ঝাঁকুনি দেয় বিপাশা স্বামীকে একটা।
আঃ—
অনন্য!
আঃ ছাড়—বিশ্বাস করি না আমি—সব—সব সমান–
কার কথা বলছ—কি বলছ?
কে?
আমি—আমি বিপাশা—
বিপাশা! কেমন বিস্ময়ের সঙ্গে অনন্য বিপাশার দিকে তাকাল।
হ্যাঁ হ্যাঁ, বিপাশা—
এত রাত্রে তুমি–তুমি এখনও ঘুমাওনি?
না। কেন, ঘুমোও নি কেন—ঘুমোও নি কেন বিপাশা?
তুমি শুয়ে পড়ো, রাত এখনও অনেক আছে
তুমি জেগে আছ কেন এখনও? গলার স্বরটা যেন অনন্যর কেমন, প্রশ্নের ভঙ্গিটা যেন কেমন–বিপাশার মনে হয় যেন ঠিক স্বাভাবিক নয়। বিপাশা ভাবে, হয়ত ঘুমের ঘোর এখনও ভাল করে কাটেনি।
অনন্য, শোও—শুয়ে পড়া। বিপাশা আবার বললে।
না। তুমি জেগে আছ কেন বিপাশা এত রাত্রেও তা তোকই বললে না। অনন্য আবার প্রশ্ন করল।
বিপাশা ভাবল একবার বলে, আমি তো আজকাল রোজ রাত্রেই এমনি করে জেগে থাকি–কিন্তু কথাটা বলল না বিপাশা, বললে, ঘুম আসছে না তাই–
ঘুম আসছে না, না—
বাঃ, ঘুম না আসলে কি করব?
কোথায় ছিলে?
কেন?
তাই জিজ্ঞাসা করছি—কোথায় ছিলে, এই ঘরে?
ব্যালকনিতে বসেছিলাম—
কটা রাত?
একটু আগে রাত দুটো বাজল।
অনন্য কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে বিপাশার মুখের দিকে চেয়ে থাকে, তারপর বলে, আমি, ঘুমোচ্ছিলাম
জানি।
আচ্ছা বিপাশা—
কি?
আজ কে এসেছিল আমাদের বাড়িতে বল তো?
কেমন করে জানব?
জান না তুমি?
বাঃ, দেখেছি নাকি তাকে!
আমি জানি কে এসেছিল—
কে?
রজতশুভ্রবাবু!
কি করে বুঝলে রজতই এসেছিল?
নিশ্চয়ই সে, তোমার সঙ্গে দেখা করতেই এসেছিল—
তা আমার সঙ্গে সে হঠাৎ দেখা করতে আসবে কেন?
পুরানো দিনের বন্ধু, আসলে ক্ষতিই বা কি–ক্ষতি তো নেই কিছু, দোষের কিছু নেই–
না, সে আর কোন দিন আসবে না আমার সামনে।
কি করে বুঝলে?
আমি জানি—আচ্ছা একটা কথা বলব?
কি?
আজ এতদিন পরে হঠাৎ রজতের কথা কেন?
একসময় তো তোমার বন্ধু ছিল, তাই না?
রজতের কথা তো সব তোমাকে বলেছিলাম। বিপাশা বললে।
প্রতি রাত্রে যে কুয়াশাটা আমাকে ঘিরে ধরে, তার মধ্যে অস্পষ্ট একটা মুখ আমি দেখতে পাই মাঝে মাঝে–
মুখ!
হ্যাঁ, কার জান?
কেমন করে বলবো–তুমি তো কখনও বলনি।
না বলিনি, আজ বলছি–কার মুখ দেখি জান?
কার?
আমার বাবার! আচ্ছা কেন দেখি বল তো?
কেমন করে বলব! রাত অনেক হল—তুমি এবার ঘুমোও।
তুমি ঘুমোবে না?
না।
কেন?
ঘুম আসছে না–
অনন্য আর কথা বলে না—শুয়ে পড়ে। এবং দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ে। বিপাশা চেয়ে থাকে ঘুমন্ত স্বামীর মুখের দিকে।
অনন্য হঠাৎ রজতের কথা বলছিল কেন? প্রশ্নটা বিপাশার মনের মধ্যে কেবলই ঘোরাফেরা করতে থাকে।
বাকি রাতটা বিপাশা একটা চেয়ারে বসেই কাটিয়ে দেয়।
০৬. অনন্যর যা কিছু অস্থিরতা
অনন্যর যা কিছু অস্থিরতা, মানসিক চাঞ্চল্য—সবই রাত্রে। রাত যত বাড়তে থাকে ততই যেন। কেমন ছটফট করতে থাকে। বোঝা যায় সে যেন কেমন চঞ্চল, অশান্ত, অস্থির-যতক্ষণ না ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে, ঐ একই অবস্থা চলতে থাকে। রাত দুটোয় ঘুম ভেঙে যায়, সে ঘর থেকে বের হয়ে যাবার চেষ্টা করে, কিন্তু বিপাশা জেগে থাকে বলে ঘর থেকে বেরুতে পারে না।
কিন্তু যতক্ষণ না অনন্য একটু সুস্থ হয়, ক্লান্তিতে অবসন্ন হয়ে পড়ে—বিপাশাকে যেন একটু যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয়, আবার ঘুমিয়ে পড়লে সে নিশ্চিন্ত, এবং মজা হচ্ছে সকালে ঘুম ভাঙার পর অনন্য যেন সম্পূর্ণ অন্য মানুষ।
ধীর-স্থির-শান্ত-বিপাশার সঙ্গে সম্পূর্ণ স্বাভাবিকভাবে কথা বলে, তাকে আদর করে, বার বার অকারণে ডাকে—বিপাশা! বিপাশা!
বিপাশা হয়ত পাশের ঘরে তখন কাজে ব্যস্ত, তবু স্বামীর ডাক কানে গেলেই সে ছুটে আসে। বলে, কি, ডাকছ কেন?
হাসতে হাসতে অনন্য বলে, না, এমনি–
এমনি ডাকছিলে?
হ্যাঁ, দেখছিলাম—
কি দেখছিলে?
তুমি কোথায়—
একদিন বলেছিল অনন্য, জান, বড় ভয় করে–
ভয়! কিসের ভয়?
তুমি যদি হারিয়ে যাও!
হারিয়ে যাব?
যদি যাও!
আচ্ছা পাগল তো—বিপাশা বলেছিল।
না, না–সত্যিই মনে হয়—হঠাৎ যদি তুমি কোথাও চলে যাও?
কোথায় আবার যাব?
যেতেও তো পার
না, যাব না।
সত্যি বলছ?
হ্যাঁ।
আজ চেয়ারে নিদ্রাহীন বসে বসে ঐ কথাগুলোই কেন যেন মনে পড়তে থাকে বিপাশার। তবু দিনের বেলাটা অনন্য যেন সম্পূর্ণ স্বাভাবিক।
একজন সুস্থ সবল মানুষ যেমন, ও যেন তেমনি।
অফিসে যায় ঠিক সময়ে।
অফিসের কাজকর্মের মধ্যে কখনও কোন অসংগতি ধরা পড়েনি। শোনাও যায়নি আজ পর্যন্ত সেরকম কোন কথা।
অন্তত বিপাশার কানে আসে নি।
মানুষের ঐ বয়সে কত বন্ধু থাকে—অনন্যর সেরকম কেউ নেই। মাত্র একজন প্রায়ই আসে তাদের বাড়িতে–নলিনাক্ষ সেন।
নলিনাক্ষ একটা মার্চেন্ট অফিসে সামান্য মাহিনায় চাকরি করে। বাবা-মা ভাইবোন অনেকগুলো পোষ্য নিয়ে নলিনাক্ষর সংসার। অনন্যর স্কুলের বন্ধু নলিনাক্ষ।
ধনীর পুত্র অনন্য আজ উচ্চশিক্ষিত এবং জীবনে নিজেও সুপ্রতিষ্ঠিত।
নলিনাক্ষ আজও জীবনযুদ্ধে পর্যদস্ত হয়ে চলেছে প্রতিদিন—প্রতি মুহূর্তে।
নলিনাক্ষ মধ্যে মধ্যে আসে এখানে—অনন্য ওকে পেলে খুব খুশি হয়। হৈ-চৈ করে গান গায়, হাসে-মজার মজার গল্প করে।
বিপাশারও খুব ভাল লাগে মানুষটাকে। তার মুখেই শুনেছে বিপাশা, অফিসে মানে ব্যাংকে অনন্য নাকি একেবারে অন্য মানুষ!
অনন্যর অসুস্থতার খবর নলিনাক্ষও জানে। কিছুটা অনন্য নিজেই বলেছে তাকে বিপাশাও কিছু কিছু বলেছে।
নলিনাক্ষ সব শুনে বলেছিল, তুমি কিছু ভেব না বৌদিও চিরদিনই একটু বেশী ভাবপ্রবণ, একটু সেন্টিমেন্টাল। তাছাড়া আর কোন দোষ নেই ওর মধ্যে সম্পূর্ণ সুস্থ ও স্বাভাবিক।