটি পরেশই দেখে।
অনন্য বলেছিল—পরেশ লোকটা খুব বিশ্বাসী। আর ওর একটা মহৎ গুণ হচ্ছে যে ব্যাপার ওর নয় তা নিয়ে কখনও ও মাথা ঘামায় না।
মাথা ঘামাক না ঘামাক, বিপাশা বিবাহের পর এ বাড়িতে এসে দেখেছিল—সর্বদা ছায়ার মত পরেশ ওদের আশেপাশে থাকলেও কথা খুব কম বলে। শান্ত, বিনয়ী, ভদ্র। তবু কেন যেন বিপাশার পরেশকে খুব ভাল লাগত না।
মানুষটার মুখখানা যেন পাথরে খোদাই করা। ভাবলেশহীন। সর্বক্ষণ অত বড় বাড়িটার মধ্যে যেন একটা ছায়ার মত বিচরণ করছে।
পরেশ অনন্যকে বলত কখনও দাদাবাবু—কখনও বাবু—আর বিপাশাকে বলত বৌদিমণি।
বিপাশার মনে হয়, পরেশ যখন এসে আগন্তুক সাহেবের কথা বলছিল—ওর দুচোখের দৃষ্টিতে যেন কি একটা ছিল।
বিপাশা নীচে নেমে এল সিঁড়ির নীচে সেই ছিমছাম আলোছায়ায় ভরা হলঘরটার মধ্যে। যেখানে পা দিলেই বিপাশার গা-টা যেন শিরশির করে ওঠে। বিরাট একটা স্টাফ করা রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে বিপাশা দেখতে গেল, মিলিটারী পোশাক পরা এক দীর্ঘকায় পুরুষ পিছন ফিরে। শেষ সিঁড়িটা অতিক্রম করবার আগেই বিপাশা দেখতে পেল, আগন্তুককে।
বিপাশার চপ্পলের মৃদু শব্দে আগন্তুক ঘুরে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে বিপাশা আগন্তুককে চিনতে পারে ঐ আলোছায়াতেই চিনতে তার এতটুকুও কষ্ট হল না। সত্যিই সে যেন একটু বিস্মিতই হয়।—তুমি! অর্ধস্ফুট শব্দটা বিপাশার গলা থেকে বের হয়ে এল যেন তার নিজের অজ্ঞাতেই।
হ্যাঁ, বিপাশা আমি—আগন্তুক সোজাসুজি তাকাল বিপাশার মুখের দিকে। আকস্মিকতার ধাক্কাটা একটু সামলে নিয়ে বিপাশা নিজেকে একটু যেন গুছিয়ে নেয়। সিঁড়ি থেকে নেমে সামনাসামনি এসে দাঁড়াল।
হঠাৎ কি মনে করে রজত? বিপাশা প্রশ্ন করল।
রজতশুভ্র মৃদু হাসল। বললে, আমি যে আবার আসব—আবার আমাদের পরস্পরের সঙ্গে দেখা হবে তুমি কি তা জানতে না বিপাশা!
আশা করিনি—
আশা করনি বুঝি?
না।
কেন?
সেদিনকার পর আবার তুমি আমার সামনে আসবে আমি ভাবতে পারিনি।
কেন ভাবতে পারনি?
ভাবাটাই তো স্বাভাবিক ছিল।
তোমার ভদ্রতা, তোমার সৌজন্যবোধ ও তোমার রুচির ওপরে আমি বিশ্বাস করেছিলাম বোধ হয়—
এখন আর বোধ হয় রাখতে পারছ না, তাই না বিপাশা?
না। যাক গে সেকথা-বল এবারে কেন এসেছ? হঠাৎ কি প্রয়োজন পড়ল আমার কাছে আবার আসার?
প্রয়োজন ছিল বলেই তো এলাম।
তুমিই বোধ হয় কাল সন্ধ্যায় এসেছিলে?
হ্যাঁ–নামটা বলিনি, তবে জানতাম নাম না বললেও তোমার বোঝার অসুবিধা হবে না কে এসেছিল!
বিপাশা রজতশুভ্রর কথার কোন জবাব দেয় না।
দেড় বছরে ট্রেনিং শেষ করে নতুন পোস্টিং পেয়েই কয়েক দিনের ছুটি নিয়ে কলকাতায় এসেছি। রজতশুভ্র বললে।
আমার কাছে কি দরকার?
তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি। কথাটা যেন অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবেই উচ্চারণ করল রজতশুভ্র। এতটুকু কম্পন বা দ্বিধা মাত্রও যেন তার গলার স্বরে বা উচ্চারণের মধ্যে নেই। কোথাও।
কি—কি বললে?
বললাম, তো, তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি—