Site icon BnBoi.Com

মোমের আলো – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

মোমের আলো - নীহাররঞ্জন গুপ্ত

০১. যেমন ঝড় তেমনি বৃষ্টি

 

সারাটা রাত ধরে যেমন ঝড় তেমনি বৃষ্টি।

অবিশ্রান্ত বর্ষণের সঙ্গে সোঁ সোঁ হাওয়া।

আর সেই সঙ্গে ছিল থেকে থেকে মেঘের গুরু গুরু ডাক।

ঐ ঝড় জল বৃষ্টির মধ্যেই কোন এক সময় সম্ভবত ঘটনাটা ঘটেছে বলে অবনী সাহার ধারণা।

নাইট ডিউটি ছিল সুশান্ত চ্যাটার্জির।

ট্রেনের গার্ড সুশান্ত চ্যাটার্জি।

আগের দিন সকালে বের হয়ে গিয়েছিল ডিউটি দিতে, ফিরেছে পরের দিন খুব ভোরে।

ট্রেনটা ইন করেছিল অবিশ্যি রাত আড়াইটে নাগাদ এবং ডিউটিও সুশান্তর তখন শেষ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তখনো সে ফেরেনি, রেস্টিং রুমে নাকি সকাল হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিল।

পরে ভোর সাড়ে পাঁচটা নাগাদ সুশান্ত কোয়ার্টারে ফিরে এসেছে এবং ঘরে ঢুকেই থমকে নাকি দাঁড়িয়ে গিয়েছিল সে, শয্যায় শায়িতা স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে।

ওর স্ত্রী শকুন্তলা অবিশ্যি বেশ দীর্ঘকাল ধরেই নানা রোগে ভুগছিল এবং ইদানীং প্রায় শয্যাশায়ীই থাকত।

সংসারের কাজকর্ম কিছুই সে করতে পারত না।

মেজাজটাও যেন কেমন খিটখিটে হয়ে উঠেছিল এবং নিজে বেশির ভাগ সময়ই অসুস্থ থাকত বলে ঘরের কাজকর্ম দেখার জন্য মাস-ছয়েক আগে মিত্ৰাণীকে নিয়ে এসেছিল নিজেই স্বামীকে অনুরোধ করে মালদহ থেকে।

সুশান্ত নাকি প্রথমটায় রাজী হয়নি।

অবশেষে স্ত্রীর পীড়াপীড়িতে রাজী হয়েছিল।

শকুন্তলার দূরসম্পকীয়া বোন মিত্ৰাণী।

মালদহে ছিল, সেখান থেকেই তাকে আনানো হয়েছিল।

বাড়িতে প্রাণীর মধ্যে চারজন।

সুশান্ত—তার বৃদ্ধ হাঁপানির রোগী বাপ সুকান্ত, আট বছরের একটি ছেলে রাহুল, রুগ্না স্ত্রী শকুন্তলা আর ইদানীং মাস-ছয়েক হয় এসেছিল ওদের সংসারে মিত্ৰাণী-শকুন্তলার দুরসম্পর্কীয়া বোন।

.

সুশান্তর চিৎকারেই মিত্ৰাণী রান্নাঘর থেকে দৌড়ে আসে।

কি-কি হয়েছে জামাইবাবু? মিত্ৰাণী জিজ্ঞাসা করে।

মিত্রা, তোমার দিদি-সুশান্ত তার কথা শেষ করতে পারে না।

কি হয়েছে দিদির?

মিত্ৰাণী তখনও ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি।

মনে হচ্ছে বেঁচে নেই—দেখ—

সে কি! না না-মিত্ৰাণী তার দিদি শকুন্তলার মুখের দিকে তাকিয়ে যেন একটা অস্ফুট আর্তনাদ করে ওঠে।

হ্যাঁ, ছুঁয়ে দেখ, একেবারে ঠাণ্ডা-বরফ। মনে হচ্ছে সী ইজ ডেড–মারা গেছে—

সুশার কথায় মিত্ৰাণী যেন একেবারে বোবা পাথর হয়ে গিয়েছিল।

কী একটা অজ্ঞাত আতঙ্কে তার সমস্ত দেহ যেন তখন একেবারে হিম হয়ে গিয়েছে।

মিত্ৰাণী ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে যেন বোকার মতই কিছুক্ষণ সামনের দিকে।

শকুন্তলা এমনিতেই রীতিমত ফরসা, তার উপর দীর্ঘদিন ধরে ভুগে ভুগে কেমন যেন মোমের মত ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল।

রক্তহীন ফ্যাকাশে।

গালটা ভেঙে তুবড়ে গিয়েছিল। সেই তোবড়ানো গালে কোটরগত চোখের তারা দুটো যেন কি এক অজ্ঞাত জিজ্ঞাসায় ঠেলে বের হয়ে এসেছে।

শুধু জিজ্ঞাসা নয়, তার সঙ্গে যেন একটা বিভীষিকাও জড়িয়ে আছে।

রুক্ষ মাথার পর্যাপ্ত চুল বালিশের উপর পড়ে আছে।

ডান হাতটা দেখা যাচ্ছে না।

বাঁ হাতটা অসহায়ভাবে বালিশের উপর পড়ে আছে।

আর সেই হাতের পাশেই পড়ে আছে একটা ছোট শিশি।

লাল লেবেল আটা শিশির গায়ে লেখা ইংরেজীতে-পয়জন।

শকুন্তলা যে তখন আর বেঁচে নেই, সে যে মরে একেবারে ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে-সেটা বুঝতে মিত্ৰাণীরও কষ্ট হয়নি।

শকুন্তলার মুখের দিকে তাকাবার পরই সেটা বুঝতে পেরেছিল।

এবং বিষের শিশিটা তার পাশেই-শয্যার উপর তখনও পড়ে আছে। এটা বুঝতে কষ্ট হয় না, শকুন্তলা ঐ মালিশের ঔষধটা খেয়েই মারা গিয়েছে।

সত্যি সত্যিই মারা গিয়েছে, না আত্মহত্যা করেছে তার দিদি শকুন্তলা!

আত্মহত্যা? শকুন্তলা—তার দিদি আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু কেন আত্মহত্যা করেছে? হঠাৎ যেন একট কথা মনে হয় মিত্ৰাণীর।

কাল রাত্রে—

কাল রাত্রে শোবার আগে—

আকাশে প্রচণ্ড মেঘ করেছিল।

মেঘে মেঘে একেবারে আকাশটা কালো কালির মত হয়ে উঠেছিল যেন, মিত্ৰাণীর মনে পড়ছে।

বৃষ্টি হয়ত এখুনি নামবে।

তাই শোবার আগে মিত্ৰাণী কাজকর্ম সেরে তার দিদির ঘরে এসেছিল জানলাগুলো বন্ধ করে দিতে।

শকুন্তলা তখনো জেগেই ছিল।

যদিও রাত তখন প্রায় সাড়ে এগারোটা।

রাহুল অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে পড়েছে। পাশের ঘরে সুশান্তর বাবার থেকে থেকে কাশির শব্দ শোনা যাচ্ছিল।

শকুন্তলা যে তখনও ঘুমোয়নি মিত্ৰাণী সেটা জানত।

ইদানীং মাস-দুই প্রায়-বলতে গেলে শকুন্তলা সারাটা রাত ধরে জেগেই থাকত।

ঘুম একটা তার বড় হত না।

প্রথম প্রথম ঘুমের ঔষধ দিত, ইদানীং কিছুদিন কী যে হয়েছিল শকুন্তলার, ঘুমের ঔষধ কিছুতেই খেতে চাইত না।

সারারাত জেগে থাকবে তবু ঔষধ খাবে না কিছুতেই।

জিদ ধরে থাকত। ঘুমের ঔষধের কথা বললেই বলত, না, খাবো না, ঘুমের ঔষধ আমি খাবো না–

সুরেন ডাক্তার দীর্ঘদিনের পরিচিত ওদের।

সে হয়ত বলেছে, কেন—কেন খাবেন না?

না, খাবো না-চেঁচিয়ে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে প্রতিবাদ জানিয়েছে শকুন্তলা।

খেলে ঘুম হবে, ঘুমোতে পারলে দেখবেন অনেকটা সুস্থবোধ করছেন আপনি মিসেস চ্যাটার্জি। আপনার ঘুমের দরকার।

ডাক্তার বার বার চেষ্টা করেছেন।

না না, আমি খাব না, আপনি জানেন না—

সেই জিদ আর আপত্তি।

কি জানি না? ডাক্তার শুধিয়েছেন।

আসুন না, একটু কাছে সরে আসুন বলছি—

শকুন্তলা তখন বলেছে।

কৌতূহলে সুরেন ডাক্তার একটু কাছে এসে শুধিয়েছেন, কি বলুন তো? সুবিধা—

সুবিধা!

কি বলছেন?

সুবিধা হবে যে ওদের—

কাদের? কাদের সুবিধা হবে? সুরেন ডাক্তার আবার শুধিয়েছেন।

কেন, আমার স্বামীর আর ঐ কালসাপিনীর।

কি বলছেন আপনি মিসেস চ্যাটার্জি?

ঠিকই বলছি। ঘুমের মধ্যে ওরা আমাকে শাসরুদ্ধ করে মেরে ফেলবে–

না না, তাই কি হয়!

হয়, হয়—আপনি জানেন না।

সুরেন ডাক্তার বলেছেন, আপনি আবোলতাবোল ভাবছেন।

আবোলতাবোল ভাবছি, তাই না? আপনি জানেন না ডাক্তারবাবু, ওরা সেই সুযোগের অপেক্ষায়ই তো আছে। আর সেইজন্যই তো আমি ঘুমোই না, সারা-রাতই জেগে থাকি-চোখ মেলে।

ছি, কি যে বলেন মিসেস চ্যাটার্জি আপনি! মিঃ চ্যাটার্জি আপনাকে কত ভালবাসেন

ভালবাসেন! হুঁ! দিন পল মুহূর্ত গুনছে-কখন কবে আমি শেষ হয়ে যাব, কবে ও মিতুকে বিয়ে করবে—

.

সত্যি, ঐ এক ধারণা হয়ে গিয়েছিল ইদানীং শকুলার।

সুশান্ত আর মিত্ৰাণী—ওরা যেন দিবারাত্র ঐ চিন্তাই করছে।

কবে মরবে রুগ্না শকুন্তলা, আর ওরা নিশ্চিন্ত হয়ে হাত ধরাধরি করে হাসতে হাসতে সাজগোজ করে রেজিস্ট্রী অফিসে গিয়ে বিয়ে করে আসবে!

কথাটা সুশাই বলেছিল তার জবানবন্দিতে যেদিন থেকে মনের মধ্যে শকুন্তলার ঐ ধারণাটা বাসা বেঁধেছে-মনের মধ্যে যেন একটা বিষের ধোয়া পাক খেয়ে খেয়ে ফিরেছে।

প্রথম প্রথম মুখভার করে থেকেছে, তারপর একটু-আধটু হাবভাবে প্রকাশ করতে শুরু করেছে এবং ইদানীং মাস-দেড়েক হবে স্পষ্টাস্পষ্টিই তো বলতে শুরু করেছিল।

সুশান্তকে বলেছে, ভাবো বুঝি না-? তোমাদের মনের কথাটা বুঝতে পারি না-না? রোগে জীর্ণ হয়ে পঙ্গু হয়ে পড়ে আছি একটা ঘরের মধ্যে, তোমরা কি কর না কর কিছু টের পাই না, চোখে দেখি না বলে কানেও শুনি না?

সুশান্ত প্রথম প্রথম জবাব দেয়নি।

মৃদু মৃদু হেসেছে কেবল। কখনও কখনও হয়ত কৌতুক করে বলেছে, টের পাও সব, না কুন্ত?

হ্যাঁ হ্যাঁ-সব-সব টের পাই। দিন গুনছে কবে এ আপদ মরবে, আর তোমরা নিশ্চিত হয়ে হাত-ধরাধরি করে রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে বিয়ে করে আসবে।

কী করে বুঝলে বল তো? পুনরায় কৌতুকভরে শুধিয়েছে সুশান্ত স্ত্রীকে।

ও বুঝতে হয় না, বুঝলে? তোমরা পুরুষগুলো এত হ্যাংলা, নিষ্ঠুর, এত স্বার্থপর, এত নির্লজ্জ যে একটা অন্ধেরও সেটা চোখে পড়ে–

কার কার চোখে পড়েছে বল তো?

সবার—পৃথিবীসুদ্ধ সবার চোখে পড়েছে।

বল কি! সবাই তাহলে জেনে ফেলেছে ব্যাপারটা?

হ্যাঁ। কিন্তু জেনো, তা আমি হতে দেবো না। তোমাদের ওই সুখের আশায় আমি ছাই দিয়ে দেবো।

বেশ, তাই দিও।

দেবোই তো। এই মরা কঙ্কালসার দেহ নিয়েই আমি বেঁচে থাকব। আমি যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন তো আর বিয়ে করতে পারবে না!

কেন পারব না? সুশান্ত কৌতুক করে বলেছে, যদি আমি ডিভোর্স করি তোমায় অসুস্থ পঙ্গু বলে?

তাহলে—তাহলে তোমাকে আমি ঠিক জেনো তার আগে ফাঁসিকাঠে চড়াবার ব্যবস্থা করে যাব। নতুন করে আবার তুমি ঘর বাঁধবে তা আমি হতে দেব না-না-

অবশেষে শকুন্তলার ঐ মনোবিকৃতিতে ক্লান্ত হয়ে বলেছিল একদিন সুশান্ত, আচ্ছা এ পোকা তোমার মাথার মধ্যে কেমন করে ঢুকল বল তো কুন্ত? মিত্ৰাণীকে আমি বিয়ে করব এ তুমি কেমন করে ভাবতে পারলে?

তুমিই তো ভাবিয়েছ?

আমি?

হ্যাঁ হ্যাঁ–তুমি। কিসের তোমাদের অত হাসাহাসি, কিসের অত ফুসুরফুসুর গুজুরগুজুর কথা সর্বক্ষণ!

কে বলেছে তোমায় ঐ কথা?

মিথ্যা–মিথ্যা বলতে চাও?

আচ্ছা তুমি কি সত্যি-সত্যিই পাগল হলে কুন্ত! সুশান্ত বলেছে।

পাগল? তাই হতে পারলেই বোধ হয় ভাল হত!

আচ্ছা তোমার কি ধারণা বল তো? দুটো কথা কারো সঙ্গে বললেই—

বুকে হাত দিয়ে বল তো, সে কেবলমাত্র কথাই, আর কিছু নয় তোমার?

সুশান্ত চুপ করে থেকেছে।

কী, চুপ করে রইলে কেন? বল, তোমাদের মনে সত্যিই কোন পাপ নেই?

বিশ্বাস কর, সত্যিই–

তোমার ছেলের মাথায় হাত দিয়ে বলতে পার, তোমাদের দুজনের পরস্পরের মধ্যে–

কুন্ত, তুমি সর্পে রঞ্জুম করছেঐ সাপই তোমায় একদিন দংশন করবে জেনো।

 ০২. অবনী সাহা বলছিল কিরীটীকে

ব্যাপারটা যদিও প্লেন ও সিম্পল সুইসাইড কেস বলেই সকলের ধারণা হয়েছে, তবু কেন যেন অবনী মনে মনে ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে গ্রহণ করতে পারেনি।

অথচ মনের কথাটা কাউকে খুলেও বলতে পারে না।

হঠাৎ মনে পড়েছিল থানায় বসে কেসটার ডাইরী লিখতে লিখতে কিরীটীর কথা।

সন্ধ্যাবেলা তাই সোজা চলে এসেছিল কিরীটীর ওখানে।

কিরীটী তার বসবার ঘরে নিত্যকার মত দাবার ছক সাজিয়ে নিয়ে কৃষ্ণার সঙ্গেই খেলছিল।

আগে আগে কৃষ্ণার ঐ দাবা খেলাটা আদৌ ভাল লাগত না, কিন্তু ইদানীং বোধ হয় দাবা খেলায় রস পেতে শুরু করেছিল সে।

কিরীটী ডাকলেই বসে পড়ত টুলটা টেনে।

কিরীটীর অবিশ্যি তাতে করে সুবিধাই হয়েছে।

সে বলে, যাক, দাবাটা তাহলে নেহাত তোমার কাছে এখন একেবারে নিরস ব্যাপার বলে মনে হয় না কৃষ্ণা?

না।

কিন্তু কি করে এই অঘটন সম্ভবপর হল বল তো?

কি করে আবার? সঙ্গদোষে?

কৃষ্ণা হাসতে হাসতে বলেছে।

যা বলেছ। সঙ্গদোষে সাধুও চোর হয়ে যায়।

তা যায়, আবার চোরও সাধু হয়।

কিন্তু এবারে তোমার মন্ত্রী সামলাও, বোড়ের চাল দিতে দিতে কিরীটী বলে।

তার আগে এই নাও কিস্তি।

আর ঠিক সেই মুহূর্তে শ্রীমান জংলীর আবির্ভাব, বাবু।

কিরীটী বিহ্বলভাবে তখন কিস্তি সামলাতে ব্যস্ত।

মুখ না তুলেই বললে, আজ্ঞা করুন—

আজ্ঞে, অবনীবাবু এসেছেন।

কিরীটী পূর্ববৎ খেলার দিকে নজর রেখে বলে, কোন্ অবনী—সেন, চাটুয্যে, বাঁড়ুজ্যে, মিত্তির, না সাহা–

জিজ্ঞাসা করিনি তো!

জিজাসা করে এস তা হলে।

বাইরেই দাঁড়িয়ে আছেন আজ্ঞে।

জবাব দিল এবারে কৃষ্ণা, বললে, হ্যাঁ। ঘরে নিয়ে আয়।

জংলী বের হয়ে গেল।

বেলেঘাটা থানার ইন্ডার্জ অবনী সাহা প্রবেশ করল একটু পরেই ঘরে।

কি ব্যাপার? কিরীটী শুধায় এবং বলে, বসুন।

একটু দরকার ছিল।

কৃষ্ণা ততক্ষণে উঠে পড়েছে।

কৃষ্ণা, দু কাপ চা–অবনীবাবু চলবে তো?

আপত্তি নেই।

কৃষ্ণা অন্দরে অদৃশ্য হল।

পাইপটা ইতিমধ্যে নিভে গিয়েছিল। নতুন করে পাইপের গহ্বরে টোবাকো ঠাসতে ঠাসতে কিরীটী তাকাল অবনীর মুখের দিকে, মনে হচ্ছে যেন মিঃ সাহা, কোন জটিল সমস্যায় পড়েছেন?

না, সেরকম কিছু না, তবে—

তবে?

আমার এলাকায় একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। অবিশ্যি কাল রাত্রে কোন এক সময়। ডিটেকটেড হয়েছে আজ ভোর পাঁচটায়।

কি ব্যাপার–খুনটুন নাকি?

কিরীটী পাইপটায় লাইটারের সাহায্যে অগ্নিসংযোগ করল।

আপাতদৃষ্টিতে অবিশ্যি মনে হচ্ছে আত্মহত্যাই—এ কেস অফ সুইসাইড। তবে—

আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, আপনার মনটা যেন একটু খুঁতখুঁত করছে।

তাই।

স্ত্রী না পুরুষ?

স্ত্রী।

বয়স কত?

ওর স্বামীর স্টেটমেন্ট অনুযায়ী এই সাতাশ-আটাশ হবে।

তাহলে বিবাহিত?

হ্যাঁ।

জংলী দু কাপ চা নিয়ে এল ট্রেতে করে ঐ সময়।

একটা কাপ কিরীটী নিজে তুলে নিল, অন্যটা অবনীর দিকে এগিয়ে দিল, নিন।

চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কিরীটী বলে, স্বামীটী কেমন? তার সঙ্গে কথাবার্তা হয়েছে?

হয়েছে। সুশান্ত চ্যাটার্জি। ক্রিশ্চান, রেলের গার্ড, বেলেঘাটার কোয়ার্টারে থাকে। বাড়িতে কে কে আছে আর?

স্ত্রী শকুন্তলা আজ বছর দুই থেকে নানা রোগে ভুগছিল, বেশীর ভাগ সময়ই শয্যাগত থাকত এবং ইদানীং মাস-তিনেক একেবারেই শয্যাশায়িনী হয়ে পড়েছিল। হাঁপানী রোগী বুড়ো বাপ, একটি বছর আষ্টেকের ছেলে, আর–

আর?

আর আছে মিত্ৰাণী বলে একটি মেয়ে।

মেয়ে?

হ্যাঁ–মানে তরুণী, এই বছর কুড়ি-একুশ হবে বয়েস। ঐ শকুন্তলারই দূর-সম্পৰ্কীয় বোন। ওঁকে আবার শকুন্তলা নিজের সুবিধার জন্যই সংসারে নিয়ে এসেছিল। তারও সংসারে কেউ নেই, কাকার গৃহে আশ্রিতের মত একধারে পড়েছিল।

হুঁ। তাহলে দুর্ঘটনার মধ্যে এক তরুণীও আছে! তা দেখতে কেমন মহিলাটি?

মহিলাটি?

হুঁ।

মিত্ৰাণীর চেহারার একটা মোটামুটি বর্ণনা দেন অবনী সাহা।

কালো, রোগা, ছিপছিপে…কিন্তু কালোর উপর একটা অপূর্ব আলগা শ্ৰী আছে যেন মুখে ও চেহারায় মেয়েটির। অবনী বলে।

আর কিছু? কিরীটী শুধায়।

মেয়েটির আর একটি গুণ আছে-চমৎকার সেতার বাজায়।

আর? স্ব

ভাব শান্ত। মুখে বড় একটা কথাই নেই কখনও।

কিরীটী একটু থেমে আবার প্রশ্ন করে, বল তাহলে, যাকে বলে নিঃশব্দচারিণী!

কতকটা তাই।

হুঁ, তা ঐ সুশান্তর সঙ্গে তার শ্যালিকার সম্পর্কটি কেমন?

ঐখানেই তো আমার সন্দেহ!

কি রকম?

যদিও শকুন্তলাই বলে-কয়ে এনেছিল মিত্ৰাণীকে তার গৃহে-তারপর সে-ই হয়ে উঠেছিল ইদানীং একান্ত বিরূপ যেন ঐ মেয়েটির উপরে।

খুব স্বাভাবিক। নারীচরিত্র তো! সন্দেহ-তাই না?

হুঁ। স্বামীকে সে সন্দেহ করতে শুরু করল, তাতেই অশান্তি ক্রমশঃ বেড়ে ওঠে।

অবশেষে ঐ দুর্ঘটনায় ঐ পরিস্থিতি তো? কিরীটী বলে।

হ্যাঁ–কিন্তু কথা হচ্ছে এখন ব্যাপারটা বাইরে থেকে সুইসাইড মনে হলেও আমার কিন্তু কিরীটীবাবু মনে হচ্ছে কেন যেন কোথায় একটা গোলমাল আছে।

তা কি অসুখে ভুগছিলেন শকুন্তলা?

সুরেন ডাক্তারের সঙ্গে আমি কথা বলেছিলাম, তিনি বললেন-প্রথম দিকে ক্ষুতে ভুগছিলেন, পরে ব্যাপারটা দাঁড়িয়েছিল সম্পূর্ণ নিউরটিক–

কি রকম?

আসলে তাঁর মানে ডাক্তারের মতে কোন রোগই ছিল না, অথচ শকুন্তলা দেবীর ধারণা হয়ে গিয়েছিল, পা দুটো তার প্যারালিসিস হয়ে গিয়েছে। কোন শক্তি নেই পায়ে। হাঁটাচলা একেবারে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সম্পূর্ণভাবে শয্যাশায়িনী হয়ে পড়েছিল।

তারপর?

সুরেন ডাক্তার তাকে বোঝাবার অনেক চেষ্টা করেছেন, কিন্তু শকুন্তলা দেবীকে কিছুতেই বোঝাতে পারেননি যে তাঁর পায়ে কোন রোগ নেই। ইচ্ছা করলেই তিনি হাঁটতে পারবেন।

মানসিক রোগ এক এক সময় এমনিই কঠিন হয় বটে। আচ্ছা অবনীবাবু—

বলুন?

সুশান্ত ও মিত্ৰাণীর মধ্যে রিলেশানটা কেমন?

যতদূর জানতে পেরেছি খুব প্রীতির এবং স্নেহের। শ্যালিকা ও ভগ্নীপতির যেমন হয়।

হুঁ। তা মিত্ৰাণীর জবানবন্দি থেকে কিছু জানা গেল না?

অবনী প্রশ্ন করেছিলেন নানাভাবে মিত্ৰাণীকে।

আপনি তার সেবা-শুশ্রূষা করতেন?

হ্যাঁ।

যদিও ইদানীং মিত্ৰাণীকে একেবারে সহ্য করতে পারত না শকুন্তলা, তথাপি একমুহূর্ত মিত্ৰাণীকে না হলে চলতও না শকুন্তলার।

কেবলই থেকে থেকে ডেকে উঠত,-মিতা-মিতা—

মিত্ৰাণী ছুটে ছুটে আসত, ডাকছিলে দিদি?

কি করা হচ্ছিল মহারাণীর? গলা চিরে গেল ডেকে ডেকে–সাড়া নেই—

দুধ এনে দেবো, খাবে?

দুধ! এক বাটি বিষ এনে দাও। তাই তো মনে মনে চাইছ তোমরা সর্বক্ষণ—কখন এ আপদ মরবে!

মিত্ৰাণী মৃদু মৃদু হেসেছে।

গায়ে মাখেনি কোন তিরষ্কার মিত্ৰাণী তবু।

দুধ এনে বলেছে, খেয়ে নাও দিদি দুধটা।

আগে ঐ বিড়ালকে একটু দে ঐ দুধ থেকে, তারপর খাব। কই, দে!

ভয় নেই তোমার, এতে বিষ নেই।

যা বলছি তাই শোন।

শেষ পর্যন্ত বিড়ালকে দুধ খাওয়াবার পর তবে সেই দুধ খেয়েছে শকুন্তলা।

কখনও আবার জিজ্ঞাসা করেছে, কাল সারারাত ধরে অত ফুসুরফুসুর কার সঙ্গে করছিলি?

কার সঙ্গে আবার করব? মিত্ৰাণী বলেছে।

ঢাকবার চেষ্টা করিস না মিতা, তোর জামাইবাবুর সঙ্গে আমি জানি সারারাত কথা বলেছিস!

জামাইবাবুর তো কাল নাইট-ডিউটি ছিল।

দেখ, মিথ্যা বলিস না। আমি জানি ও কাল ডিউটিতেই যায়নি।

মিত্ৰাণী আর কি বলবে, চুপ করে থেকেছে।

চুপ না করে থাকা ছাড়া আর উপায়ই বা কি!

তারপর? কিরীটী শুধায়।

অবনী বলল, এ ধরনের টচারের একটা সীমা আছে। তাই আমার মনে হয়—হয়ত ঐ সুশান্ত, শকুন্তলার স্বামী, শেষ পর্যন্ত ডেসপারেট হয়ে–

নিজের স্ত্রীকে বিষ দিয়ে হত্যা করেছে।

অসম্ভব কি কিছু?

না, তা নয়। তবে—

কি?

অবনী কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল।

আচ্ছা এখন সুশান্তবাবুর ওখানে গেলে তার সঙ্গে দেখা হতে পারে?

পারে। কারণ আমি তাকে দুদিন বাড়িতেই সর্বক্ষণ থাকতে বলে এসেছি।

তবে চলুন না একবার সুশান্তবাবুর ওখান থেকে ঘুরে আসা যাক।

বেশ তো চলুন।

০৩. সুশান্ত চ্যাটার্জি গৃহেই ছিল

সুশান্ত চ্যাটার্জি গৃহেই ছিল।

পর পর সব এক সাইজের এক প্যাটার্নের কোয়ার্টার। ১৮নং কোয়াটারই সুশান্ত চ্যাটার্জির। বাইরে থেকে কোন আলো দেখা যায় না। অন্ধকার।

ওরা গাড়ি থেকে নেমে নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে গেট ঠেলে দুজনে বারান্দার দিকে অগ্রসর হতেই অন্ধকারে আবছা দুটো ছায়ামূর্তি পাশাপাশি চেয়ারের উপর বসে আছে চোখে পড়ল এবং একজন তার মধ্যে সঙ্গে সঙ্গে বোধ হয় ওদের গেট দিয়ে ঢুকতে দেখে উঠে দাঁড়াল।

ঐ সঙ্গে অস্পষ্ট নারীকণ্ঠে শোনা গেল, জামাইবাবু, কারা যেন আসছে—

পুরুষকণ্ঠে প্রশ্ন আসে, কে?

জবাব দেয় অবনী সাহা, সুশান্তবাবু আমি অবনী সাহা, থানার ওসি।

সঙ্গে সঙ্গে বারান্দার ইলেকট্রিক আলো জ্বলে উঠল।

কিরীটীর নজরে পড়ল, সামনেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে বত্রিশ-তেত্রিশ বৎসরের এক যুবক।

যুবকের চেহারাটি সত্যিই সুন্দর। রোগা পাতলা চেহারা। গাত্রবর্ণ রীতিমত গৌর। মাথায়। কোঁকড়া কোঁকড়া চুল। মুখখানি একটু লম্বাটে ধরনের। চোখ দুটো ভাসা-ভাসা। দেখলেই মনে হয় যেন সরল গোবেচারা গোছের মানুষ।

সমস্ত মুখখানি যেন কেমন বিষণ্ণ, ক্লান্ত। পরনে পায়জামা ও পাঞ্জাবি। পায়ে রবারের চপ্পল।

আসুন অবনীবাবু, বসুন।

সুশান্ত চ্যাটার্জি আহ্বান জানায়।

আজ ডিউটিতে তাহলে যাননি?

না। আপনিই তো বারণ করে গিয়েছেন। সাত দিনের ছুটি নিয়েছি।

খুব ভাল করেছেন। মনের এ অবস্থায় ডিউটি ভাল করে করতেও পারতেন না।

ডিউটি গত দেড় মাস থেকেই তো ভাল ভাবে করতে পারিনি! কেন? প্রশ্ন করেন অবনী।

কেন আর? শকুন্তলার জন্য।

ও সত্যিই ইদানীং জীবনটা আমার একেবারে যেন দুর্বিষহ করে তুলেছিল। কী জানেন অবনীবাবু, যদিও এটা ক্রুয়েল তবু অকপটে বলছি, ও যদি নিজে থেকেই বিষ খেয়ে সুইসাইড না করত-শেষ পর্যন্ত একদিন আমিই ওর গলা টিপে হত্যা করে ফাঁসি যেতাম!

ছি ছি, কী বলছেন মিঃ চ্যাটার্জি?

কথাটা এতটুকু মিথ্যা নয়। ও যে ইদানীং কী ভাবে অত্যাচার করত আমাদের ওপর-অথচ সমস্ত ব্যাপারটা বেসলেস একেবারে, সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। সবই তো সকালে আপনাকে বলেছি মিঃ সাহা।

হ্যাঁ, বলেছেন বটে।

বসুন না, দাঁড়িয়ে রইলেন কেন?

অবনী ও কিরীটী দুজনে দুটো চেয়ার টেনে বসে।

একটু বসুন, মিতাকে দু কাপ চায়ের কথা বলে আসি।

বাধা দিল কিরীটী, না না, মিঃ চ্যাটার্জি, বসুন, তার কোন প্রয়োজন নেই। এইমাত্র চা খেয়ে আসছি। বসুন আপনি।

ওঁকে তো চিনতে পারছি না, মিঃ সাহা?

অবনী মিথ্যা কথা বললেন, আমাদেরই একজন লোক, মিঃ রায়।

ও।

উনি আপনাদের কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে চান। অবনী বলেন।

কী কথা?

কিরীটীই এবারে জবাব দিল, এমন বিশেষ কিছু না। সে হবেখন। তার আগে শকুলা দেবী যে ঘরে ছিলেন সেই ঘরটা একবার দেখতে চাই মিঃ চ্যাটার্জি।

বেশ তো, চলুন।

.

রেলওয়ে কোয়ার্টার যেমন হয়।

সামনে ছোট একটি বারান্দা, তারপরই পূর্ব-মুখে একটা বড় সাইজের ঘর, লাগোয়া একটা বারান্দা। ও ছোট্ট একটা স্টোর-রুম।

বারান্দার একদিকে রান্নাঘর, অন্যদিকে পাশাপাশি দুটো ঘর, তার মধ্যে একটা ঘরের দরজায় তালা দেওয়া ছিল।

অন্য ঘরটার দরজা খোলা, ভিতরে আলো জ্বলছিল। ঘরের দরজায় পর্দা ঝুলছে, ভিতরটা নজরে পড়ে না। অবনী বললেন, তালা-দেওয়া ঐ ঘরটাতেই শকুন্তলা দেবী ছিলেন।

তালা দিল কে? কিরীটী শুধায়।

আমিই যাবার সময় তালা দিয়ে গিয়েছিলাম আজ সকালে।

অবনী পকেট থেকে চাবি বের করে ঘরের তালাটা খুলে দিলেন। তিনজনে অতঃপর ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে।

ঘরটা অন্ধকার।

আলোটা জ্বালুন, অবনীবাবু।

সুশান্তই সুইচ টিপে ঘরের আলোটা জ্বালাবার চেষ্টা করল কিন্তু আলো জ্বলল না, খুট করে একটা শব্দ হল মাত্র।

সুশান্ত বললে, ঘরের বাটা বোধ হয় ফিউজ হয়ে গিয়েছে!

কাল এ ঘরে আলো জ্বলেনি? কিরীটী ঐসময় শুধায়।

না। সুশান্ত বলে।

কেন?

ইলেকট্রিক আলো ইদানীং কুন্ত চোখে সহ্য করতে পারত না বলে ঘরে একটা মোমবাতি জ্বালানো থাকত।

মোমবাতি!

হ্যাঁ, দাঁড়ান, মোমবাতিটা জ্বেলে দিই।

অন্ধকারেই এগিয়ে গেল সুশান্ত এবং অনায়াসেই পাশ থেকে দেশালাইটা নিয়ে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে দিল।

নরম স্নিগ্ধ মোমের আলোয় ঘরটা মৃদুভাবে আলোকিত হয়ে উঠল ধীরে ধীরে।

কিরীটী চেয়ে দেখল, একটা বড় সাইজের মোমবাতি—প্রায় অর্ধেকেরও বেশী পুড়ে গিয়েছে।

একটা কাঠের চেস্ট-ড্রয়ারের উপর একটা ভাঙা কাঁচের প্লেটের উপরে মোমবাতিটা বসানো।

মাঝারি আকারের ঘরটা।

দুটি দরজা। একটি দরজা বন্ধ। বোধ হয় পাশের ঘরের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে। অন্যটি দিয়ে তারা একটু পূর্বে ভিতরে প্রবেশ করেছে।

তিনটি জানালা। দুটি দক্ষিণ দিকে, বন্ধ। অন্যটি পশ্চিম দিকে অন্দরমুখী।

সব কটি জানালাই বন্ধ ছিল। আসবাবপত্র ঘরে সামান্যই।

একটা শূন্য খাট, তার পাশে একটা গোলাকার টেবিল, তার উপরে কিছু ঔষধপত্রের শিশি, হরলিকসের বোতল, একটা জলের গ্লাস ও কাপ তখনও রয়েছে দেখা গেল।

পশ্চিম দিকে দেওয়াল ঘেঁষে একটা আলমারি—প্রমাণ সাইজের আয়না বসানো। তার পাশে একটা আলনায় কিছু শাড়ি ঝুলছে।

দেওয়ালের গায়ে একটা ক্যাম্প খাট ফোল্ড করা রয়েছে। একটি চেয়ার ও একটি টুল।

এ ঘরে কি একা শকুন্তলা দেবীই থাকতেন? কিরীটী প্রশ্ন করে।

না, আমিও থাকতাম। ঐ ক্যাম্প খাটটা পেতে আমিও এই ঘরেই শুতাম যখন বাড়িতে থাকতাম। জবাব দেয় সুশান্ত।

আর আপনার ছেলে রাহুল?

সে তার মাসীমণির কাছেই এখানে আসা অবধি শোয়।

মানে মিত্ৰাণী দেবীর সঙ্গে?

হ্যাঁ। আপনার ছেলে বাড়িতে নেই?

আছে। সকাল থেকে ওর জ্বর।

জ্বর!

হ্যাঁ, খুব জ্বর। মাঝে মাঝে ভুল বকছে।

ডাক্তার আসেননি?

হ্যাঁ। সুরেন ডাক্তার এসেছিল। ঔষধ দিয়ে গিয়েছে।

কিরীটী এবার বলে, চলুন, একবার পাশের ঘরটা দেখব যে ঘরে মিত্ৰাণী দেবী থাকেন। চলুন। সুশান্ত বলে।

০৪. পাশের ঘরটি

পাশের ঘরটিও ঠিক বলতে গেলে একই সাইজের।

একটি খাটের উপর রাহুল চোখ বুজে শুয়ে মধ্যে মধ্যে জ্বরের ঘোরে বিড়বিড় করে ভুল বকছে।

কিরীটী শয্যায় শায়িত ছেলেটির দিকে তাকাল। ছেলেটি ভারী রুগ্ন। তার বাপের ফর্সা রং পায়নি। কালো। শয্যার একপাশে মিত্ৰাণী বসেছিল চুপচাপ। ওদের ঘরে ঢুকতে দেখে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ায়।

কিরীটী তাড়াতাড়ি বলে, না না, আপনাকে উঠতে হবে না, আপনি বসুন।

মিত্ৰাণী কিন্তু বসে না, দাঁড়িয়েই থাকে। কিরীটী চেয়ে দেখে মিত্ৰাণীর দিকে।

অবনীবাবু ঠিকই বর্ণনা দিয়েছিলেন মেয়েটির চেহারার।

রোগা, পাতলা এবং কালোর উপরে ভারি চমৎকার দেখতে। চোখে-মুখে যেন একটা অপূর্ব শ্রী।

মুহূর্তের জন্য চোখাচোখি হয় কিরীটীর সঙ্গে।

মিত্ৰাণী সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি ভূমিতলে নিবদ্ধ করে। কিন্তু সেই মুহূর্তের চাউনিতেই বুঝতে কষ্ট হয় না কিরীটীর, তীক্ষ্ণ বুদ্ধির দীপ্তি যেন চোখের মণি দুটো থেকে উঁকি দিচ্ছে মেয়েটির।

পরনে মলিন একটা রঙিন জলড়ুরে শাড়ি। বগল-কাটা ব্লাউস গায়ে। হাতে একগাছা করে সোনার রুলি। আর দেহের কোথাও কোন গহনা নেই।

মাথার চুল রুক্ষ, কিন্তু পর্যাপ্ত চুল মাথায়।

ঘরে আসবাবপত্রের মধ্যে একটি বড় সাইজের খাট, একটি দেরাজ এবং দেরাজের পাশেই একটি দরজা।

এ ঘরে তিনটি দরজা।

একটা দিয়ে তারা ঘরে এসেছে, একটা দুই ঘরের মধ্যবর্তী। সেটা এদিক থেকে বন্ধ। অন্যটা দক্ষিণ দেওয়ালে দেরাজের পাশে, সেটাও বন্ধ ছিল।

অন্য দিকের দেওয়ালে একটা আলনা ও ছোট একটা ড্রেসিং টেবিল।

কিরীটী দক্ষিণের দরজাটার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, ঐ দরজাটা?

সুশান্ত বলে, ওটা হচ্ছে এ বাড়ির পিছনে যাবার। ওদিকে একটা ছোট বাগান মত আছে।

দরজাটা ব্যবহার হয় তাহলে বলুন?

সুশান্ত বলে, তা হয় বোধ হয় মধ্যে মধ্যে।

কে ব্যবহার করেন, আপনি?

না, আমি ওদিকে বড় একটা যাই না।

কিরীটী এবারে ঘুরে তাকাল মিত্ৰাণীর দিকে, আপনি?

আমি?

হ্যাঁ, আপনি ব্যবহার করেন ঐ দরজা?

তা মধ্যে মধ্যে করি।

কথা বলতে বলতেই হঠাৎ কিরীটী নীচু হয়ে খাটের নীচে থেকে একটা সিগারেটের টুকরোর শেষাংশ কুড়িয়ে গেল।

মিঃ চ্যাটার্জি।

বলুন?

আপনি তো সিগারেট খান, কি ব্র্যাণ্ড খান?

আমি-আমি তো স্মোক করি না!

করেন না?

না।

কখনও মধ্যে-সধ্যেও না?

না। তবে এককালে ছিল, এখন আর—

ড্রিংক করেন?

মধ্যে মধ্যে করি।

একটু যেন ইতস্তত করেই কথাটা বলেন সুশান্ত চ্যাটার্জি।

ঐসময় বিড়বিড় করে রাহুল বলে ওঠে, মাসীমণি, বড় অন্ধকার-আলোটা জ্বালো না। তারপরই চেচিয়ে ওঠে কেমন যেন ভয়ার্ত কণ্ঠে, কে-কে-কে ওখানে মাসীমণি? কে?

মিত্ৰাণী তাড়াতাড়ি ঝুঁকে পড়ে রাহুলের সামনে, কই, কেউ তো নয় বাবা, কেউ নয়, তুমি ঘুমাও।

রাহুল আবার শান্ত হয়ে যায়।

কিরীটী এগিয়ে গিয়ে রাহুলের কপাল স্পর্শ করে, জুরে যেন একেবারে পুড়ে যাচ্ছে ছেলেটার গা। খুব কম হলেও একশো চার ডিগ্রীর নীচে নয়।

মিত্ৰাণী দেবী!

কিরীটীর ডাকে মিত্ৰাণী চোখ তুলে তাকাল ওর দিকে।

রাহুলের গায়ের চাদরটা ঠিক করে দিচ্ছিল মিত্ৰাণী।

এ ঘরটা ঝাঁট দেওয়া হয়নি কদিন?

অ্যাঁ! কি বললেন?

এ ঘরটা ঝট দেওয়া হয়নি কদিন?

পরশুও তো ঝাট দিয়েছি। আজ অবিশ্যি দেওয়া হয়নি এখনো পর্যন্ত।

তাহলে পরশুও ঝাট দিয়েছেন!

হ্যাঁ, বিকেলে।

আপনিই দেন বোধ হয়?

হ্যাঁ, আমিই দিই।

কেন, ঝি নেই?

হ্যাঁ, একজন ভোলা ঝি আছে। ইদানীং কিছুদিন হল আমাদের পুরনো ঝি ছুটি নিয়ে মাস-দুয়েকের জন্য দেশে গিয়েছে, নতুন বি ওসব করতে চায় না।

আচ্ছা মিত্ৰাণী দেবী, আজ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অবনীবাবু ও সুশান্তবাবু ছাড়া আর কোন তৃতীয় ব্যক্তি এখানে এসেছিলেন?

কই না!

ভালো করে মনে করে দেখুন?

এবারে জবাব দিল সুশান্ত, কে আসবে এখানে মিঃ রায়? সকাল থেকে যা দুর্যোগ চলেছে-তাছাড়া আমার বাড়িতে কেউ এলেও এ ঘরে কেন আসবে?

কিন্তু আসতেও তো পারে মিঃ চ্যাটার্জি! শান্ত কণ্ঠে একটা পাইপ পকেট থেকে বের করে সেটায় তামাক ভরতে ভরতে বলে কিরীটী।

কি বলছেন আপনি?

ঠিকই বলছি মিঃ চ্যাটার্জি। আজ সারাদিন যদি কেউ না এসে থাকেনও, পরশু বিকেল থেকে রাতের মধ্যে অর্থাৎ ঐ বারো ঘণ্টার মধ্যে আপনার কোয়ার্টারের এই ঘরে কেউ যে এসেছিল সে সম্পর্কে আমি নিঃসন্দেহ।

কিন্তু।

শুনুন মিঃ চ্যাটার্জি, আপনি হয়ত জানেন না, কিন্তু মিত্ৰাণী দেবী নিশ্চয়ই জানেন-তাই ওঁকেই তো কথাটা জিজ্ঞাসা করছি। কি মিত্ৰাণী দেবী, আসেননি কেউ?

শান্ত ধীর কণ্ঠে জবাব দেয় মিত্ৰাণী, না।

ঠিক বলছেন?

হ্যাঁ।

কেউ আসেননি তাহলে?

না।

কিরীটী ক্ষণকাল নিস্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল মিত্ৰাণীর দিকে। মনে হল ঈষৎ বাঁকা ঠোঁটের কোণে যেন একটা চাপা হাসির বিদ্যুৎ খেলছে।

তারপর ধীরে ধীরে আবার তাকাল সুশান্তর দিকে।

সুশান্তবাবু!

কিছু বলছেন?

হ্যাঁ। আজ শনিবার—আপনি তো বৃহস্পতিবার অর্থাৎ পরশু সকালেই ডিউটিতে বের হয়ে যান?

হাঁ।

বেলা তখন কটা হবে?

সকাল পৌনে নটা।

আপনার ডিউটি ছিল কটা থেকে?

দশটা থেকে।

ফিরেছেন আপনি আজ সকালে?

হ্যাঁ। কখন ডিউটি শেষ হল?

ডিউটি অবিশ্যি আমার সন্ধ্যাতেই শেষ হবার কথা, কিন্তু ট্রেনের লেটের জন্য ফিরেছি আমি রাত প্রায় আড়াইটায়–

তখন বাড়ি আসেননি?

না। কেন?

রেস্টিং রুমেই শুয়েছিলাম আমি, আর—আর একজন টি. টি. আই., অত রাত্রে আর বাড়ি আসতে ইচ্ছা করল না বলে। তাছাড়া–

তাছাড়া? বাড়িতে এলেই তো সেই অশান্তি। তাই—

তাই যতটা সম্ভব বাড়ি এড়িয়ে চলতেন?

তাই।

কিরীটী আর কোন কথা বলল না।

এগিয়ে গিয়ে দক্ষিণ দিকের যে দরজাটা বন্ধ ছিল ভিতর থেকে, সেটা খুলে বাইরে পা বাড়াল।

ছোট একফালি জমি। সীমানায় কাঁটাতারের বেড়া। তার ওদিকে সরু একটা রাস্ত। তারও ওদিকে রেলওয়ে ইয়ার্ড। কিছু ফুলের গাছ আছে। অরক্ষিত।

শুধু একটা টগর গাছে রাশি রাশি সাদা ফুল ফুটে আছে।

হঠাৎ নজরে পড়ল কিরীটীর, গতরাত্রে প্রচণ্ড বৃষ্টি হয়ে জমি নরম হয়ে গিয়েছিল, এখানে ওখানে কিছু জল জমে আছে আর নরম কাদা তখনও।

নরম কাদায় এলোমেলো কিছু জুতোর ছাপ রয়েছে। কিরীটী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জুতোর ছাপগুলো পরীক্ষা করে দেখল। এক ধরনের জুতোর ছাপ নয়, দুরকমের জুতোর ছাপ পড়েছে।

তার মধ্যে একটা হালকা, অন্যটা যেন ভারী, চেপে বসেছে। একটা কিছু অস্পষ্ট, অন্যটা বেশ স্পষ্ট।

একটা মনে হয় চামড়ার সোলের, অন্যটা মনে হয় রবার সোলের কেডস্ জাতীয় কোন জুতোর ছাপ যেন।

কিরীটী ফিরে এল আবার ঘরে।

চলুন অবনীবাবু।

সকলে বের হয়ে এল অতঃপর ঘর থেকে।

বারান্দা দিয়ে যেতে যেতে কয়েক জোড়া জুতোর উপরে নজর পড়ল কিরীটীর।

চার-পাঁচটা জেন্টস, লেডিস, ও বাচ্চার জুতো, তার মধ্যে একজোড়া ব্রাউন রঙের ভারী সোলের জুতোও রয়েছে।

মুহূর্তের জন্য থামল কিরীটী।

ভাল করে নজরে করে দেখল ভারী ব্রাউন জুতোজোড়া। জুতোর সোলে তখনও কাদা শুকিয়ে আছে। মিঃ চ্যাটার্জি।

বলুন?

ঐ ব্রাউন ভারী সোলের জুতোজোড়া নিশ্চয়ই আপনার?

হ্যাঁ।

পরশু ডিউটিতে কোন্ জুতো পরে গিয়েছিলেন? ঐ জুতোজাড়াই বোধ হয়?

হ্যাঁ।

বুঝতে পেরেছিলাম! চলুন অবনীবাবু।

কিছু বলছেন?

না। ভাল কথা, পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা কখন পাওয়া যাবে?

কাল পেতে পারি বিকেল নাগাদ। অবনী জবাব দেন।

রিপোর্ট পেলে একবার আমার ওখানে আসবেন?

নিশ্চয়ই।

চলুন রাত হল, এবারে ফেরা যাক।

কিরীটীর কথায় যেন মনে হল অবনী সাহা একটু অসন্তুষ্ট হয়েছেন কিন্তু মুখে সেটা প্রকাশ করেন না।

কিরীটীর সঙ্গে সঙ্গে কোয়ার্টার থেকে বের হয়ে আসেন।

অবনীর জীপেই ফিরছিল ওরা। অবনী জীপ চালাচ্ছিলেন, কিরীটী পাশে বসেছিল। রাত মন্দ হয়নি তখন—প্রায় পৌনে নটা। তাহলেও কলকাতা তখন রীতিমত প্রাণচঞ্চল। আলোকিত, শব্দ-মুখরিত, যানবাহন ও মানুষের ভিড়ে চঞ্চল শব্দময়ী কলকাতা।

অবনী সাহা মৃদুকণ্ঠে ডাকেন, কিরীটীবাবু!

উঁ?

কী মনে হল আপনার?

 ০৫. অবনী সাহা উৎসুক দৃষ্টিতে

অবনী সাহা উৎসুক দৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করেন।

কিসের?

মানে বলছিলাম ঐ সুশান্ত চ্যাটার্জি আর মিত্ৰাণীকে—

একটা কথাই ওদের সম্পর্কে মনে হচ্ছে আপাততঃ—

কী?

ভাবছি, দুজনেই যেন মনে হল মিথ্যা কথা বলল।

মিথ্যা কথা!

হুঁ। সুশান্ত ও মিত্ৰাণী দেবী মনে হচ্ছে দুজনেই মিথ্যা বলছে!

কি মিথ্যা বলেছে?

প্রথমতঃ আমার মনে হচ্ছে, কাল রাত্রে—মানে ভোর হবার অনেক আগেই সুশান্ত কোন একসময় বাড়ি ফিরেছিল।

আপনার তাই মনে হয়? হ্যাঁ, তাই। তারপর আবার ফিরে গিয়ে ভোরনাগাদ কোয়ার্টারে ফিরে এসেছে আজ।

কিন্তু–

ভাবছেন সে বলেছে যে রাত আড়াইটের ডিউটি থেকে ফিরে অশান্তির ভয়ে ভোররাত পর্যন্ত স্টেশনের রেস্টিং রুমে ছিল! তা কিন্তু নয় বলেই আমার মনে হয়, যদিও তার অ্যালিবিটা খুব স্ট্রং।

তা যদি সত্যিই হয় তো সেটা তো অনায়াসেই আমরা খোঁজ নিয়ে জানতে পারব।

না, তা হয়ত পারবেন না।

পারব না?

ন।

কেন, না?

যেহেতু তার ব্রাদার অফিসার, যে কাল রাত্রে ওর সঙ্গে একই স্টেশনে রেস্টিং রুমে ছিল, সে হয়ত সত্যিই ঘুমিয়ে ছিল।

কি বলছেন?

ঠিক তাই অবনীবাবু, তার ঘুমের মধ্যেই কোন এক সময় তো অনায়াসেই সুশান্তবাবু উঠে আসতে পারে তার কোয়াটারে, তারপর আবার ফিরে যেতে পারে ইচ্ছা করলে। ধরুন যদি ঐসময় অন্যজনের ঘুম ভেঙেও যেত, সে কখনই মনে করতে পারত না যে সুশান্তবাবু ইতিমধ্যে তার কোয়ার্টারে গিয়ে ফিরে আসতে পারে এবং—সে যাই হোক সুশান্তবাবু যে এসেছিল রাত আড়াইটে থেকে ভোর সাড়ে চারটে এই দুই ঘণ্টার মধ্যে কোন এক সময় তার কোয়ার্টারে সে বিষয়ে আমি অন্ততঃ নিঃসন্দেহ। কিন্তু এখন কথা হচ্ছে, কেন-কেন এসেছিল? আবার ফিরেই বা গিয়েছিল কেন?

কেন?

সেই তো ভাবছি!

অবিশ্যি দুটো কারণ তার থাকতে পারে।

কি-কি?

আপনিও একটু চিন্তা করলে সে কারণ দুটো খুঁজে পাবেন।

কিরীটী যেন ইচ্ছে করেই প্রশ্নটা এড়িয়ে প্রসঙ্গান্তরে চলে গেল।

বললে, তাই বলছিলাম, সুশান্তবাবু যেমন মিথ্যা বলেছে, তেমনি মিত্ৰাণী দেবীও মিথ্যা বলেছে যে কাল রাত্রে তার ঘরে সুশান্তবাবু ও আপনি ছাড়া আর তৃতীয় কোন ব্যক্তি যায়নি।

তবে—

তাই তো ভাবছি, কে সে? কে যেতে পারে কাল কোন এক সময় রাত্রে তার ঘরে?

কেন, আপনি যা বলছেন তাতে তো সুশান্তবাবুও সেই লোক হতে পারেন!

পারে না যে তা নয়, তবে—

কী, তবে?

মনে হয় না সে ব্যক্তি সুশান্তবাবু!

তাহলে আপনি বলতে চান যে সত্যিই কোন তৃতীয় ব্যক্তি কাল রাত্রে মিত্ৰাণীর ঘরে প্রবেশ করেছিল?

হ্যাঁ। আর—

কি?

তার প্রমাণও আমি পেয়েছি।

প্রমাণ!

হ্যাঁ, প্রমাণ। ১নং—

কিন্তু কিরীটী কথাটা শেষ করল না, হঠাৎ আবার কথার মোড় ঘুরিয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল। বললে, আচ্ছা অবনীবাবু।

বলুন?

আপনার কি মনে হয় আপনার সন্দেহটা খুব সত্যি?

কোন সন্দেহ?

সুশান্ত আর মিত্ৰাণী তাদের পরস্পর পরস্পরের প্রতি সত্যিই একটা আকর্ষণ-মানে আপনাদের ভাষায় ‘লভ্‌’ আছে?

আমার অন্ততঃ তো তাই মনে হয়।

অবিশ্যি সেটা খুব একটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। ঐ রুগ্ন বিকৃত-মস্তিস্ক স্ত্রীর নিরন্তর একটানা যন্ত্রণা, তারই পাশে এক তরুণীর সস্নেহ আচরণ—ওয়েল, অনায়াসেই সেরকম কিছু একটা ওদের পরস্পরের মধ্যে গড়ে ওঠা বিচিত্র নয়!

কিন্তু–

কি?

তাহলে দুজনকেই আমরা হত্যাকারী বলে সন্দেহ করতে পারি?

পারিই তো, আর তাই তো আমি বলতে চাই–

অবিশ্যি পোস্টমর্টেম রিপোটটা পেলে সেটা আমরা ভাল করে বিচার করে দেখতে পারি। কারণ সর্বাগ্রে আমাদের নিঃসন্দেহ হতে হবে শকুন্তলা দেবীর মৃত্যুটা সুইসাইড না মাডার-অর্থাৎ তাকে খুন করা হয়েছে কিনা!

ইতিমধ্যে জীপটা রসা রোড়ের কাছাকাছি এসে গিয়েছিল।

কিরীটী বলে, এখানেই আমাকে নামিয়ে দিন অবনীবাবু।

এখানে নামবেন?

হ্যাঁ। একটা কাজ ছিল এদিকে, সেরে যাই।

অবনী সাহা জীপ থামালেন।

কিরীটী জীপ থেকে নেমে চলে গেল।

০৬. শকুন্তলার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট

শকুন্তলার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পরের দিন নয়, তার পরের দিন পাওয়া গেল।

শকুলার মৃত্যুর কারণ বিষ নয়, শ্বাসরোধ করে বিচিত্র এক কৌশলে তাকে হত্যা করা হয়েছে।

অর্থাৎ শ্বাসরোধ হয়ে তার মৃত্যু হয়েছে।

তার মুখের মধ্যে অবিশ্যি কিছুটা মালিশের ঔষধ পাওয়া গিয়েছে কিন্তু সেটা তার মৃত্যুর কারণ নয় বলেই ডাক্তারের মত।

তাঁর সন্দেহ সেটা সম্ভবত তার মৃত্যুর পর কৌশলে তার মুখ-গহ্বরে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

কিরীটী মৃদু শান্ত কণ্ঠে বললে, যাক, দুটো ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত হলাম ১নং-শকুন্তলা আত্মহত্যা করেনি, কেসটা সুইসাইড নয়, কেসটা হোমিসাইড এবং ২নং-মৃত্যুর কারণ বিষ নয়, শ্বাসরোধে মৃত্যু। অতএব দেখা যাচ্ছে কেসটাকে হত্যাকারী একটা সুইসাইড প্রমাণ করবার জন্যই সম্ভবত ঐভাবে সাজিয়েছে।

অবনী সাহা বলেন, প্রথম থেকেই মনের মধ্যে ঐ সন্দেহটা আমার জেগেছিল।

ঠিক সন্দেহ করেছিলেন আপনি।

আর এও আমার সন্দেহ কিরীটীবাবু–

কি?

ঐ ওদের দুজনেই একজন হত্যাকারী-মার্ডারার।

মানে আপনি বলতে চান সুশান্তবাবু ও মিত্ৰাণী দেবীর মধ্যে কোন একজন?

হ্যাঁ। কেন, আপনারও তাই মনে হচ্ছে না এখন?

প্রশ্নটা করে অবনী সাহা কিরীটীর মুখের দিকে প্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকান।

হত্যাকারী একজন যে আছে সে বিষয়ে তো কোন সন্দেহই নেই সত্যি, তবে–

কিরীটী কথাটা যেন অসমাপ্ত রেখেই থেমে যায় মুহূর্তের জন্য। তারপর আবার বলে, কথা হচ্ছে এখনও কোন নির্ভরযোগ্য সত্যিকারের প্রমাণ ওদের বিরুদ্ধে আমরা সংগ্রহ করতে পারিনি।

আমার তো মনে হয় কিরীটীবাবু–

কি?

অবিলম্বে ওদের দুজনকে অ্যারেস্ট করে হাজতে পুরে ব্যবস্থা গ্রহণ করলেই ওরা ওদের অপরাধ স্বীকার করতে বাধ্য হবে। আর কোন প্রমাণ সংগ্রহের প্রয়োজনই হবে না।

না, না-অবনীবাবু, অমন কাজ করবেন না। হত্যাকারী যদি সত্যিই ওরা হয়, তাহলে আপাততঃ ওরা কেউ যাতে কোনরকমে আমাদের সন্দেহমাত্রও না করতে পারে সেটাই সর্বাগ্রে দেখতে হবে।

কিন্তু তাতে করে যদি বিপরীত হয়?

কি হবে?

মানে বলছিলাম, যদি ওরা গা-ঢাকা দেয়?

দেবে না। আর দিলেই বা। আপনাদের চোখকে এড়িয়ে যেতে পারবে না।

কিরীটী মৃদু হাসে।

অবনী বলেন, তাহলে আপনি বলছেন ওদের অ্যারেস্ট করব না?

নিশ্চয়ই না। শুনুন, কাল সকালে আর একবার চলুন, ওদের সঙ্গে আলাদা আলাদা ভাবে কথা বলে আসা যাক। মানে আরও কিছু প্রশ্ন ওদের আমি করতে চাই অবনীবাবু।

অবনী সাহা কিরীটীর যুক্তিটা তেমন করে মনের মধ্যে গ্রহণ করতে না পারলেও পরের দিন সকালের দিকে কিরীটীর সঙ্গে গিয়ে হাজির হন সুশান্তর কোয়াটারে।

গাড়িতে যেতে যেতেই একটা কথা বলেছিল কিরীটী, সেদিন আমাদের একটা ভুল হয়ে গিয়েছে অবনীবাবু।

ভুল?

হ্যাঁ।

কি রকম?

আপনি বলেছিলেন না, সুশান্তর বাবা বৃদ্ধ হাঁপানীর রোগী সুকান্ত ঐ বাড়িতেই থাকেন।

হ্যাঁ।

তাঁর সঙ্গে তোকই দেখা করিনি। এবং কোন্ ঘরে তিনি থাকেন সে ঘরটাও দেখা হয়নি।

আমি প্রথম দিন সুশান্তর বাবা সুকান্তবাবুর সঙ্গে দেখা অবিশ্যি করেছিলাম।

করেছিলেন?

হুঁ। রান্নাঘরের পিছনে যে একটা ছোট ঘর আছে, ঘরটা ঠিক শকুন্তলা যে ঘরে থাকত তার লাগোয়া, সেই ঘরেই আছেন সুকান্তবাবু।

আজ একবার তাঁর সঙ্গে দেখা করব।

বেশ তো।

.

ওরা যখন কোয়াটারে এসে পৌঁছাল বেলা তখন প্রায় পৌনে নটা।

সুশান্ত বাড়িতে ছিল না। বাজারে গিয়েছে। মিত্ৰাণীই ওদের সাড়া পেয়ে এসে দরজা খুলে দিয়ে অভ্যর্থনা জানাল।

সুশান্তবাবু আছেন? কিরীটীই শুধায়।

না, তিনি তো বাজারে গিয়েছেন। মিত্ৰাণী মৃদুকণ্ঠে জবাব দেয়।

কখন ফিরবেন?

এখনই হয়ত ফিরবেন।

মিত্ৰাণীর চোখের দৃষ্টি ভূমিতলে নিবদ্ধ।

কতক্ষণ গিয়েছেন?

অনেকক্ষণ গিয়েছেন।

মিত্ৰাণী দেবী!

বলুন?

সুশান্তবাবুর বাবা এ বাড়িতে আছেন, না?

আছেন।

তাঁর সঙ্গে একবার দেখা করতে পারি?

হ্যাঁ। একটু আগে ঘুম থেকে উঠেছেন, চা খাচ্ছিলেন। আসুন।

চলুন।

যেতে যেতে কিরীটী আবার প্রশ্ন করে, সুশান্তবাবুর ছেলে রাহুল কেমন আছে মিত্ৰাণী দেবী?

একটু ভাল। জ্বরটা সকাল থেকে আজ কমেছে।

ভুল বকছে না আর?

না। ভিতরের বারান্দার শকুন্তলার ঘরের পাশেই ছোট ঘরটা। ঘরের দরজা ভেজানো ছিল। সকলে গিয়ে দরজাটা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল।

ছোট অপরিসর ঘরটা। একটি মাত্র ছোট জানালা ও একটিমাত্র ছোট দরজা। জানালাটা খোলা থাকা সত্ত্বেও দেখা গেল ঘরটা দিনের বেলাতেও অন্ধকার বেশ। ঘরের বদ্ধ বাতাসে একটা রোগের ঔষধের মিশ্র কটু গন্ধ যেন।

ঘরের মধ্যে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে গন্ধটা নাকে এসে ঝাপটা দেয়।

ঘরজোড়া একটা তক্তপোশ, তারই উপরে অযত্ন-মলিন শয্যায় এক বৃদ্ধ উবু হয়ে বসে শ্বাস টানছিলেন।

প্রাণপণে যেন বাতাস থেকে অক্সিজেন টানবার চেষ্টা করছেন। সামনের একটা টুলের উপরে কিছু ঔষধের শিশি। চায়ের কাপ, জলের গ্লাস আর তার মধ্যে একটা শূন্য পিতলের ফুলদানি। ভদ্রলোকের বয়েস সত্তরের ঊর্ধ্বে বলেই মনে হয়।

পরনে একটা মলিন হেঁড়া লুঙ্গি ও গায়ে একটা হেঁড়া ময়লা গেঞ্জি, তার উপর একটি মলিন বালাপোশ আলগাভাবে জড়ানো।

কঙ্কালসার দেহ।

পদশব্দে বৃদ্ধ সুকান্তবাবু মুখ তুলে তাকালেন, কে?

জবাব দিল মিত্ৰাণীই, তাওইমশাই, থানার দারোগাবাবু এসেছেন, আপনার সঙ্গে কি কথা বলতে চান।

কে?

অবনী বললেন, আমি থানা থেকে আসছি-ও-সি।

খনখনে বিরক্তিভরা কর্কশ গলায় সুকান্ত প্রশ্ন করলেন, কেন, আমার কাছে কি দরকারটা আবার আপনাদের?

আপনি সুশান্তবাবুর বাবা? কিরীটী শুধায়।

না, সৎ বাপ-স্টেপ ফাদার, বুঝলেন?

ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গে বিরক্তিভরা কণ্ঠে বলে ওঠেন।

কিরীটী বুঝতে পারল বৃদ্ধের ঐ একটিমাত্র কথাতেই—যে কোন কারণেই হোক বৃদ্ধ বাপ পুত্রের প্রতি আদৌ সন্তুষ্ট নন।

বৃদ্ধ বলতে লাগলেন, কি জন্যে এসেছেন, আর কেনই বা এসেছেন? বৌটা মালিশের ওষুধ খেয়ে মরেছে, আমিও তাই মরব একদিন। তারপর ওরা নিশ্চিন্ত হবে।

সুকান্তবাবু! কিরীটী ডাকে।

বাবু বলছেন কেন? দেখছেন না কি হালে আছি? বলুন চাকর!

সুশান্তবাবুই তো আপনার একমাত্র ছেলে?

নচেৎ এখানে এই নরক-যন্ত্রণার মধ্যে এমনি করে পড়ে থাকি আজও?

উনি বুঝি আপনার যত্ন নেন না? কিরীটী শুধায়।

যত্ন? দিন গুনছে কবে যাব! জানেন মশাই, মুখ বুজে পড়ে আছি-নচেৎ জানি না কী, বুঝি না কী দারোগাবাবু? সেদিন আপনাকে আমি বলিনি, বলতে সাহস পাইনি—ওরা দুটোতে মিলে নিশ্চয়ই আমার বৌমাকে বিষ দিয়ে হত্যা করেছে!

এ আপনি কি বলছেন? কিরীটী বলে।

ঠিকই বলছি-ওরাই ওকে হত্যা করেছে। নচেৎ আমার মালিশের ওষুধটা ওর-বৌমার ঘরে গেল কি করে বলতে পারেন?

আপনার মালিশের ওষুধ?

হ্যাঁ হ্যাঁ, পরেরদিন দুপুরে খোঁজ করতে গিয়েই তো জানতে পারলাম, শিশিটা আমার টুলের উপরে নেই!

অবনীবাবু?

বলুন?

শিশিটা আছে না আপনার কাছে?

হ্যাঁ, থানায় আছে।

ওষুধের শিশির গায়ে লেবেলে কার নাম আছে দেখেছিলেন?

না।

আচ্ছা সুকান্তবাবু!

কি?

আপনার পুত্রবধূ তো আপনার এই ঘরের লাগোয়া ঘরটাতে থাকতেন, সে রাত্রে কোনরকম শব্দ-টদ কিছু শুনেছিলেন?

শুনব কি মশাই—যে ঝড়-জল-বৃষ্টি! জানালা দিয়ে জল আসছিল, চেঁচিয়ে গলা ফাটালাম, তাও কেউ এলো না। তবে আমি যা বলছি তার মধ্যে ভুল নেই জানবেন। ওরাই আমার সতীলক্ষ্মী বৌমাকে দুজনে ষড়যন্ত্র করে বিষ খাইয়ে মেরেছে।

বলতে বলতে বুড়ো কাশতে শুরু করেন।

 ০৭. কিরীটীর আর জিজ্ঞাস্য

কিরীটীর আর জিজ্ঞাস্য বা জানার কিছু ছিল না সুকান্তর কাছে।

ওরা বের হয়ে এল অতঃপর ঘর থেকে।

চলুন অবনীবাবু।

বারান্দায় বের হতেই সুশান্তবাবুর সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল। সে এইমাত্র ফিরেছে বাজার থেকে বাজারের থলি হাতে।

রুক্ষ মলিন বিষণ্ণ চেহারা। মুখখানা শুকিয়ে গিয়েছে যেন দুদিনেই।

সুশান্তবাবু, নমস্কার। কিরীটী বলে।

নমস্কার।

আপনার সঙ্গে আমাদের কিছু কথা ছিল।

আপনারা বারান্দায় গিয়ে বসুন, আমি আসছি। সুশান্ত শান্তকণ্ঠে বলে।

ওরা বারান্দায় এসে চেয়ারে বসে।

.

আকাশে মেঘ জমেছে। বেশ মেঘ।

চারিদিক কালো হয়ে এসেছে। বেশ জোরেই একপশলা বৃষ্টি নামবে বলে মনে হয়।

অবনী মৃদুকণ্ঠে ডাকলেন, কিরীটীবাবু।

বলুন?

এখন আপনার কোন সন্দেহের আর অবশিষ্ট আছে?

কিসের বলুন তো?

যে ওরাই খুন করেছে শকুন্তলা দেবীকে?

কিরীটী মৃদু কণ্ঠে বলে, না, এখনও আমি আপনার মতের সঙ্গে পুরোপুরি একমত হতে পারছি না অবনীবাবু!

কেন? শুনলেন তো সুকান্তবাবুর কথাগুলো? কিছু একটা সেরকম ব্যাপার সত্যি সত্যি ভিতরে না থাকলে, বাপ কখনও তার ছেলের সম্পর্কে অমন রুড় রিমার্কস্ পাস করতে পারে?

অবনীবাবু, বয়স আপনার অল্প। সংসারে যে কত বিচিত্র মানুষ আছে, মানুষের মনে যে কত বিচিত্র সব দ্বন্দ্ব থাকে যদি জানতেন

কিন্তু কিরীটীর কথা শেষ হল না।

সুশান্ত চ্যাটার্জির পায়ের শব্দ পাওয়া গেল।

কিরীটী বললে, সুশান্তবাবু আসছেন, এসব আলোচনা এখন থাক।

সুশান্ত এসে ওদের সামনে দাঁড়াল।

বসুন মিঃ চ্যাটার্জি। কিরীটীই বলল।

সুশান্ত একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল।

কিরীটীই প্রশ্ন করে, মিঃ চ্যাটার্জি।

বলুন?

একটা কথা আপনাকে জানানো দরকার।

সুশান্ত কিরীটীর কণ্ঠস্বরে চকিতে ওর মুখের দিকে চোখ তুলে তাকাল।

সুশাস্তুর দুচোখের দৃষ্টিতে একটা সংশয়, একটা ভীতির ছায়া পড়েছে যেন।

কাল আপনার স্ত্রীর—মানে মিসেস চ্যাটার্জির ময়না-তদন্তের রিপোর্ট আমরা পেয়েছি।

সুশান্ত চেয়ে আছে নিঃশব্দে কিরীটীর মুখের দিকে।

কিরীটী বলে চলে, রিপোর্ট কি বলছে জানেন?

কি?

ক্ষীণকণ্ঠে প্রশ্নটা উচ্চারিত হল যেন একটা অস্পষ্ট শব্দের মত।

আপনার স্ত্রীর মৃত্যুর কারণ কোন বিষ—মানে পয়জন নয়।

তবে কি?

তাঁকে শ্বাসরোধ করে মারা হয়েছে?

কি বলছেন? কি করে মারা হরেছে!

শ্বাসরোধ করে তাঁকে কেউ হত্যা করেছে। নচেৎ–

না না, তা কি করে হয়? হাউ অ্যাবসার্ড!

তাই হয়েছে মিঃ চ্যাটার্জি। ব্যাপারটা সুইসাইড নয়, হোমিসাইড মার্ডার এবং শ্বাসরোধ করে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে।

কিন্তু কে—কে করবে তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা মিঃ রায়? আর কেনই বা করবে?

কেন করবে, কে করবে সে তো পরের কথা। আমাদের সেটা অনুসন্ধান করে বের করতে হবে। তবে যা ফ্যাক্ট-আমরা যতটা জানতে পেরেছি, যা সত্যি বলে ও সঙ্গত বলে মনে হচ্ছে আমাদের, তাই আপনাকে বলছি।

না, না-মিঃ রায়–

সুশান্তর দু-চোখের কোলে জল ভরে আসে-টলটল করতে থাকে জল। সে বললে, ঠিকই, এক এক সময় তার ইদানীংকার ব্যবহারে আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গিয়েছে। এমন কি মনে হয়েছে ওকে শেষ করে দিই, কিন্তু পরের মুহূর্তেই যখন মনে পড়েছে কি কষ্টটাই পাচ্ছে বেচারী ঐভাবে দিনের পর দিন শয্যাগত থেকে, তখনই সব রাগ আমার জল হয়ে গিয়েছে। জানেন মিঃ রায়, আজ সে নেই, আমার এগার বছরের সাথী এতদিন পঙ্গু হয়ে ঘরের মধ্যে ছিল, অসুস্থ ছিল—তবু ছিল। আজ দুদিন থেকে মনে হচ্ছে এ বাড়ি যেন আমার খালি হয়ে গিয়েছে।

দু-ফোটা চোখের জল আবার গড়িয়ে পড়ে সুশান্তর গাল বেয়ে।

সুশান্ত আবার বলে, এ বাড়িতে আমি যেন আর এক মুহূর্তও টিকতে পারছি না।

কিরীটী শাস্তকণ্ঠে বলে, তবু মিঃ চ্যাটার্জি, সত্য যা ফ্যাক্ট যা-তাকে তো অস্বীকার করা এখন যাবে না। কাজেই সর্বপ্রকার অনুসন্ধানই আমাদের চালাতে হবে-আর আপনিও নিশ্চয়ই চান, যে হত্যাকারী অমন নিষ্ঠুরভাবে আপনার স্ত্রীকে হত্যা করেছে সে ধরা পড়ুক, তার যথোচিত শাস্তি হোক। শুনুন, যে প্রশ্নগুলো এবারে আমি করব তার জবাব দিন!

রুমাল দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে সুশান্ত বলে, বলুন।

সে রাত্রে, মানে যে রাত্রে মিসেস চ্যাটার্জি নিহত হন, সে রাত্রে রাত আড়াইটেয় আপনার ডিউটি শেষ হবার পর এবং এখানে এসেছেন ভোর সাড়ে পাঁচটায়—এই তিন ঘণ্টা সময় আপনি কোথায় ছিলেন?

আপনাদের তো সে কথা আগেই বলেছি-বাড়ি ফিরিনি, রেস্টিং রুমে শুয়ে ছিলাম।

না! কিরীটী শান্ত গলায় সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়।

কি বলছেন আপনি? প্রশ্নটা করে সুশান্ত চ্যাটার্জি তাকায় কিরীটীর মুখের দিকে।

ঠিকই বলছি। ভাল করে মনে করে দেখুন। আপনি সত্যি কথা বলছেন না!

সত্যি কথা বলছি না?

না।

তবে সত্যিটা কি?

আপনি ঐ তিন ঘণ্টা সময়ের মধ্যে কোন এক সময় এখানে এসেছিলেন, এসে আবার ফিরে গিয়েছেন রেস্টিং রুমে।

এসেছিলাম—এসে ফিরে গিয়েছি।

হ্যাঁ, হ্যাঁ। কিন্তু কেন? কেন এসেই আবার ফিরে গিয়েছিলেন? বলুন, চুপ করে থেকে লাভ নেই মিঃ চ্যাটার্জি। আমি জানি আপনি এসেছিলেন এবং তার প্রমাণও আমার কাছে আছে জানবেন।

অকস্মাৎ যেন ভেঙে পড়ে সুশান্ত।

তার সমস্ত প্রতিবাদ অসহায় কান্নায় যেন আত্মসমর্পণ করল।

বললে, হ্যাঁ, আমি-আপনি ঠিকই বলেছেন মিঃ রায়, আমি এসেছিলাম—এসেছিলাম–

কিন্তু কেন-কেন? যদি এসেই ছিলেন তো আবার ফিরে গিয়েছিলেন কেন? বলুন, চুপ করে থাকবেন না, বলুন?

আ-আমি–

বলুন?

আমি—

আপনি নিশ্চয়ই আপনার স্ত্রীর ঘরে ঢুকেছিলেন সে-রাত্রে।

হ্যাঁ ঢুকেছিলাম, কিন্তু তখন সে মৃত।

তবু তখন জানাননি কথাটা কাউকে কেন? বলুন কেন কথাটা চেপে গেলেন?

না, না-না-বিশ্বাস করুন মিঃ রায়, আমি কিছু জানি না। কুন্তকে আমি হত্যা করিনি।

কিন্তু তাহলে কেন ঢুকেছিলেন আপনার স্ত্রীর ঘরে? কেনই বা আবার ফিরে গিয়েছিলেন তাঁকে মৃত দেখেও? তা তো বললেন না এখনও?

সে-সে কথা আমি বলতে পারব না।

বলতে পারবেন না?

না।

বললে বোধ হয় ভাল করতেন মিঃ চ্যাটার্জি। নিদারুণ সন্দেহ থেকে আপনি নিষ্কৃতি পেতেন।

০৮. আমি হত্যা করিনি

সুশান্ত বলে, বিশ্বাস করুন, বিশ্বাস করুন মিঃ রায়, তাকে আমি হত্যা করিনি। সে আমার স্ত্রী–

আমি বিশ্বাস করলেই কিছু হবে না মিঃ চ্যাটার্জি। আইনকে বিশ্বাস করাতে হবে।

আইন?

হ্যাঁ, আপনি বলুন—কেন এসেছিলেন?

বলতে পারলে আমি বলতাম মিঃ রায়, কিন্তু—

ঠিক আছে, বলবেন না। কিন্তু এ কথাটা তো আর অস্বীকার করবেন না যে মিত্ৰাণী দেবীকে আপনি ভালবাসেন?

না, না—এ কি বলছেন?

আপনি ভালবাসেন মিঃ চ্যাটার্জি, অস্বীকার করে লাভ নেই।

আপনি বিশ্বাস করুন মিঃ রায়–

একটা কথা কি জানেন মিঃ চ্যাটার্জি, কিরীটী শান্ত গলায় বলে, স্ত্রীলোকের চোখে অনেক কিছুই ফাঁকি দেওয়া গেলেও, তারই প্রিয়জনের অন্য এক নারীর প্রতি আকর্ষণকে ফাঁকি দেওয়া শুধু দুঃসাধ্যই নয়, অসম্ভবও।

কিন্তু মিঃ রায়, আমার স্ত্রী–

হয়ত আপনার স্ত্রীর মধ্যে রোগে ভুগে ভুগে কিছুটা হিস্টিরিয়া ডেভেলাপ করেছিল, কিন্তু তবু আমি বলব—তাঁর হিস্টিরিয়াটা ষোল আনাই হয়ত হিস্টিরিয়া ছিল না।

কিন্তু আপনি বিশ্বাস করুন মিঃ রায়, কুন্তকে সত্যিই আমি ভালবাসতাম, প্রতি মুহূর্তে সারাটা অন্তর দিয়ে তার আরোগ্যকামনাই করতাম। সে ভাল হয়ে উঠুক, সুস্থ হয়ে উঠুক, আমাদের সংসার আবার আনন্দের হয়ে উঠুক-ঈশ্বরের কাছে সর্বদা মনে মনে ঐ প্রার্থনাই জানিয়েছি।

মিঃ চ্যাটার্জি, মানুষের মন বিচিত্র আর মানুষের প্রবৃত্তিটাও অতিশয় বিচিত্র! ঐ বিচিত্র আকাঙ্ক্ষা বা প্রেরণা মানুষকে যেমন সময়বিশেষে এক ধরনের সর্বনাশের পথে টেনে নিয়ে যায়, তেমনি তাকে সাধারণ থেকে অসাধারণের পর্যায়েও নিয়ে যেতে পারে। প্রতিভা দুঃসাহস ও অনন্যতাও অনেক ক্ষেত্রে ঐ বোধ থেকেই পূর্ণ বিকাশলাভ করে। কিন্তু যাক সে কথা, মিত্ৰাণী দেবীকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে চাই। তাঁকে যদি এখানে একটিবার পাঠিয়ে দেন।

সুশান্ত ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল।

ক্লান্ত শিথিল পায়ে নিঃশব্দে অন্দরে গিয়ে প্রবেশ করল।

কিরীটীবাবু! অবনী ডাকেন।

বলুন।

আপনি তাহলে মিঃ চ্যাটার্জিকে সন্দেহ করছেন?

তা করছি বৈকি।

তাহলে—

কি তাহলে?

ওকে আমরা—

ব্যস্ত হবেন না অবনীবাবু।

কিন্তু হত্যাকারীকে হাতের মুঠোর মধ্যে পেয়েও যদি রশি আলগা দিই–

ভুলে যাচ্ছেন কেন একটা কথা অবনীবাবু, শুধু জানাই নয়—কাউকে পেনাল কোডের আওতায় ফেলতে হলে প্রমাণ চাই সর্বাগ্রে। সেই প্রমাণই এখনও কিছু আপনার হাতে আসেনি। তাছাড়া একটা কথা আপনাকে আমি জোর গলায় বলতে পারি–

কি?

সুশান্ত চ্যাটার্জি আর যাই করুক, পালাবে না।

কিন্তু নিশ্চিন্ত থাকুন, তার ঐ ছেলে রাহুলকে ফেলে সে কোথায়ও যাবে না।

কি করে বুঝলেন?

তাই আমার ধারণা।

ইতিমধ্যে অত্যন্ত লঘু পদসঞ্চারে কখন যে ওদের পাশে এসে মিত্ৰাণী দাঁড়িয়েছে নিঃশব্দে ওরা টেরই পায়নি।

হঠাৎ কিরীটীর নজর পড়ে।

এই যে মিত্ৰাণী দেবী, আপনি এসেছেন-বসুন—

মিত্ৰাণী একটা চেয়ারে উপবেশন করল।

মনে হচ্ছে কিছুক্ষণ আগে সে স্নান করেছে।

সিক্ত চুলে একটা স্নিগ্ধ কেশতৈলের সুবাস পাওয়া যায়।

পরনে আজ একটা হালকা আকাশ-নীল রঙের চওড়াপাড় মিলের শাড়ি।

মিত্ৰাণী দেবী!

মিত্ৰাণী নিঃশব্দে মুখ তুলে তাকাল। সেই চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ-চঞ্চল।

মিত্ৰাণী দেবী, সেদিন আপনার জবানবন্দিতে একটি কথা আমাদের কাছে স্বীকার করেননি–

কি কথা?

সে রাত্রে অর্থাৎ যে রাত্রে দুর্ঘটনাটা ঘটে, সেই রাত্রে আপনার ঘরে আপনার জামাইবাবু বাদে কে তৃতীয় ব্যক্তি এসেছিল?

কেউ তো আসেনি।

এসেছিল।

আপনি দেখছি এখনও কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেন না আমার কথাটা।

না মিত্ৰাণী দেবী, বিশ্বাস করা সম্ভব নয় বলেই পারছি না। কিন্তু আমিও সত্য বুঝতে পারছি না, কেন আপনি কথাটা এখনও স্বীকার করছেন না?

কারণ কথাটা মিথ্যা বলে।

মিথ্যা?

হ্যাঁ।

তাহলে কেউ আসেনি বলতে চান?

হ্যাঁ। শান্ত গলায় জবাব দেয় মিত্ৰাণী। তার কণ্ঠস্বরে কোথায়ও ত্রুটির দ্বিধা বা কম্পন পর্যন্ত নেই যেন।

একটা সহজ সত্য কথাকে যেন অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে বলছে মিত্ৰাণী।

কিরীটী মিত্ৰাণীর মুখের দিকে ক্ষণকাল চেয়ে রইল। তার চোখের দৃষ্টিতে যেন একটা চকিত বিদ্যুৎ স্ফুরণ।

এবং পুনরায় কিরীটী কথাটা যেন পুনরাবৃত্তি করল। বললে, তাহলে বলতে চান কেউ আসেনি সে রাত্রে আপনার ঘরে?

হ্যা!

হঠাৎ ঐ সময় কিরীটীর নজরে পড়ল ও-পাশের জানালার পাশ থেকে কে যেন চকিতে সরে গেল।

কিরীটী কিন্তু ব্যাপারটা দেখেও দেখল না।

কতকটা যেন না দেখার ভান করে ব্যাপারটা, তাকায়ও না সেদিকে।

মিত্ৰাণী দেবী। কিরীটী আবার প্রশ্ন করে। বলুন।

দেখুন সূর্যের আলোকে যেমন চাপা দেওয়া যায় না, তেমনি সত্যকে চাপা দেওয়া যায় ণা। সত্য যা, আজ হোক বা দুদিন পরে হোক প্রকাশ পাবেই। তাই বলছিলাম–

আপনাকে আমি মিথ্যা বলিনি কিরীটীবাবু।

সেই শান্ত স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর মিত্ৰাণীর।

কিন্তু আমি বলছি–

কী?

আপনি সত্য গোপন করছেন।

কী বললেন?

আপনি সত্য গোপন করছেন।

না।

কিরীটী মৃদু হাসল। তাপরা শান্ত গলায় বললে, থাক ও কথা। তবে একটা কথা বোধ হয় আপনার জানা প্রয়োজন মিত্ৰাণী দেবী–

মিত্ৰাণী কোন কথা না বলে কিরীটীর মুখের দিকে চোখ তুলে তাকাল।

চোখে চোখ রেখে কিরীটী বললে, আপনার দিদি মিসেস শকুন্তলা চ্যাটার্জি কিন্তু আত্মহত্যা করেননি, আমরা জানতে পেরেছি।

সে মালিশের ঔষধের বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেনি বলতে চান?

হ্যাঁ, তিনি আত্মহত্যা করেননি। ব্যাপারটা এমনই স্বেচ্ছামৃত্যু নয়—তাকে হত্যা করা হয়েছে।

কী বললেন?

দু চোখ তুলে তাকাল মিত্ৰাণী একবার কিরীটীর মুখের দিকে।

হ্যাঁ মিত্ৰাণী দেবী, তাকে হত্যা করাই হয়েছে। কিরীটী আবার পুনরাবৃত্তি করল।

তবে ঐ মালিশের ঔষধ তার ঘরে তার বিছানার উপর এল কি করে?

কিরীটী হেসে ফেলল।

ওটা একটা eye-wash মাত্র। হত্যাকারীর একটা চাল বা অন্যের চোখে ধুলো নিক্ষেপ করবার একটা প্রয়াস বলতে পারেন।

না, না—

হ্যাঁ, তাই। তাকে—মানে এক অসুস্থ ভদ্রমহিলাকে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে।

হত্যা!

হ্যাঁ, হত্যা। আর কি করে হত্যা করা হয়েছে, জানেন?

কিরীটীর কণ্ঠস্বর তীক্ষ্ণ।

মিত্ৰাণীর চোখে যেন ভীত বোবা দৃষ্টি।

কেমন যেন অসহায় ভাবে মিত্ৰাণী তখন তাকিয়ে আছে কিরীটীর মুখের দিকে।

০৯. কিরীটী থামে না

কিরীটী থামে না।

সে বলে চলে পূর্ববৎ তীক্ষ্ণ ভাষায়। মিত্ৰাণীর চোখে চোখ রেখে।

গলা টিপে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে একটি অসুস্থ অসহায় ভদ্রমহিলাকে!

আ-আপনি বলতে চান, দিদিকে হত্যা করা হয়েছে? না না, আমি যে কিছুতেই ভাবতে পারছি না ব্যাপারটা

পোস্টমর্টেম রিপোর্ট তাই বলছে, মিত্ৰাণী দেবী! কিরীটী আবার বলে।

তাকে হত্যা করা হয়েছে? ব্যাপারটা যেমন অসম্ভব তেমনি অবিশ্বাস্য!

কিন্তু আমরা জেনেছি–

কী?

ব্যাকুল দৃষ্টিতে তাকায় মিত্ৰাণী কিরীটীর মুখের দিকে।

আপনার দিদির মনেও ঐরকম একটা ধারণা হয়েছিল—তাকে হত্যা করবারই চেষ্টা করা হচ্ছে।

জানি। কিন্তু সবটা তো তার অসুস্থ মনের একটা বিকৃত কল্পনা, আর…

মিত্ৰাণী বলতে বলতে থেমে যায়।

বলুন! কিরীটী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল মিত্ৰাণীর মুখের দিকে।

ডাক্তারবাবুও, যিনি বরাবর তাকে দেখছিলেন, ঐ কথাই বলতেন। তাছাড়া আর একটা কথা–

কি?

কিরীটী সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে আবার তাকায় মিত্ৰাণীর মুখের দিকে।

মিত্ৰাণী বলে, সেরকম একটা কিছু ঘটলে আমি নিশ্চয়ই জানতে পারতাম, কিরীটীবাবু।

হয়ত জানতে পারেননি, কারণ সে-রাত্রে প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি হয়েছিল।

তবু–তবু তা অসম্ভব।

অসম্ভব? হ্যাঁ। আমি–আমি জানতে পারতামই, কারণ আমিও জেগেই ছিলাম।

জেগে ছিলেন আপনি?

কথাটা হঠাৎ ঝোকের মাথায় বলে ফেলে কিরীটীর মনে হল, মিত্ৰাণী কেমন যেন একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে।

সে যেন থতমত খেয়ে হঠাৎ থেমে যায়।

স্তব্ধ হয়ে যায়।

আপনি জেগে ছিলেন সে রাত্রে?

হ্যাঁ, মানে রাহুলের খুব জ্বর ছিল, তাকে নিয়ে জেগেই আমার রাতটা কেটেছিল।

কিরীটী আবার পুনরাবৃত্তি করে বলে, তাহলে আপনি জেগেই ছিলেন সে রাত্রে?

হ্যাঁ। ক্ষীণকণ্ঠে জবাব দেয় মিত্ৰাণী।

কিরীটী অতঃপর কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে।

কী যেন সে ভাবছে মনে হয়।

আচ্ছা এবার আপনি যেতে পারেন, মিত্ৰাণী দেবী। কিরীটী অতঃপর শান্ত গলায় কথাটা বলে।

মিত্ৰাণী উঠে দাঁড়াল।

তারপর কোন দিকে না তাকিয়ে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

কিরীটী সেই দিকে নিঃশব্দে চেয়ে থাকে।

আবনী সাহা কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে ডাকেন, কিরীটীবাবু!

কিছু বলছিলেন?

কিরীটী প্রশ্নটা করে অবনী সাহার মুখের দিকে তাকাল।

হ্যাঁ।

বলুন কি বলছিলেন?

আমার যেন মনে হচ্ছে–

কী?

হয়ত মিত্ৰাণী দেবী নির্দোষ।

কিরীটী মৃদু হাসল। মৃদুকণ্ঠে তারপর প্রশ্ন করে, হঠাৎ ও কথা আপনার মনে হল যে?

আমাদের পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট অনুযায়ী সত্যি-সত্যিই যদি শকুন্তলা দেবীকে গলা টিপে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েই থাকে, সেটা কি একজন মিত্ৰাণী দেবীর মত স্ত্রী লোকের পক্ষে সম্ভব?

সম্ভব নয় বুঝি?

না। মন যেন মানতে চায় না। তাছাড়া কী?

হাজার হলেও শকুন্তলা দেবী তার বোন তো! বোনকে বোন অমন নিষ্ঠুর ভাবে–

হত্যা করতে পারে না, তাই না? কিন্তু অবনীবাবু, দুজন স্ত্রীলোক যখন একই পুরুষকে ভালবাসে তখন তারা বাঘিনীর চাইতেও হিংস্র নিষ্ঠুর হতে পারে!

মানে-আপনি বলতে চান–

বলতে আমি এখনই কিছুই চাই না অবনীবাবু, আমি কেবল বলতে চাই, ওর চাইতেও নিষ্ঠুরভাবে একজন স্ত্রীলোককে অন্য এক স্ত্রীলোককে হত্যা করতে দেখেছি।

তবে–

না না, মিত্ৰাণী দেবী যে অপরাধিনী এক্ষেত্রে তা অবশ্য আমি বলছি না। কিন্তু এবারে ওঠা যাক, আজকের মত চলুন।

কিন্তু সুশান্তবাবু গেলেন কোথায়? অবনী সাহা বলেন।

ঐ সময় সুশান্ত চ্যাটার্জি এসে ঘরে ঢুকল।

দু হাতে তার দু কাপ চা।

অবনী বাধা দিয়ে বলে ওঠেন, এ কি! চা আবার আনতে গেলেন কেন?

না, না—এ আর কিকিরীটী চেয়ে ছিল সুশান্তর মুখের দিকে। তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে বলে, দিন দিন, সত্যিই পিপাসা পেয়েছিল। Thanks!

কিরীটী চায়ের কাপ নিয়ে চুমুক দেয়।

 ১০. চা-টা চমৎকার হয়েছে

বাঃ, চা-টা চমৎকার হয়েছে তো! কে তৈরী করল?

কিরীটী সুশান্ত চ্যাটার্জির দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করে।

মৃদু হেসে সুশান্ত বলে, আমি।

বুঝতে পেরেছি। কিরীটী আরাম করে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলে, সত্যিই দেখছি আপনি রীতিমত কুশলী লোক।

আজ্ঞে—

চমকে যেন সুশান্ত কিরীটীর দিকে তাকিয়ে স্বগতোক্তির মত কথাটা উচ্চারণ করে।

বলছিলাম সত্যিই আপনি গুণী লোক। কি বলেন অবনীবাবু?

অবনী সাহার মুখের দিকে তাকাল কিরীটী।

অবনী সাহা কোন জবাব দেন না।

কিন্তু সুশাবাবু, আপনি দাঁড়িয়ে কেন? বসুন না।

সুশান্ত চ্যাটার্জি একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল।

আচ্ছা সুশাবাবু! কিরীটী প্রশ্ন করে।

বলুন!

মিত্ৰাণী দেবী—মানে আপনার শ্যালিকা—ওঁর তো সংসারে কেউ নেই?

না। সত্যি ভাগ্যটাই ওর খারাপ।

হ্যাঁ, অবনীবাবুর কাছে তাই শুনছিলাম বটে। আচ্ছা উনি তো বেশ কিছুদিন আপনাদের এখানে আছেন?

হ্যাঁ।

Dont mind-একটা কথা delicate হলেও জিজ্ঞাসা করছি—

বলুন?

মেয়েটিকে আপনার কি রকম বলে মনে হয়?

মানে?

মানে বলছিলাম—মেয়েটির স্বভাব-চরিত্র–

না, না-সে রকম কিছু নেই—অত্যন্ত innocent type-এর।

আচ্ছা মালদহে যখন উনি ছিলেন?

না, কোন কিছু ওর সম্পর্কে শুনিনি। কিন্তু এসব কথা জিজ্ঞাসা করছেন কেন বলুন তো?

মানে বলছিলাম এইজন্য যে, সেখানে মানে মালদহে তার কোন ভালবাসার জন তো থাকতেও পারে!

সুশান্ত যেন হঠাৎ কেমন চমকে ওঠে। বলে, কী বলছেন মিঃ রায়?

না, বলছিলাম থাকতেও পারে। হয়ত আপনি জানেন না।

না, না, সে রকম কিছু হলে—

কিরীটী সুশান্ত চ্যাটার্জির মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

দুচোখের পাতা যেন পড়ছে না।

সুশান্ত বলতে থাকে, আমি নিশ্চয়ই জানতে পারতাম।

সুশান্তর গলায় যেন একটা কঠিন আত্মপ্রত্যয়ের সুর।

না মশাই, তিনি তার গোপন মনের খবর আপনাকে বলতে যাবে কেন? আপনি তো আর তার বন্ধু নন-জামাইবাবু-গার্জিয়ান–

না, না, আপনি জানেন না—

কী জানি না?

সুশান্ত ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে। বলে, হ্যাঁ, আমি জানতে পারতাম সেরকম কিছু থাকলে।

কিরীটী আর কোন কথা বলল না।

হঠাৎ অতঃপর উঠে দাঁড়ায় এবং অবনী সাহার দিকে তাকিয়ে বলে, চলুন অবনীবাবু, অনেক রাত হয়ে গেছে।

অবনী সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ান।

আচ্ছা মিঃ চ্যাটার্জী, আমরা তাহলে চলি।

কিরীটী অবনী সাহাকে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এল।

গাড়িতে যেতে যেতে হঠাৎ একসময় কিরীটী বলে, আচ্ছা অবনীবাবু—

বলুন?

যে দাওয়াই দিয়ে এলাম, সেটা ঠিক কাজ করবে বলে মনে হয়?

কী বলছেন!

না, কিছু না। আচ্ছা-কিরীটী প্রসঙ্গান্তরে চলে যায়, মিত্ৰাণী দেবী তার জামাইবাবুকে ভালবাসে বলে আপনার মনে হয়?

অসম্ভব নয় কিছু।

তা বটে, আচ্ছা আপনি সন্দেহের বিষে কখনো জর্জরিত হয়েছেন?

সন্দেহের বিষে!

প্রশ্নটা করে কেমন যেন অসহায় ভাবে, একটু যেন নির্বোধের মতই অবনী সাহা পার্শ্বে উপবিষ্ট কিরীটীর মুখের দিকে তাকান।

কিরীটী তার কথাটার পুনরাবৃত্তি করে, বলে, হ্যাঁ-সন্দেহের বিষে!

কেন বলুন তো?

না, তাই জিজ্ঞাসা করছি।

হঠাৎ ঐ প্রশ্ন?

বললাম তো এমনিই। কিন্তু আমি জানি—

কি?

ও বিষ বড় সাংঘাতিক বিষ!

মিঃ রায়!

কিছু বলছিলেন?

হ্যাঁ। মিত্ৰাণী দেবীকে আপনি কি সত্যিই সন্দেহ করছেন?

কিরীটী হেসে ফেলে। বলে, মিত্ৰাণী দেবীকে দেখছি আপনি কিছুতেই ভুলতে পারছেন! যাই বলুন, একটা অদ্ভুত আকর্ষণ সত্যিই আছে ভদ্রমহিলার মধ্যে। কিন্তু আকাশে কি রকম মেঘ করেছে দেখছেন।

সত্যিই আকাশে মেঘ করেছিল। একটা ঠাণ্ডা বাতাস বইছিল।

অবনীবাবু! কিরীটী আবার ডাকে।

বলুন?

একটা অনুরোধ কিন্তু আছে আপনার কাছে—

অনুরোধ!

হ্যাঁ।

কী, বলুন?

আপাততঃ কিছুদিনের জন্য ঐ সুশান্ত ও মিত্ৰাণীকে আপনার ভুলে যেতে হবে।

ভুলে যেতে হবে?

হ্যাঁ। Completely! একেবারে মনের পাতা থেকে মুছে ফেলতে হবে।

কিন্তু–

সাপ ধরার আগে—আমি কালনাগিনীর কথা বলছি-ধরতে হলে প্রথমদিকে কিছুটা তাকে তার ইচ্ছামত চলতে দিতে হয়। শেষে যখন ফণা তুলবে তখন ধরবেন। কিন্তু বৃষ্টি বোধ হয় সত্যিই নামল!

কিরীটীর সে-রাত্রে গৃহে ফিরতে বেশ রাত হয়ে যায়।

এবং গৃহে যখন সে পৌঁছল তখন বেশ ঝমঝম করে বৃষ্টি নেমেছে। কলিংবেল টিপতেই জংলী এসে দরজাটা খুলে দিল। কিরীটী সোজা সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায়। সিঁড়ির দু-চার ধাপ অতিক্রম করতেই সেতারে মল্লারের আলাপ তার কানে আসে। বুঝতে পারে, কৃষ্ণা এখনও ঘুমোয়নি। সেতার বাজাচ্ছে কৃষ্ণাই।

কিরীটী ধীরে ধীরে সোপান অতিক্রম করতে থাকে। বসবার ঘরে মেঝেতে কার্পেটের উপর বসে কৃষ্ণা সেতার বাজাচ্ছিল।

জানালা খোলা। বাইরে ঝমঝম করে বৃষ্টি হচ্ছে। এলোমেলো হওয়ায় জানালার পর্দা উড়ছে।

কিরীটী নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে একটা সোফার উপর বসল। কৃষ্ণা টেরও পায় না। সেতার বাজানোর মধ্যেই নিমগ্ন হয়ে থাকে।

অনেকক্ষণ বাজাবার পর থামতেই, এতক্ষণে নজর পড়ে কৃষ্ণার কিরীটী বসে আছে সোফার উপরে।

তুমি কতক্ষণ? কৃষ্ণা সেতারটা নামিয়ে রেখে শুধায়।

অনেকক্ষণ।

বস তুমি, খাবার সব ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে। কৃষ্ণা উঠে পড়ে।

আরে শোন শোন প্রিয়ে–কিরীটী পিছন থেকে কৃষ্ণাকে ডাকে।

কী হল আবার? ফিরে দাঁড়ায় কৃষ্ণা।

আচ্ছা কৃষ্ণা–

কী?

ভালবাসা কি অপরাধ?

কেন? বুড়ো বয়সে কারো আবার প্রেমে পড়লে নাকি?

বাঁকা চোখে তাকিয়ে স্মিত হাস্যে প্রশ্ন করে কৃষ্ণা।

খুব যে দুঃসাহস দেখছি!

তা একটু আছে বৈকি।

এত বিশ্বাস!

হুঁ।

কথাটা বলে কৃষ্ণা আর দাঁড়ায় না। একটা গভীর কটাক্ষ স্বামীর প্রতি নিক্ষেপ করে ঘর ছেড়ে চলে যায়।

১১. দিন-পনের পরের কথা

দিন-পনের পরের কথা।

ইতিমধ্যে সুশান্ত আবার কাজে জয়েন করেছিল। প্রাত্যহিক ডিউটি যেমন দেয় দিতে আরম্ভ করেছিল। অবনী সাহা কয়েকদিন আগে সুশান্তর ওখানে এসে বলে গিয়েছিলেন, আপনি যেমন ডিউটি করছিলেন করতে পারেন।

শকুন্তলা-তার স্ত্রী—বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেনি।

তাকে গলা টিপে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে, কথাটা সত্যিই যেন কেমন একটু বিভ্রান্ত করে দিয়েছিল তাকে।

সেই সঙ্গে যে মনের মধ্যে একটা আশঙ্কাও দানা বেঁধে ওঠেনি তাও নয়।

সর্বক্ষণ কেমন যেন একটা ভয়-ভয়।

এমন সময় অবনী সাহা এসে ঐ কথা বললেন।

মনে হল অবনী সাহার কথায় যেন সুশান্তর মনের উপর থেকে একটা পাষাণভার নেমে যায়।

এবং বোধ হয় আরও বেশী করে নিশ্চিত হবার জন্যই প্রশ্ন করে, মিঃ সাহা।

কিছু বলছিলেন?

হ্যাঁ, মানে–এখনো কি আপনাদের ধারণা—

কী?

মানে বলছিলাম, আমার স্ত্রী আত্মহত্যা করেনি, তাকে গলা টিপে শ্বাসরোধ করে কেউ হত্যা করেছে!

আরে মশাই, যত সব উদ্ভট idea মিঃ রায়ের-plain simplecase of suicide, অথচ তিনি বলতে চান তাকে হত্যা করা হয়েছে গলা টিপে শ্বাসরোধ করে।

কিন্তু তিনি যে কি বলেছিলেন–

কী?

আপনাদের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট নাকি—

হ্যাঁ, ছেড়ে দিন তো। ডাক্তারগুলোও হয়েছে তেমনি!

সত্যি মশাই, সুশান্ত বলে, সেদিন তো কিরীটীবাবুর মুখে ঐ কথা শুনে আমি অবাক। বলেন কি! তাছাড়া মিত্ৰাণী তাহলে ব্যাপারটা কি জানতে পারত না? সে তত জেগেই ছিল বলতে গেলে সে-রাত্রে!

অবনী সাহা অতঃপর জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আপনার ছেলে রাহুল কেমন আছে?

ভাল-ভাল হয়ে গেছে।

আর সেরকম ভয়টয় পায় না তো?

না।

আচ্ছা তাহলে আমি উঠি সুশাবাবু।

বসুন বসুন-চা খেয়ে যান।

না, এখন আর চা খাব না।

না না, বসুন নাচা না খান, কফি কিংবা ওভালটিন—

না, কিছু প্রয়োজন নেই। মৃদু হেসে অবনী সাহা বলেন, আমি তাহলে উঠি।

অবনী উঠে পড়েন।

সুশান্ত একটা সিগারেট ধরায়। এবং ধূমপান করতে করতে একসময় সুশান্ত এসে জানালাটার সামনে দাঁড়ায়।

বাইরে আলোঝলমল প্রকৃতি।

গেটের সামনে এই কোয়ার্টারে এসে শকুন্তলা শখ করে একটা রক্তকরবীর গাছ এনে পুতেছিল।

হঠাৎ নজরে পড়ল সুশান্তর, গাছটা একেবারে ফুলে ফুলে যেন ছেয়ে গিয়েছে। থোকা থোকা লাল ফুল। কেবল রক্তকরবীই নয়। শকুন্তলার বরাবর ফুলের শখ।

সে আবার নানা প্রকারের ফুলগাছ এনে কোয়ার্টারের সামনে যে ছোট জমিটুকু-সেই জমিতে পুঁতেছিল।

গরীবের ঘর থেকে নিজে পছন্দ করে শকুন্তলাকে বিয়ে করে এনেছিল সুশান্ত।

তখনও তার চাকরি বেশী দিন হয়নি। সামান্য দুবছর মাত্র হয়েছে। নিজের আলাদা ফ্যামিলি-কোয়ার্টারও পায়নি। কোয়ার্টার তো মাত্র বছর-তিনেক হল পেয়েছে সুশান্ত।

কোয়ার্টার পাওয়ার আগে শকুন্তলা তো তার মায়ের কাছেই ছিল কৃষ্ণনগরে। যাতায়াত করত সুশান্ত সেখানে।

শাশুড়ীরও ঐ একমাত্র মেয়ে।

কী আনন্দ কোয়ার্টারে এসে শকুন্তলার! সুখের ছোট্ট সংসারটি। স্বামী-স্ত্রী ও একমাত্র ছেলে রাহুল।

আনন্দের-শান্তির সংসার।

কিন্তু দেড়টা বছরও গেল না, অনেকদিন পরে দ্বিতীয়বার সন্তান হতে গিয়ে একটি মৃত সন্তান প্রসব করে শকুন্তলা অসুস্থ হয়ে পড়ল।

শকুন্তলার শরীরটা যেন ভেঙে গেল। রেলের ডাক্তারকে দেখানো হল। তিনি বললেন স্প্রু। ক্রমশঃ শকুন্তলা রোগে রোগে জীর্ণ হয়ে যেন শয্যাশায়ী হয়ে পড়ল।

সেই সময়-হ্যাঁ, সুশান্তর মনে পড়েছে, রোগের সঙ্গে যুদ্ধ করে করে শকুন্তলাও যেমন ক্রমশঃ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। সুশান্তও যেন ক্রমশঃ তেমনি বিরক্ত হয়ে পড়েছিল।

রোগ রোগ, আর লোগ। কেবল রোগের আর ঔষধের ফিরিস্তি।

সেই সময়ই একটু একটু করে সুশান্ত যেন সংসার থেকে দূরে সরে যেতে শুরু করে। কাজকর্মের ফাকে ফাকে যেটুকু সময় পেত, বাড়িতে আসতে মন যেন কিছুতেই চাইত না। হয় বন্ধু বান্ধবের বাসায়, না হয় ক্লাবে আডড়া দিয়ে বাইরে বাইরেই কাটিয়ে আসত। ঐসময় বাপ সুকান্তও যেন ক্রমশঃ অথর্ব হয়ে পড়তে থাকেন।

বরাবরই হাঁপানী রোগ ছিল।

বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সেই হাঁপানী রোগটা যেন আরও বেশী করে সুকান্তকে আক্রমণ করে। তিনি একপ্রকার শয্যাশায়ীই হয়ে পড়েন।

দুধারে দুজন রোগী—এক ঘরে স্ত্রী, অন্য ঘরে বাপ সুকান্ত। সংসারটা ক্রমশঃ অচল হয়ে উঠতে থাকে। সুশান্তর মন-মেজাজ ক্রমশঃ বিশ্রী হয়ে উঠতে থাকে যেন। ভাল লাগে না—কিছু তার ভাল লাগে না। হাতের সিগারেটটা নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল, সেটা ছুঁড়ে জানালার বাইরে ফেলে দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল সুশান্ত।

ঘুরে দাঁড়াতেই দেওয়ালে টাঙানো শকুন্তলার ফটোটার ওপরে নজর পড়ল। বিয়ের পরে ভোলা শকুন্তলার ফটো। যৌবনলাবণ্যে যেন ঢলঢল করছে।

শকুন্তলা হাসছে।

মিত্ৰাণী বোধ হয় রাঁধছে, বাতাসে চমৎকার মাংসের গন্ধ ভেসে আসছে।

মিত্ৰাণী!

ও-ঘর থেকে সুকান্তর কাশির শব্দ আসছে। সুশান্ত ঘর থেকে বের হয়ে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল। রান্নাঘরের দরজাটা খোলা। মিত্ৰাণী রান্নাঘরে রাঁধছে।

মিতা!

মিত্ৰাণী সুশান্তর ডাকে সাড়া দেয়, ডাকছেন জামাইবাবু?

হ্যাঁ, আজ অফিসে যাব। সুশান্ত বলে।

মিত্ৰাণী রান্নাঘর থেকে বের হয়ে এল আঁচলে হাত মুছতে মুছতে।

অফিসে যাবেন?

হ্যাঁ।

অবনীবাবু এসেছিলেন—

অবনীবাবু!

হ্যাঁ, থানার O.C., বলে গেলেন আমি ডিউটিতে জয়েন করতে পারি।

জয়েন করবেন?

হ্যাঁ-আর বসে থাকব কেন? মিছিমিছি কটা দিন বসে রইলাম। এই কটা দিনের মাইনে শুধু শুধু কাটা গেল। রাহুল বুঝি স্কুলে গিয়েছে?

হ্যাঁ।

তোমার রান্নার আর কত দেরি?

বেশী দেরি নেই। আপনি স্নান করে নিতে-নিতেই সব হয়ে যাবে।

বেশ, আমি স্নানটা করে নিই তাহলে।

সুশান্ত চলে গেল ঘরের দিকে।

শকুন্তলার ঘরটা আজও তালা দেওয়া। পুলিশই তালা দিয়ে গিয়েছে। তালা-দেওয়া ঘরটার দিকে তাকিয়ে ক্ষণেকের জন্য দাঁড়ায় সুশান্ত।

ঘরের দরজাটা সর্বদা খোলাই থাকত। এবং দরজা-বরাবর এমন ভাবে শকুন্তলার খাটটা পাতা ছিল যে খাটে শুয়ে-শুয়েই যেন সব কিছু দেখতে পেত।

ফিরে তাকাল আবার রান্নাঘরের দিকে সুশান্ত এবং তাকাতেই মিত্ৰাণীর সঙ্গে তার চোখাচোখি হয়ে গেল।

মিত্ৰাণী তখনও রান্নাঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পরিশ্রমে ও আগুনের তাপে কপালে কিছু কিছু ঘাম জমে উঠেছে-যেন কয়েকটি টলটলে মুক্তা।

চোখাচোখি হতেই সুশান্তর দিক থেকে মিত্ৰাণী তার চোখের দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল।

সুশান্ত আর দাঁড়াল না। ঘরের মধ্যে দিয়ে ঢুকল। মিত্ৰাণী তাকাল সামনের দিকে।

শকুন্তলার ঘরের দরজায় তালাটা ঝুলছে।

.

জামা-কাপড় পরে খেতে বসে সুশান্ত হঠাৎ একসময় বলে, উঃ, এই কটা দিন যেন ভাল করে নিঃশ্বাস নিতে পারিনি।

মিত্রাণী কোন জবাব দেয় না।

সে মাংসের বাটিটা নিঃশব্দে সুশান্তর পাতের সামনে নামিয়ে দিয়ে রান্নাঘরে চলে যায়।

সুশান্ত ডাকে, মিত্রা!

মিত্ৰাণী সাড়া দেয় রান্নাঘর থেকেই, আর চারটি ভাত দেব?

না না, শোন—এদিকে এস। সুশান্ত ডাকে।

মিত্ৰাণী রান্নাঘর থেকে বের হয়ে এল।

কিছু বলছেন?

হ্যাঁ, বলছিলাম আজ সন্ধ্যার শোতে সিনেমায় যাবে?

সিনেমায়! মিত্ৰাণী সুশান্তর মুখের দিকে তাকায়।

হ্যাঁ, যাবে তো বল, টিকিট কেটে নিয়ে আসব।

না।

যাবে না?

না।

কেন, চল না—ভাল বই একটা হচ্ছে!

না। পূর্ববৎ সংক্ষিপ্ত জবাব।

মিত্ৰাণী আর দাঁড়াল না।

নিঃশব্দে রান্নাঘরের মধ্যে গিয়ে আবার ঢুকল।

সুকান্ত কাশছে।

আজ কদিন থেকে সুকান্তর কাশিটা যেন বেড়েছে।

সর্বক্ষণই কাশছে ঘং ঘং করে একটা বিচিত্র ধাতব শব্দ তুলে।

মনে হয় যেন বড় কষ্ট হচ্ছে ওঁর। রান্নাঘরে বসে বসে মিত্ৰাণী ভারতে থাকে।

সুশান্তর কাছে হঠাৎ আহার্য যেন কেমন বিস্বাদ ঠেকে। উঠে পড়ে ভাতের থালা ছেড়ে। হাত-মুখ ধুয়ে জামাকাপড় পরে দীর্ঘ পনের দিন পরে সুশান্ত আবার বাড়ি থেকে বেরুল।

অফিসে ব্যাপারটা এখনও স্পষ্টাস্পষ্টি জানে না কেউ। জানে কেবল শকুন্তলা তার স্ত্রী বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে। দু-চারজন বন্ধু এসে সহানুভূতিও জানিয়ে গিয়েছে।

একটা সিগারেট ধরিয়ে সুশান্ত হনহন করে এগিয়ে চলে।

আগে কোনদিন সে সিগারেট খায়নি। বাড়িতে এই কদিন বন্দী থাকতে থাকতে সিগারেট খেতে অভ্যাস করেছে সে। এককালে অবিশ্যি সিগারেট খেত, বছর দুই আগে অভ্যাসটা ত্যাগ করে ছিল। কিন্তু এখনও ঠিক ব্যাপারটা ভাল করে রপ্ত করতে পারেনি, নতুন করে আবার খেতে শুরু করে।

দু-একটা টান জোরে দিলেই কাশি আসে। মুখটা তেতো লাগে কেমন যেন।

কাশতে শুরু করে সুশান্ত এবং বিরক্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত আধখানা সিগারেট ছুঁড়ে পথের ধারে ফেলে দেয়।

বিশ্রী তেতো হয়ে গেল মুখটা। একটা মিঠে পান খেতে হবে রাস্তার ধারে পানের দোকান। থেকে। কি করে যে মানুষ ধূমপান করে!

হনহন করে হাঁটতে শুরু করে সুশান্ত।

সুশান্ত লক্ষ্য করে না, ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত একটি যুবক-এতক্ষণ যে তার কোয়ার্টারের অদূরে চুপটি করে দাঁড়িয়ে ছিল, সে তাকে দূর থেকে অনুসরণ করে চলেছে।

সুশান্ত বড় রাস্তায় এসে একটা পানের দোকান থেকে একখিলি মিঠে পান নিয়ে খেলে, তারপর আস্তে আস্তে এগিয়ে বড় রাস্তায় এসে বাস ধরল।

সেই লোকটিও ঐ একই বাসে উঠে পড়ে, ভিড়ের মধ্যে নিজেকে গোপন করে রাখে।

বাসটা যাত্রীতে একেবারে ভর্তি। অফিস-টাইম উৎরে গেলেও বাসে ভিড় যথেষ্ট তখনও। বাসটা শিয়ালদার দিকে চলেছে।

.

সুশান্ত বের হয়ে যেতে মিত্ৰাণী সদরটা বন্ধ করে দিয়ে গেল।

বেশী বেলা হয়নি। মাত্র সোয়া এগারোটা।

সুকান্ত বড্ড বেশী কাশছে আজ।

কী যে হয়েছে সুকান্তর, সে তার ঘরের সামনে গেলেই ভুকুটি করে তার দিকে তাকায়। যেন মনে হয় তাকে একেবারে দৃষ্টি দিয়ে ভস্ম করে দেবে।

সুকান্তর সেই দৃষ্টি যেন মিত্ৰাণীর সর্বাঙ্গে আগুন ধরিয়ে দেবে।

তবু মিত্ৰাণী রান্নাঘরে ঢুকে এক কাপ চা তৈরী করল বেশী দুধ চিনি ও আদার রস দিয়ে, তারপর চায়ের কাপটা হাতে সুকান্তর ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল।

একটু যেন ইতস্ততঃ করল, তারপর ভেজানো দরজাটা ঠেলে ঘরের মধ্যে ঢুকল। সুকান্ত চিরদিনই একটু চায়ের ভক্ত। দিনে-রাত্রে আট-দশ বার চা পান করত। এখানে এসে প্রথম প্রথম সে চা করেও দিয়েছে বার বার সুকান্তকে। কথাটা শকুন্তলাই তাকে বলে দিয়েছিল।

বাবা একটু চা খেতে ভালবাসেন, ওঁকে মাঝে মাঝে চা করে দিস।

প্রথম দিন চা করে নিয়ে যাবার পর এক দ্বিপ্রহরে সুকান্ত কি সই না হয়েছিল। বলেছিল, কী-চা?

হ্যাঁ।

আনন্দে সুকান্তর চোখের তারা দুটো চক্ করে ওঠে। বলে, দাও।

চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে একটা চুমুক দিয়ে সুকান্ত বলেছিল, বাঃ, চায়ের হাতটা তো তোমার চমৎকার!

মিত্ৰাণী চুপ করে ছিল।

কিন্তু কেমন করে জানলে? সুকান্ত চায়ে চুমুক দিতে দিতে প্রশ্নটা করে।

কী?

আমি চা একটু বেশী ভালবাসি।

দিদি বলেছে।

বৌমা! সত্যি বৌমার মত আর মেয়ে হয় না। কী যে অসুখ ধরেছে ওকে! একটু যত্নআত্তি করো।

মিত্রাণী কোন জবাব দেয়নি সে কথার।

তারপর দিনের মধ্যে পাঁচ-সাতবার কাজের ফাঁকে ফাঁকে একটু ফুরসৎ পেলেই সুকান্তকে চা করে দিয়ে এসেছে।

সুকান্ত খুশি হয়েছে।

মধ্যে মধ্যে সুকান্তও ডেকেছে, মিতু মা!

যাই তাওইমশাই–

মিত্ৰাণী হয়তো কাজ করতে করতে জবাব দিয়েছে এবং বুঝতে পেরেছে কেন সুকান্ত ডাকছে।

তাড়াতাড়ি এক কাপ চা করে নিয়ে ঘরে ঢুকেছে।

চায়ের কাপটা হাতে নিতে নিতে সুকান্ত বলেছে, কেমন করে বুঝলে মা যে আমার চায়ের পিপাসা পেয়েছে?

মিত্ৰাণী কোন জবাব দেয়নি।

কিন্তু ইদানীং কয়েক মাস ধরে যেন সুকান্ত মিত্ৰাণীকে সহ্যই করতে পারছিল না।

এমন কি চা দিয়ে গেলেও বিরক্ত হত। মুখটা ভার-ভার এবং মিত্ৰাণীর দিকে না তাকিয়েই বলেছে, রেখে যাও।

প্রথম প্রথম ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি।

তখনও শকুন্তলা একটু-আধটু হাঁটা-চলা করতে পারত। মধ্যে মধ্যে শ্বশুরের ঘরে যেত শ্বশুরের খবরাখবর নিতে।

বাবা, কেমন আছেন?

আমার কথা ছেড়ে দাও, তুমি তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে ওঠ।

মিত্ৰাণী জানে, বুঝতে পেরেছিল, শকুন্তলাই সুকান্তর মনটা বিষিয়ে দিয়েছিল। তার প্রতি, যার ফলে ইদানীং সুকান্ত মিত্ৰাণীর প্রতি বিরক্ত হয়ে উঠেছিল।

মিত্রাণী তাই বুঝি সুকার ঘরে যাওয়াটা ক্রমশঃ কমিয়ে দিয়েছিল।

দিদিও তার প্রতি বিরক্ত, সুকান্তও বিরক্ত। ভাল লাগত না মিত্ৰাণীর ব্যাপারটা।

মধ্যে মধ্যে মনে হয়েছে, দিদিকে সে বলবে মালদহে তাকে আবার রেখে আসতে। একদিন কথাটা বলেও ছিল।

দিদি!

কি?

একটা কথা ভাবছিলাম—

ভ্রূকুঞ্চিত করে তাকায় শকুন্তলা বোনের দিকে, কী কথা?

আমি মালদহেই আবার ফিরে যাই।

অকস্মাৎ যেন ক্ষেপে উঠেছিল সে কথায় শকুন্তলা।

বলেছিল, চোখের আড়াল হতে পারলে আরও সুবিধা হয়, না? জানি-তোমার ঐ ভগ্নীপতিটির পরামর্শ, তাই না?

মিত্ৰাণী চুপ করে ছিল।

শকুন্তলা বলেছিল, কিন্তু তা হবে না বলে দিও তোমার জামাইবাবুটিকে, সর্বনাশ যা ঘটতে চলেছে আমার চোখের সামনেই ঘটুক। তোমরা যে আমার আড়ালে গিয়ে তোমাদের ইচ্ছামত বেলেল্লাপনা করবে তা আমি হতে দেব না বলে তাকে। ঘাসজল খাই না, ঐ ছল-চাতুরীটুকু বোঝবার মত আমার বুদ্ধি আছে।

বলতে বলতে ক্ষোভে আক্রোশে কেঁদে ফেলেছিল শকুলা, কেন, সবই তো চলেছে, বেলেল্লাপনার তো কোন কমতিই নেই, তবে আবার চোখের আড়াল হতে চাওয়া কেন?

বলাই বাহুল্য, অতঃপর মিত্ৰাণী আর কোনদিন ওকথা তোলেনি। কিন্তু সত্যিই যেন তার ভাল লাগছিল না। চলেও হয়ত যেত। কিন্তু পারেনি ঐ রাহুল আর ভগ্নীপতি সুশার জন্যে।

সুশান্ত বার বার বলেছে, তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে এখানে, আমি জানি মিত্রা–

না, কষ্ট কি।

সত্যিই কুন্তলা যেন ক্রমশঃ ইনকরিজিবিল হয়ে উঠছে—

অসুস্থ মানুষ—

কিন্তু সব কিছুরই একটা সীমা আছে, মিত্রা।

সব কথাই কদিন ধরে নতুন করে যেন বার বার মনে পড়ছে মিত্ৰাণীর।

শকুন্তলা যেন মরেনি।

তার শরীরী উপস্থিতিটাই শুধু চোখের সামনে নেই কিন্তু তবু সে যেন আছে—সর্বক্ষণ যেন তার বিদেহী একটা উপস্থিতি মিত্ৰাণী অনুভর করে এ বাড়ির সর্বত্র।

শকুন্তলার ঘরের বন্ধ দরজার দিকে তাকালেই যেন মনে হয়–শকুন্তলা মরেনি—ঐ ঘরের মধ্যেই এখনও আছে।

দরজাটা খুললেই দেখা যাবে—এই দিকে তাকিয়েই সে বসে আছে এখনও।

দুচোখের দৃষ্টিতে ঘৃণা আক্রোশ আর সন্দেহ।

চা তৈরী করতে করতেও ঐ কথাই ভাবছিল আজ মিত্ৰাণী।

১২. ভেজানো দরজাটা ঠেলে

ভেজানো দরজাটা ঠেলে মিত্ৰাণী ঘরের মধ্যে পা দিল।

কে?

কাশতে কাশতেই চোখ তুলে তাকাল সুকান্ত।

মিত্ৰাণী কোন কথা না বলে চায়ের কাপটা নিঃশব্দে সুকান্তর শয্যার সামনে টুলটার ওপর নামিয়ে রাখল।

বিষ দিতে এসেছ-দাও দাও—এ কাজটাই বা আর বাকি থাকে কেন?

ঐ এক বুলি হয়েছে শকুন্তলার মৃত্যুর পর থেকে সুকান্তর।

খাবার দিতে ঘরে ঢুকলেই ঐ এক কথা।

বিষ-বিষ দিতে এসেছ-দাও দাও—কিন্তু এভাবে slowpoisoning করছ কেন—ধীরে ধীরে না মেরে একেবারে বেশ খানিকটা বিষ দিয়ে শেষ করে দাও না, ল্যাঠা চোকে আর তোমরাও বাঁচ।

আজও সেই কথারই পুনরাবৃত্তি করে নিতান্ত যেন অনিচ্ছার সঙ্গেই চায়ের কাপটা তুলে নিল সুকান্ত।

মিত্ৰাণী ঘর থেকে বেরুবার জন্য পা বাড়ায়।

সুকান্ত পিছন থেকে ডাকে, শোন—

ফিরে দাঁড়ায় মিত্ৰাণী।

কিন্তু তোমরা যদি ভেবে থাক, ঐভাবে জ্যান্ত একটা মানুষকে বিষ দিয়ে হত্যা করে তোমরা বিয়ে করে সুখী হবে তো ভুল করছ–

মিত্ৰাণী কোন কথা বলে না।

বুড়োর মুখের দিকে চেয়ে থাকে নিঃশব্দে।

চেয়ে আছ কি? বুড়োর কথা সত্যি কি মিথ্যা জানতে পারবে একদিন। তারপর একটু বেশ দম নিয়ে বলে, হয় না-হয় না—এভাবে একজনের সর্বনাশ করে সুখ পাওয়া যায় না। কেউ কোনদিন পায়নি।

মিত্ৰাণী আর দাঁড়ায় না। ঘর থেকে বের হয়ে যায়।

.

রাহুল ডাকছে।

মাসী-মাসীমণি দরজা খোল!

২৩৭ রাহুল স্কুল থেকে বোধ হয় ফিরল। তাড়াতাড়ি গিয়ে মিত্ৰাণী সদর দরজা খুলে দেয়।

কি করছিলে? এত যে ডাকছি, শুনতে পাও না?

এত তাড়াতাড়ি চলে এলে?

বাঃ, আজ না শনিবার-হাফডে!

সত্যিই তো! আজ শনিবার—মিত্ৰাণীর মনেই ছিল না দিনটা।

মাসীমণি!

কি বাবা?

বড্ড ক্ষিধে পেয়েছে, কিছু খেতে দাও না।

হাত-মুখ ধুয়ে নাও, আমি খাবার আনছি।

মিত্ৰাণী রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।

রাহুল ঘরের মধ্যে বইগুলো রাখছিল-সুকান্তর ডাক শোনা গেল।

দাদু-দাদুভাই!

রাহুল একটু পরে সুকান্তর ঘরে এসে ঢুকল।

আমাকে ডাকছিলে দাদু?

শোন, আয়, কাছে আয়-ফিস্ ফিস্ করে ডাকে সুকান্ত নাতিকে।

কী দাদু?

আয় না, কাছে আয়।

রাহুল এগিয়ে যায়, বল!

খাস না, বুঝলি-খাস না ও যা দেবে–

কী খাব না?

বিষ—বিষ দেবে তোকে-তোর মাকে ওরা মেরেছে, এখন আমাদের দুজনকে মারতে পারলেই–ব্যস, সব চুকে গেল—নিশ্চিন্ত।

তাওইমশাই?

মিত্ৰাণীর তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বরে চকিতে মুখ তুলে তাকায় সুকান্ত দরজার দিকে।

কখন ইতিমধ্যে দরজার উপর এসে মিত্ৰাণী দাঁড়িয়েছে সুকান্ত টেরও পায়নি।

ওসব কি যা-তা বলছেন ঐ একটা বাচ্চাকে?

তীক্ষ্ণ গলায় একটা ধমক দিয়ে ওঠে মিত্ৰাণী সুকান্তকে যেন।

সুকান্ত প্রথমটায় একটু থতমত খেয়ে গিয়েছিল, কিন্তু পরক্ষণেই সে ভাবটা সামলে নিয়ে বলে, বেশ করেছি বলেছি। সত্যি কথা বলব না কেন, একশ বার বলব। মারনি-মারনি তোমরা বৌটাকে আমার বিষ দিয়ে?

রাহুল, যাও এখান থেকে, যাও এ ঘর থেকে।

রাহুল সত্যিই মিত্ৰাণীকে ভালবাসে। সে মিত্ৰাণীর নির্দেশ লঙ্ঘন করতে সাহস পায় না। ঘর থেকে বের হয়ে যায়।

মিত্ৰাণী আবার সুকান্তর দিকে ফিরে তাকায়।

কঠিন কণ্ঠে বলে, জানেন—আপনি জানেন তাকে বিষ দিয়ে মারা হয়েছে?

মেরেছ—নিশ্চয়ই মেরেছ।

না।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, ভাব আমি কিছু বুঝি না? কিছু শুনিনি? জানিনি? সব—সব শুনেছি, সব জেনেছি–

কী-কী জেনেছেন আপনি? কী শুনেছেন?

যা সবাই জেনেছে, যা সবাই শুনেছে!

তাই তো জিজ্ঞাসা করি, কি জেনেছে কি শুনেছে?

তোমরা দুজনে মিলে—

থামুন! ধমকে ওঠে মিত্ৰাণী আবার সুকান্তকে।

কেন—কেন থামবে শুনি?

আপনি কি আপনার ছেলেকে ফাসির দড়িতে ঝোলাতে চান?

চাই, চাই—তাকে একলা নয় শুধু, সেই সঙ্গে তোমাকেও-বুঝলে, তোমাকেও!

একটা কুটিল হিংসায় যেন ফেটে পড়ে সুকান্ত।

প্রত্যেকটি কথার মধ্যে যেন একটা আক্রোশ ঝড়ে পড়ে, একটা ঘৃণা।

আপনি না তার বাবা?

না, না, আমি তার কেউ নয়—কেউ নয়। He is not my son,Iam not his father!

মিত্ৰাণী যেন বিস্ময়ে একেবারে পাথর হয়ে যায়।

কোন বাপ তার ছেলের সম্পর্কে এত বড় কঠিন কথা উচ্চারণ করতে পারে?

ও কি সত্যিই বাপ?

মিত্ৰাণী যেন আর দাঁড়াতে পারে না। ঘর থেকে বের হয়ে যায়।

সত্যিই সে বুঝি বোবা হয়ে গিয়েছে।

মিত্ৰাণী সোজা নিজের ঘরে এসে ঢোকে। এবং ঢুকেই থমকে দাঁড়ায়।

রাহুল জানালার সামনে দাঁড়িয়ে ফুলে ফুলে কাঁদছে।

কী-কী হয়েছে রাহুল?

মিত্ৰাণী এসে তাড়াতাড়ি রাহুলকে বুকের মধ্যে টেনে নেয়।

মাথার চুলে হাত বুলোতে বুলোতে বলে, কাঁদছ কেন বাবা, কি হয়েছে?

মা-আমার মা—

কি হয়েছে?

সত্যিই মাকে তোমরা—তুমি আর বাবা বিষ দিয়ে মেরেছ মাসীমণি?

ছি বাবা, ওসব কথা বলতে নেই। মিথ্যে কথা।

তবে যে দাদু বলল একটু আগে!

দাদু কিছু জানে না।

জানে না?

না, তোমার মা অসুখে মারা গিয়েছে। অসুখে?

হ্যাঁ, চল—হাত মুখ ধুয়ে খাবে চল। তোমার জন্য আমি চিংড়িমাছের কাটলেট করে রেখেছি।

সত্যি?

আনন্দে রাহুলের চোখের মণি দুটো জ্বলজ্বল করে ওঠে। ভিজে চোখে খুশির আলো।

হ্যাঁ–চল।

সেই দিনই রাত্রে। রাত্রি তখন বোধ করি দশটা হবে। পাড়াটা নিঝুম হয়ে এসেছে। মধ্যে মধ্যে কেবল একটা কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে।মিত্ৰাণী জেগে বসে ছিল। বসে বসে একটা বই পড়ছিল, আর মধ্যে মধ্যে বাড়ির পশ্চাতের বাগানের দিককার খোলা জানালা-পথে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকাচ্ছিল। বইয়ের পাতায় যে তার মন নেই সেটা বোঝা যায়। রাহুল সামনের শয্যায় নিদ্রিত। ও-ঘর থেকে মধ্যে মধ্যে সুকান্তর ঘং ঘং কাশির শব্দ শোনা যাচ্ছে। কয়েক দিন থেকেই যেন কাশিটা বেড়েছে ওর। সুশান্ত সন্ধ্যের দিকে খবর পাঠিয়েছে রাত্রে সে আসবে না। সে কাজে জয়েন করার সঙ্গে-সঙ্গেই তার ডিউটি পড়েছে। গাড়ি নিয়ে সে লালগোলা গিয়েছে। আকাশটা বেশ পরিষ্কার। কৃষ্ণপক্ষের রাত্রি। আকাশ-ভরা তারা। বারান্দায় টাঙানো ওয়াল-ক্লকটায় একসময় ঢং ঢং করে রাত এগারটা ঘোষিত হল, মিত্ৰাণী উঠে দাঁড়ায় হাতের বইটা পাশে রেখে। ড্রয়ার থেকে একটা মোমবাতি বের করে বাতিটা জ্বালায়। প্রজ্বলিত মোমবাতিটা বাগানের ধারের জানালাটার একেবারে মুখোমুখি আলমারির উপর বসায়।বাতির শিখাটা মৃদু মৃদু কাঁপছে হাওয়ায়। মিত্ৰাণী এসে খোলা জানালাটার সামনে দাঁড়ালো।

 ১৩. মিত্ৰাণী পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে

মিত্ৰাণী পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে।

মাথার চুল বেণীবদ্ধ। একটা কালো সাপ যেন পিঠের উপর এলিয়ে পড়ে আছে।

পরনে একটি ফিকে গোলাপী রঙের চওড়াপাড় মিলের শাড়ি। সেই শাড়ির উপর মৃদু মোমবাতির আলো পড়েছে।

মিত্ৰাণী তার শ্রবণেন্দ্রিয় যেন উৎকর্ণ করে জানালার বাইরে অন্ধকারের দিকে চেয়ে থাকে। কিন্তু মিত্ৰাণীর প্রতীক্ষ্ণ যেন বৃথাই যায়।

আরও একটা ঘণ্টা অতিবাহিত হয়ে গেল।

ঘড়িতে ঢং ঢং করে রাত বারোটা বেজে গেল। মিত্ৰাণী যেন এবার একটু চিন্তিত হয়ে ওঠে। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস যেন ওর বুকট কাপিয়ে বের হয়ে আসে মনে হল।

জানালার ধার থেকে মিত্ৰাণী সরে এল। রাহুলের শয্যাপাশে এসে দাঁড়াল। রাহুল ঘুমোচ্ছ। মাথার চুলগুলো ঘুমন্ত রাহুলের কপালের উপর থেকে সরিয়ে দিল ধীরে ধীরে মিত্ৰাণী। কি ভেবে যেন বসল রাহুলের শয্যার পাশটিতে। একদৃষ্টে ঘুমন্ত রাহুলের মুখের দিকে চেয়ে থাকে মিত্ৰাণী। শকুন্তলাতার দিদি-ঐ একটিমাত্র সন্ত্রনকে তার যেন সমস্ত প্রাণ দিয়ে ভালবাসত। অসুস্থ রুগ্না হয়েও সর্বক্ষণ যেন দুটো চোখ মেলে রাখত। রাহুল এতটুকু কাদলে বা কিছু করলে অশ্রাব্য কুশ্রাব্য ভাষায় শকুন্তলা মিত্ৰাণীকে গাল দিত। অথচ মিত্ৰাণী সত্যিই রাহুলকে ভালবাসত।

এখানে আসতে-না-আসতেই রাহুলকে সে যেন আপন করে নিয়েছিল। আর রাহুলও-রাহুলও মিত্ৰাণীকে সত্যিই ভালবাসে। মাসীমণি বলতে সে যেন অজ্ঞান।

তথাপি যে কেন শকুন্তলা রাহুলের ব্যাপারেও তাকে সন্দেহ করত সেটাই যেন কিছুতেই বুঝে উঠতে পারেনি মিত্ৰাণী। ভাল লাগছে না আর মিত্ৰাণীর এখানে থাকতে।

শকুন্তলা যেমন একদিন তাকে এখানে এনে আশ্রয় দিয়েছিল, ঠিক তেমনি মৃত্যুর ভিতর দিয়ে তার সেই দেওয়া আশ্ৰয়টা যেন নিজেই আবার ভেঙে দিয়ে গিয়েছে।

তাই এক মুহূর্তও যেন এখানে আর মন টিকছে না তার। ইচ্ছা করছে ফিরে যায় সে আবার মালদহে। কিন্তু

মৃদু একটা খসখস শব্দ শোনা যায় জানালার বাইরে অন্ধকার বাগানে। তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল মিত্ৰাণী। এগিয়ে গিয়ে জানালার সামনে আবার দাঁড়ায়। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বাইরের অন্ধকারে কি যেন সে খোঁজে, কিন্তু দেখতে পায় না কিছু। কিছুই তার নজরে পড়ে না।

প্রিয়তোষ বলে ছেলেটি এখনও বাগানের দিকে একটা গাছের নীচে চুপটি করে দাঁড়িয়ে ছিল।

তার দৃষ্টি স্থিরনিবদ্ধ-মিত্ৰাণীর ঘরের দিকে। ঘরের মধ্যে মোমবাতির আলো জ্বলছে। মিত্ৰাণী জেগে আছে।

অনেকক্ষণ জানালার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল বাইরে তাকিয়ে। ফিরে গেল। আবার কিছুক্ষণ বাদে জানালার সামনে ফিরে এল।

প্রিয়তোষ ওখানে রাত নটা থেকে ডিউটি দিচ্ছে।

কাটাতারের বেড়ার পরেই সরু একটা পায়ে-চলা কাঁচা রাস্তা। তারও ওদিকে রেলওয়ে ইয়ার্ড। রেললাইন চলে গিয়েছে এঁকেবেঁকে পাশাপাশি আড়াআড়ি সমস্ত ইয়ার্ডটা জুড়ে। কিছু দূরে মালগাড়ির কয়েকটা ওয়াগন দাঁড়িয়ে রয়েছে বিচ্ছিন্ন ভাবে যেন।

এদিকটায় বিশ্রী মশার উৎপাত।

মাঝে মাঝে হাওয়া যখন জোরে বইছে মশা থাকে না-হাওয়া কমে গেলেই মশা ছেকে ধরে যেন। একসময় ক্রমশঃ ভোর হয়ে এল।

ভোরের আলো চারিদিকে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠল। প্রিয়তোষ ফিরে গেল।

.

বেলা সাতটা নাগাদ সুশান্ত ডিউটি সেরে ফিরে এল। রাত্রি-জাগরণের ক্লান্তি, চোখের তারা দুটো লাল। মাথার চুল বিস্ত। মেজাজটা যেন ভাল নয়।

মিত্ৰাণী রান্নাঘরে ছিল। রাহুল তাড়াতাড়ি খেয়ে স্কুলে যায়—উনুনে ভাতের হাঁড়িতে ভাত ফুটছে। তরকারির ধামায় গতদিনের আনা সামান্য যা তরকারি অবশিষ্ট ছিল তাই একটা থালায় বঁটি পেতে কুটে কুটে রাখছিল মিত্ৰাণী।

রাহুল তার ঘরে বসে পড়ছে।

মিত্রা!

নিজের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে সুশান্ত ডাকে মিত্ৰাণীকে।

মিত্ৰাণী সাড়া দেয়, আসছি

ভাতের হাঁড়িটা উনুন থেকে নামিয়ে কেতলীতে চায়ের জল চাপিয়ে দিয়ে মিত্ৰাণী এসে সুশান্তর ঘরে ঢোকে।

শকুন্তলার ঘরটায় তালা দেওয়া থাকায় ইদানীং ঘোট যে স্টোররুমের মত একটা ছিল তারই ঘরের লাগোয়া সেই ঘরেই শুচ্ছিল সুশান্ত।

ঐ ঘরটা খোলাবার কোন চেষ্টাও করেনি সুশান্ত।

ঐ ঘরটার দিকে তাকালেই যেন সুশান্তর মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়।

ছোট্ট ঘর—একটিমাত্র জানালা। এত ছোট্ট যে ঘরটায় কোন মানুষ থাকতে পারে না। কিন্তু উপায় কি?

তাছাড়া একটিমাত্র দরজা যাতায়াতের। কোনমতে ক্যাম্প-খাটটা পড়েছে, তাতেই যেন ঘরের সব জায়গাটা ভরে গিয়েছে।

সুশান্ত ক্যাম্প-খাটটার উপর বসে গায়ের জামাটা খুলছিল। আমাকে ডাকছিলেন জামাইবাবু? মিত্ৰাণী দরজার গোড়ায় এসে দাঁড়াল।

জামাটা গা থেকে খুলে একপাশে রেখে সুশান্ত মিত্ৰাণীর দিকে তাকাল, হুঁ, এক কাপ চা খাওয়াতে পার?

চায়ের জল চাপিয়েছি, এখুনি করে এনে দিচ্ছি। টোস্ট না বিস্কুট দেব?

আরে না না, কিছু না। শুধু চা।

মিত্ৰাণী ফিরে যাচ্ছিল।

সুশান্ত ডাকে, আরে শোন–শোন!

কি? ফিরে দাঁড়াল মিত্ৰাণী।

একটা কথা—

কি?

ভাবছি আজ একবার নিউ মার্কেটে যাব।

নিউ মার্কেটে!

হ্যাঁ, অনেকদিন কেক, মাটন-পেস্ট্রি এসব খাইনি, নিয়ে আসি—কি বল? রাহুলও বলছিল।

মিত্রাণী কোন জবাব দেয় না।

তুমি বরং চা-টা জলদি দাও। চা-টা খেয়ে তাড়াতাড়ি এখুনি বের হয়ে পড়ি।

মিত্ৰাণী চলে গেল নিঃশব্দে।

সুশান্ত আপনমনে গুনগুন করে একটা সুর ভাঁজে।

একটু পরে মিত্ৰাণী চায়ের কাপ হাতে সুশান্তর ঘরে এসে প্রবেশ করল।

হাত বাড়িয়ে দেয় চায়ের কাপটা নেবার জন্য সুশান্ত, কিন্তু তার আগেই সামনে ছোট টুলটার উপর চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখে মিত্ৰাণী।

সুশান্ত ভ্রূকুটি করে তাকায় মিত্ৰাণীর দিকে।

হাতটা গুটিয়ে নেয়।

চায়ের কাপটা টুলটার উপরে নামিয়ে রেখে মিত্ৰাণী চলে যাবার জন্য পা বাড়াতেই সুশান্ত ডাকল, মিতা!

মিত্ৰাণী ঘুরে দাঁড়াল নিঃশব্দে। সুশান্তর মুখের দিকে তাকাল মিত্ৰাণী।

তোমার ব্যাপারটা কি বল তো?

প্রশ্নটা করে সুশান্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় মিত্ৰাণীর দিকে।

মিত্ৰাণী চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। কোন কথা বলে না।

সুশান্ত আবার বলে আজ কদিন থেকেই দেখছি তুমি যেন আমার উপরে একটু বিরক্ত!

বিরক্ত হব কেন?

কেন হবে তা তুমিই জান। তবে দেখছি তাই-তুমি কি—

কি?

মিত্ৰাণী!

বলুন?

একটা কথার সত্যি জবাব দেবে?

কি?

সত্যি করে বল তো, কুন্তলার মৃত্যুর জন্য কি আমাকে তুমি সন্দেহ করছ?

কথাটা বলতে বলতে সুশান্ত উঠে দাঁড়ায়।

দু-পা এগিয়ে এসে মিত্ৰাণীর একেবারে মুখোমুখি দাঁড়ায়।

তুমি কি আমাকে সত্যিই সন্দেহ কর নাকি?

এসব কি বলছেন আপনি? ছি!

শোন মিতা, কারো মনে যদি আমাদের কোন সন্দেহ থাকে পরস্পরের প্রতি, সেটার স্পষ্টাস্পষ্টি একটি মীমাংসা হয়ে যাওয়াই ভাল নয় কি?

আমি যাই, ভাতটা ফুটে গিয়েছে

না, দাঁড়াও।

জামাইবাবু, এসব কথা থাক!

না, কথাটা যখন উঠেছে শেষ করতে হবে।

আমাকে যেতে দিন জামাইবাবু!

সুশান্ত ইতিমধ্যে পথরোধ করে দাঁড়িয়েছিল।

মিত্ৰাণী যাবার চেষ্টা করে বোধ হয় পাশ কাটিয়ে।

জামাইবাবু-জামাইবাবু—

হঠাৎ যেন ক্ষেপে ওঠে সুশান্ত, কে তোমার জামাইবাবু-আমি তোমার জামাইবাবু নই!

কি বলছেন আপনি?

ঠিকই বলছি। ভারি তো দূর-সম্পৰ্কীয় বোন—

মিত্ৰাণী যেন কেমন ব্যথিত দৃষ্টিতে তাকায় সুশান্তর মুখের দিকে।

তারপর মৃদুকণ্ঠে বলে, আপনি হয়ত জানেন না জামাইবাবু, কুত্তাদির সঙ্গে আমার তেমন কোন নিকটতম সম্পর্ক না থাকলেও আমার নিজের মায়ের পেটের বোনের চাইতেও বেশী ছিল সে।

তাই বুঝি!

হ্যাঁ, আপনি জানেন না, আমার নিজের কোন সহোদর বোন নেই, কিন্তু থাকলেও বোধ হয় সে কুত্তাদির চাইতে আপন হত না।

ব্যঙ্গভরে জবাব দেয় কটুকণ্ঠে সুশান্ত, তাই বুঝি বোনটি তোমাকে এত ভালবাসত।

কথাটায় কান দিল না বা দাঁড়াল না মিত্ৰাণী। ধীরে ধীরে পাশ কাটিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

সুশান্ত কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে মিত্ৰাণীর গমনপথের দিকে তাকিয়ে থাকে; তার মুখের ওপর একটা বিচিত্র কুটিল ছায়া যেন ভেসে ওঠে।

হাত বাড়িয়ে সুশান্ত চায়ের কাপটা তুলে নেয়। চায়ের কাপে চুমুক দেয়। কিন্তু অত্যন্ত বিস্বাদ যেন লাগে চা-টা সুশান্তর। গলা পর্যন্ত যেন তার তেতো হয়ে গিয়েছে।

ঠক করে চায়ের কাপটা পুনরায় টেবিলের উপর নামিয়ে রাখে।

পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ধরায়, কিন্তু মুখটা যেন আরও বেশী বিস্বাদ হয়ে যায় তাতে করে। সিগারেটটা জানালা-পথে বাইরে নিক্ষেপ করে।

অতঃপর ঐ ছোট্ট ঘরটার মধ্যেই পায়চারি করতে থাকে। পায়চারি করতে করতে হঠাৎ কি ভেবে পায়চারি থামিয়ে জামাটা আবার গায়ে দিয়ে নেয় সুশান্ত। জুতোর মধ্যে পা গলিয়ে বের হয়ে আসে ঘর থেকে।

রান্নাঘরের সামনেই মিত্ৰাণীর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। মিত্ৰাণী শুধায়, কোথায় যাচ্ছেন আবার এসময়?

চুলোয়! বলে সুশান্ত হনহন করে বাইরের দরজার দিকে এগিয়ে যায়।

মিত্ৰাণী বুঝি শেষ চেষ্টা করে বলে, সারাটা রাত ডিউটি করে এসেছেন। রান্না হয়ে গিয়েছিল, স্নান করে খেয়ে বেরুলেই পারতেন জামাইবাবু।

সুশান্ত ফিরে তাকাল মিত্ৰাণীর দিকে একবার। দু-চোখে তার অগ্নিবর্ষী দৃষ্টি।

 ১৪. অগ্নিবর্ষী দৃষ্টি দিয়ে

অগ্নিবর্ষী দৃষ্টি দিয়ে দু-চোখে যেন মিত্ৰাণীকে ঝলসে দিয়ে সুশান্ত মুখটা ঘুরিয়ে আবার দরজার দিকে এগিয়ে যায়।

জামাইবাবু? আবার ডাকল মিত্ৰাণী।

ঘুরে দাঁড়াল সুশান্ত, আমার নিমন্ত্রণ আছে বাইরে।

নিমন্ত্রণ!

হ্যাঁ, তুমি খেয়ে নিও। তাছাড়া রাত্রে হয়ত আমি না-ও ফিরতে পারি।

একটা কথা বলছিলাম—

মিত্ৰাণীর কণ্ঠস্বরে সুশান্ত আবার ঘুরে তাকায় ওর মুখের দিকে।

বলছিলাম কি–আপনি একটা অন্য ব্যবস্থা করে নিন।

তার মানে? কিসের ব্যবস্থা?

রাহুল ও আপনাকে দেখাশোনা করার জন্য একজন লোকের দরকার হবে তো আমি চলে গেলে!

কেন, তুমি চলে যাচ্ছ নাকি?

হ্যাঁ।

কোথায় যাবে শুনি? মালদহে ফিরে গেলে আর তোমাকে তারা জায়গা দেবে মনে কর নাকি?

নাই যদি দেয় তো কি আর করা যাবে। মৃদু হেসে শান্ত গলায় কথাটা শেষ করে মিত্ৰাণী, মালদহই তো পৃথিবীর শেষ একটিমাত্র স্থান নয়!

ওঃ, পৃথিবীটা চিনে ফেলেছ তাহলে?

চিনতে তো হবেই।

তাই বুঝি?

নচেৎ আমাদের মত মেয়েদের চলবে কি করে?

কিন্তু হঠাৎ এ মতলব কেন? সুশান্তর গলার স্বরটা যেন হঠাৎ কেমন করুণ শোনায়।

মতলব আর কি, দিদির জন্যই তো এসেছিলাম, সে-ই যখন-তাছাড়া–

কি?

এখানে যেন আর এক মুহূর্তও আমি টিকতে পারছি না। দম যেন আমার বন্ধ হয়ে আসছে।

দম বন্ধ হয়ে আসছে!

আপনি একজন লোক ঠিক করে নিন—

হুঁ, কারণটা কি তাই, না অন্য কোথায়ও আশ্রয়ের প্রতিশ্রুতি পেয়েছ কারও কাছ থেকে? মিত্ৰাণী হাসল। বললে, কে দেবে আশ্রয়? গলগ্রহ যারা অন্যের হয় তাদের লজ্জা বা অনিচ্ছা বলে কিছুর বালাই না থাকলেও যারা আশ্রয় দেবে তাদের সর্বক্ষেত্রেই প্রায় বলতে গেলে ঐ দুটোই যে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু সেজন্য আপনাকে ভাবতে হবে না!

ভাবতে হবে না।

না। তেমন যদি বিপাকে পড়িই, অন্ততঃ রাস্তা বলেও একটা জায়গা তো আছেই সংসারে, সেখানে তো অন্ততঃ ঢোকবার বা বেরুনোর জন্য কেউ দরজার সৃষ্টি করে রাখেনি!

বেশ, তাই তবে যেও।

কিন্তু রাহুলের–

আমাদের জন্য তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি আসবার আগেও যদি আমাদের চলে গিয়ে থাকতে পারে, তুমি চলে যাবার পরও চলে যাবে। যেদিন যখন খুশি তোমার যেতে পার।

সে তো নিশ্চয়, কার জন্য আর আটকে থাকে এ সংসারে!

কথাটা বলে মিত্ৰাণী ঘুরে রান্নাঘরে গিয়ে ঢোকে।

সুশান্ত তথাপি কয়েকটা মুহূর্ত স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে থাকে।

ইচ্ছা হচ্ছিল তার, ছুটে গিয়ে মেয়েটার গালে ঠাস্ ঠাস্ করে কয়েকটা চড় বসিয়ে দেয়। বলে, অকৃতজ্ঞ—ঝিয়েরও অধম হয়ে সেখানে পড়েছিলি-ভাত তো পেটভরে দুবেলা জুটতই না, উপরন্তু লাথি-ঝাটা—এই বুঝি সেই কৃতজ্ঞতারই ঋণশোধ?

কিন্তু কিছুই বলল না সুশান্ত। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে একসময় বের হয়ে এল বাড়ি থেকে।

আজ দিনে বা রাত্রে আর ডিউটি নেই। ডিউটি পড়েছে সেই কাল ভোরের ট্রেনে। কিন্তু হাঁটতে হাঁটতে সুশান্ত অফিসের দিকেই চলে। খিদেয় পেট চো চো করছে। কাল রাত্রে ক্যানটিনে পেটভরে খাওয়া হয়নি। স্টেশনে পৌঁছে রেলওয়ে ক্যানটিনেই শেষ পর্যন্ত গিয়ে ঢুকল সুশান্ত। পেটে কিছু না পড়লে আর চলছে না। ক্যানটিনে ঐসময় বিশেষ ভিড় ছিল না। একটা লাঞ্চের অর্ডার দিয়ে সুশান্ত কোণের একটা টেবিলে গিয়ে বসল।

মিত্ৰাণী চলেই যাবে মনে হচ্ছে!

যদি চলে যায়—একটা ব্যবস্থা করতে হবেই, রাহুলকে দেখাশোনা করবার জন্য—তাছাড়া অসুস্থ বাপ-একজন লোক না হলে মুশকিল। সে নিশ্চিন্তে ডিউটিও করতে পারবে না। মামার বাড়িতে যে ছেলেটাকে পাঠিয়ে দেবে তার উপায় নেই-হাঁসের পালের মত একপাল ওর মামার সংসারে সর্বক্ষণ প্যাক প্যাক করছে।

ক্যানটিন-বয় এসে সামনের টেবিলে ভাতের প্লেটটা নামিয়ে রাখল।

একটা অল্পবয়সের দুঃস্থ গরীবের মেয়ে রাখলে কেমন হয়? দেখাশোনাও করবে এবং রান্নাবান্নাও করবে। কিন্তু চট করে মিলবে কোথায়? লোকের কথা যে সুশান্ত ভাবেনি তা নয়—মিত্ৰাণীর কথা ছেড়ে দিয়েও সে কদিন ধরে ঐ কথাটাই ভাবছিল।

সমরেশকে কথাটা বলায় সে বলেছিল, পেপারে একটা বিজ্ঞাপন দে!

বিজ্ঞাপন দিয়ে কি হবে? সুশান্ত শুধিয়েছিল।

বিজ্ঞাপনে অনেক সময় অনেক সন্ধান পাওয়া যায়—ভাল কাজ হয়।

সন্ধান পাওয়া যায়—কিন্তু—

কি?

সেরকম খাটতে পারে অল্পবয়সের মেয়ে পাব কোথায়?

সমরেশ ঠাট্টা করে বলেছিল, তা ছেলেমানুষেরই বা দরকার কি? মাঝবয়সী বা বুড়ো–

না, ওগুলো কোন কর্মের হয় না, খালি খায় আর পড়ে পড়ে ঘুমোয়!

সমরেশ চোখ নাচিয়ে বলেছিল, তাহলে বল্ house-keeper housewife- একজন বয়সে তরুণী–

সুশান্ত বাধা দিয়েছিল, কি যা-তা বলিস? মুখে আর কিছু আটকায় না! যত সব অশ্লীল–

অশ্লীল! কি বলছিস সুশান্ত? জীবনের যেটা সর্বাপেক্ষা বড় কথা, সেটাই হয়ে গেল অশ্লীল।

থাম্ তো!

থামিয়ে দিয়েছিল সমরেশকে সুশান্ত।

এ কি, সুশান্ত!

চমকে মুখ তুলে তাকাতেই সমরেশের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল সুশান্তর।

সামনে দাঁড়িয়ে সমরেশ।

কি ব্যাপার রে, ক্যানটিনে খাচ্ছিস ডিউটি-অফ ডে-তে?

গৃহে যে আজ অরন্ধন!

অরন্ধন?

হ্যাঁ।

তোদের আবার ওসব আছে নাকি? তাছাড়া আজ তো অরন্ধন নয়।

পাঁজিতে না থাকলেই কি অরন্ধন গৃহে থাকতে নেই?

বেশ একটুকরো মাছের সঙ্গে একগ্লাস ভাত মুখে তুলেছিল সুশান্ত, মাছের সঙ্গে একটা বড় কাটা মুখে চলে গিয়েছিল, সেটা দু-আঙুলে টেনে বের করতে করতে কথাটা বলে সুশান্ত।

সমরেশ ততক্ষণে সামনের একটা চেয়ার টেনে সুশান্তর মুখোমুখি বসে গিয়েছে।

সে বলে, তাহলে বৌদি যেতে-না-যেতেই তোর হাঁড়ির এই হাল হয়েছে বল।

হুঁ, নিজে তো মরেছেই আমাকেও মেরে রেখে গিয়েছে। সুশান্ত জবাব দেয়।

কিন্তু তুই না সেদিন বলছিলি তোর এক শ্যালিকা গৃহে আছে, সংসার ও ছেলের ব্যাপারে তুই নিশ্চিত!

হ্যাঁ, পুরোপুরি।

তার মানে?

বুঝলি সমরেশ-প্লেট থেকে মুখ তুলে তাকাল সুশান্ত, ঐ মেয়ে জাতটা—

কি?

মানে ঐ মেয়ে জাতটার মত নিমকহারাম ও স্বার্থপর দ্বিতীয় প্রাণী আর নেই সংসারে। তোর তাহলে মত বদলেছে বল আবার?

হ্যাঁ।

দেখ, এক কাজ কর—

কি?

তুই তো বলছিলি তোর শ্যালিকাটি তোরই আশ্রিতা একপ্রকার এবং এখনও অবিবাহিতা–

তাই কি?

বিয়ে করে ফেল না তাকে—সেও বেঁচে যাবে, তোরও এভাবে ছুটির দিনে ক্যানটিনের ভাত এসে গিলতে হবে না।

যেন চমকে ওঠে সুশান্ত।

কি যে বলিস!

কেন, খারাপটা কি বললাম?

যাঃ, তাই হয় নাকি!

হয়, হয়-হামেশাই হচ্ছে, আকছার হচ্ছে। প্রস্তাব করেই দেখ—

হুঁ-তারপর রাজী যদি না হয়?

কেন রে? কণ্ঠস্বরে তোর মনে হচ্ছে, প্রস্তাব করেছিলি! করেছিলি নাকি?

না, না—

তবে?

কি তবে?

প্ৰস্তবটা পেশ করেই দেখ না।

যদি না করে দেয়?

করলেই অমনি হল। তাছাড়া তোর বয়সই বা কি এমন হয়েছে?

সুশান্তর ইতিমধ্যে খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। সে উঠে পড়ে।

সমরেশ ঐসময় বেয়ারাটাকে এক কাপ চা দিতে বলে।

হাত-মুখ ধুয়ে সুশান্ত এসে চেয়ারে পুনরায় বসে একটা সিগারেট ধরায়।

তুই আবার সিগারেট ধরলি কবে থেকে রে?

ধরলাম! উদাস কণ্ঠে জবাব দেয় সুশান্ত।

বেয়ারাটা এক কাপ ধূমায়িত চা এনে নামিয়ে রেখে গেল টেবিলে।

সমরেশ চায়ের কাপটা টেনে নেয়।

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সমরেশ বলে, তোর দেখছি সত্যিই আবার একটি বিয়ে করা দরকার।

সুশান্ত কোন জবাব দেয় না, কেমন যেন অন্যমনস্ক। মনে হয়, যেন কি ভাবছে।

সমরেশ আবার বলে, যা বললাম তাই কর-ওসব বলাবলির মধ্যে যাস না। আবার মেয়ে জাতটার হচ্ছে পেটে ক্ষিধে মুখে লাজ-শ্যালিকাটিকে সিনেমা দেখবার নাম করে বের হয়ে সোজা চলে যা রেজিষ্ট্রি অফিসে–

হুঁ, তারপর?

তারপর আবার কি? একেবারে husband and wife!

মৃদু হাসে সুশান্ত।

হাসছিস?

না, উঠলাম। সুশান্ত উঠে দাঁড়ায়।

সমরেশের কথাটা তখনও তার মনের মধ্যে একটা গুঞ্জন তুলে ফিরছে।

১৫. বেলা এগারটা নাগাদ

বেলা এগারটা নাগাদ সেই যে সুশান্ত বের হয়ে গিয়েছে, এখনও ফেরেনি। রাত প্রায় এগারটা হল।

রাহুল ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘরের মধ্যে একটা মোমবাতি জ্বলছে। মিত্ৰাণী একা দাঁড়িয়ে ছিল জানালাটার সামনে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে। অন্ধকার রেলওয়ে ইয়ার্ডে বোধ হয় শানটিং হচ্ছে কোথাও, তারই আওয়াজ মধ্যে মধ্যে ভেসে আসছে।

পশ্চাতে টেবিলের উপরে সদ্য শেষ করা একটা চিঠি। চিঠির মুখটা বন্ধ করা। উপরে ঠিকানা লেখা। কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত চিঠিটা লিখছিল মিত্ৰাণী। চিঠিটা শেষ করে ঐ জানালার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

মিত্ৰাণী একবার ফিরে তাকায় ঘুমন্ত রাহুলের দিকে।

রাহুল গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। এখন আর তার ঘুম ভাঙবে না। মিত্ৰাণী এগিয়ে এসে আলনা থেকে একটা চাদর টেনে নিল-চাদরটা গায়ে জড়িয়ে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বের হয়ে এল। ঘরের দরজাটা নিঃশব্দে ভেজিয়ে দিল।

সদর দরজা খুলে বের হল। সদরে ইয়েল লক লাগানো। দরজার কপাট দুটো টেনে দিতেই দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল।

গেট দিয়ে বের হয়ে মিত্ৰাণী দ্রুত হেঁটে চলে।

নির্জন চারিদিক-জনপ্রাণীর চিহ্নমাত্রও নেই কোথাও। কিছুদূর এগিয়ে যায় মিত্ৰাণী হনহন করে। রাস্তার মোড়ে একটা লেটার-ব—তার মধ্যে চিঠিটা ফেলে দিল মিত্ৰাণী।

হনহন করে বাড়ির দিকে আবার ফিরে চলে।

হাতেই চাবি ছিল মিত্ৰাণীর। চাবি দিয়ে দরজাটা খুলে ভিতরে প্রবেশ করল। নিজের ঘরে এসে ঢুকে রাহুলের দিকে একবার তাকাল। রাহুল ঘুমোচ্ছে। বোধ হয় দু-মিনিটও হয়নি সদর দরজা খোলার শব্দ পায় মিত্ৰাণী।

মিত্ৰাণী বুঝতে পারে সুশান্ত ফিরল।

তার কাছে একটা চাবি থাকে, সেই চাবি দিয়েই রাত্রে এলে দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে। অনেক সময় রাত্রে তাকে ফিরতে হয়, সে-সময় সে কাউকে ডাকাডাকি করে না।

মিত্ৰাণী কান পেতে থাকে। রাত সাড়ে এগারোটা বাজে। টেবিলের উপরে রাখা টেবিলক্লকটার দিকে তাকিয়ে দেখে মিত্ৰাণী। খাবারটা বোধ হয় ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে। খাবারটা গরম করে দিলে সুশান্ত খেতে পারবে না। মিত্ৰাণী ঘর থেকে বের হয়ে রান্নাঘরের দিকে গেল।

.

সুশান্তর ঘরের দরজাটা খোলা। দরজা-পথে আলোর আভাস আসছে।

সুশান্তই এসেছে।

ঘরের সামনে আসতেই চোখে পড়ল সুশান্ত ঘর থেকে বের হয়ে আসছে। ঘর থেকে বের হয়ে সুশান্ত মুহূর্তের জন্য দাঁড়াল, রান্নাঘরের দিকেই তার দৃষ্টি মনে হল মিত্ৰাণীর।

ভাতটা একেবারেই ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে। নিবন্ত চুল্লীর উপরে যদিও ভাতের হাঁড়িটা বসিয়ে রেখেছিল মিত্ৰাণী, চুল্লীর আগুন একেবারে নিভে গিয়েছে। মিত্ৰাণী তাই ভাবছিল, কি করে ঠাণ্ডা ভাতটা গরম করবে!

সুশান্ত এসে রান্নাঘরের খোলা দরজার সামনে দাঁড়াল।

মিতা!

আপনি ঘরে গিয়ে বসুন জামাইবাবু, ভাতটা একেবারে ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে, একটু গরম করে আনছি।

জনতা স্টোভটায় আগুন দিয়ে মিত্ৰাণী ভাতটা গরম করবার জন্য ব্যস্ত ছিল।

তোমাকে ব্যস্ত হতে হবে না, আমি বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি।

খেয়ে এসেছেন!

হ্যাঁ, তুমি একটু আমার ঘরে এস, তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।

আপনি যান, আমি আসছি।

সুশান্ত তার ঘরে ফিরে গেল।

গায়ের জামাটা খুলে একটা পায়জামা পরেছিল সুশান্ত। গলাটা কি রকম যেন শুকিয়ে যাচ্ছে, অত্যধিক মদ্যপান করেছে আজ সুশান্ত। সমরেশের ওখানে মধ্যে মধ্যে ড্রিঙ্ক করত দুই বন্ধুতে।

আজ একটু সুবিধাই হয়েছিল। সমরেশের স্ত্রী গৃহে ছিল না, সন্ধ্যা থেকে বসে বসে দুই বন্ধুতে পুরো একটা বোতল শেষ করেছে। খাওয়ার কথা মিথ্যা বলেছে সুশান্ত।

খাওয়া মানে দুই বন্ধুতে আকণ্ঠ মদ্যপান!

রাত অনেক হতে একসময় সমরেশ জিজ্ঞাসা করে, কি রে, যাবি না বাড়ি?

বাড়ি!

হুঁ, রাত প্রায় সোয়া এগারটা—

তাই নাকি?

ঐ দেখ টেবিল-ক্লকটার দিকে চেয়ে।

সুশান্ত অতঃপর টলতে টলতে উঠে দাঁড়ায়। মাথা হাল্কা, শরীরটাও হাল্কা হয়ে গিয়েছে নেশায়। হেঁটে আসার ক্ষমতা ছিল না সুশান্তর। একটা ট্যাক্সি নিয়েই সে ফিরে আসে। মোড়ের মাথাতেই ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিয়ে সুশান্ত বাকি পথটুকু হেঁটে এসেছিল। বাড়ির গেটের কাছে এসেই মিত্ৰাণীর ঘরের আলো জ্বলছে দেখতে পায়।

আরো দেখতে পায় জানালার সামনে মিত্ৰাণী আছে। মিত্ৰাণী তাহলে জেগেই আছে! সুশান্ত এগিয়ে এসে পকেট থেকে চাবিটা বের করে সদর দরজার লক্টা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে।

.

মিত্ৰাণী এসে ঘরের দরজার সামনে দাঁড়াল।

সুশান্ত একটা সিগারেট ধরিয়ে টানছিল।

আমাকে ডাকছিলেন জামাইবাবু?

হ্যাঁ-এস, ভেতরে এস।

মিত্ৰাণী একবার সুশান্তর মুখের দিকে তাকাল।

দু-পা এগিয়ে দরজার গোড়াতেই দাঁড়িয়ে বললে, বলুন—

একটা কথা ভাবছিলাম—

কি?

তুমি তখন বললে চলে যাবে–

হ্যাঁ।

ব্যাপারটার অন্যভাবে একটা মীমাংসা হতে পারে না?

মীমাংসা!

হ্যাঁ।

আপনি ঠিক কি বলতে চান বুঝতে পারছি না।

যদি ধর তোমাকে আমি বিয়ে করি—

ছি!

পরিপূর্ণ একটা ঘৃণায় যেন কথাটা উচ্চারিত হল মিত্ৰাণীর কণ্ঠ হতে।

ছি কেন? আমার বয়স বেশী বলে একটু?

না।

তবে?

তা সম্ভব নয়।

তাই তো জিজ্ঞাসা করছি, কেন সম্ভব নয়? বাধাটা কোথায়? কিসেরই বা বাধা আমাদের বিয়েতে?

আমি যাচ্ছি। যাবার জন্যই বোধ হয় মিত্ৰাণী ঘুরে দাঁড়ায়–পা বাড়ায়।

সুশান্ত তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে।

দুপা এগিয়ে এসে বলে, দাঁড়াও-শোন মিতা–

না, বললাম তো না!

সুশান্ত হঠাৎ হাত বাড়িয়ে মিত্ৰাণীর একটি হাত চেপে ধরে। বলে, বল–কেন না, মিতা?

আঃ ছাড়ুন, কি করছেন!

পাশের ঘর থেকে ঐ সময় সুশান্তর বাপ সুকান্তর কাশির শব্দ শোনা গেল।

হঠাৎ সুকান্ত কাশতে সুরু করেছে।

সুশান্ত চাপা কণ্ঠে মিত্ৰাণীর হাতটা আরও দৃঢ় মুষ্টিতে চেপে ধরে বলে, না, বলতেই হবে তোমাকে, বল-বল–

সুশান্ত যেন ক্ষেপে গিয়েছে। ভরভর করে সুশান্তর মুখ থেকে মদের গন্ধ বের হচ্ছে।

কেঁপে ওঠে মিত্ৰাণী যেন। এক ঝটকা দিয়ে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নেয় মিত্ৰাণী এবং সুশান্ত কিছু বুঝবার আগেই ছুটে গিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে মিত্ৰাণী ঘরের দরজাটা বন্ধ করে ভিতর থেকে খিল তুলে দেয়। সে তখনও রীতিমত হাঁপাচ্ছে। বুকের ভিতরটা তখনও তার যেন থরথর করে কাঁপছে।

সুশান্ত বন্ধ দরজার গায়ে মৃদু ধাক্কা দিতে দিতে চাপা কণ্ঠে ডাকে, মিতা, মিতা!

দু-হাতে মুখ ঢেকে ফেলে মিত্ৰাণী। দু চোখের কোল ছাপিয়ে হুঁ হুঁ করে জল নেমে আসে। সুশান্তর ইদানীংকার চোখের দৃষ্টিটার তাৎপর্য যেন এক্ষণে স্পষ্ট হয়ে ওঠে মিত্ৰাণীর কাছে।

সুশান্তর মনে তাহলে এই ছিল? ছিঃ ছিঃ ছিঃ!

কুলাদি এইজন্যই তাহলে ইদানীং তার ওপরে এত বিরক্ত হয়ে উঠেছিল?

সে স্ত্রী হয়ে তার স্বামীর চোখের দৃষ্টিকে ভুল করেনি। আর স্বাভাবিক ভাবেই হয়তো সে ভেবে নিয়েছিল মিত্ৰাণীরও সায় আছে।

ছিঃ ছিঃ ছিঃ! ঘৃণায় লজ্জায় ও একটা অবিমিশ্র ধিক্কারে নিজেকে যেন মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে ইচ্ছে করে মিত্ৰাণীর। এর পর আর এক মুহূর্তও কি তার এখানে থাকা নিরাপদ বা যুক্তিসঙ্গত হবে?

 ১৬. লেটার-বকস্ থেকে

প্রিয়তোষই লেটার-বকস্ থেকে পরের দিন বিটের পিওনের সাহায্যে চিঠিটা সংগ্রহ করে এনেছিল।

অবনী চিঠিটা পেয়েই কিরীটীকে ফোনে সংবাদ দিয়েছিল।

একটা চিঠি পাওয়া গিয়েছে কিরীটীবাবু।

কিরীটী ঐসময় কৃষ্ণার সঙ্গে বসে দাবা খেলছিল।

মনটার মধ্যে তখনও দাবার ছকটা ও দাবার খুঁটিগুলোই ঘোরাফেরা করছিল।

বলে, চিঠি!

হ্যাঁ।

কার?

মিত্ৰাণীর।

মিত্ৰাণী চিঠি দিয়েছে নাকি!

না না–

তবে?

সে লিখেছিল একজনকে।

কাকে?

সঞ্জীব দত্তকে। আপনি আসুন একবার।

এতক্ষণে যেন কিরীটী তার নিজের মধ্যে ফিরে আসে। মনোযোগী হয়ে ওঠে। বলে, মিত্ৰাণী মানে সেই সুশান্ত চ্যাটার্জির শ্যালিকা?

হ্যাঁ।

আসছি আমি।

কিরীটী ফোনটা নামিয়ে রাখল।

আর দেরি না করে জামাটা কোনমতে গায়ে চড়িয়ে তখুনি সোজা থানায় চলে আসে। প্রিয়তোষ তখনও তার কথা ফলাও করে অবনীকে বলছিল। কিরীটীকে থানায় প্রবেশ করতে দেখে সে থেমে যায়।

এই যে আসুন-শেষ পর্যন্ত আপনার ফাঁদে পা দিয়েছেন দেবী—

হাসতে হাসতে অবনী বলে।

কই, দেখি কি চিঠি?

খোলা চিঠিটা কিরীটীর হাতে এগিয়ে দেয় অবনী মিত্র।

সযত্নে জলের সাহায্যে চিঠিটা খুলে ফেলেছিল অবনী মিত্র।

খাম থেকে চিঠিটা টেনে বের করে কিরীটী।

উপরে সঞ্জীব দত্তর নাম-ঠিকানা থাকলেও ভিতরে চিঠিতে কোন সম্বোধন নেই। এক সংক্ষিপ্ত চিঠি :

তোমার ব্যাপার কি সত্যিই বুঝতে পারছি না।

রাগ করেছ নাকি? নাকি খুব কাজে ব্যস্ত! কুড়ি-পঁচিশ দিনেরও বেশী হয়ে গেল একটিবার দেখা করবারও সময় পেলে না?

আমার বিপদটা কি তুমি বুঝতে পারছ না? সত্যি সর্বক্ষণ আমার বুকটা কাঁপছে ভয়ে আর দুশ্চিন্তায়। কি হবে বুঝতে পারছি না। দারোগাবাবু বোধ হয় কিছু সন্দেহ করেছেন।

আরও কি সেদিন বলে গেছেন জান? কুন্তদি নাকি বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেনি। তাকে হত্যা করা হয়েছে। তাছাড়া এখানে জামাইবাবুরও চোখের দৃষ্টি, কথাবার্তা ইদানীং যেন কেমন মনে হচ্ছে।

লক্ষ্মীটি, চিঠি পাওয়া মাত্রই তুমি এসে আমার সঙ্গে দেখা করবে।

দরজায় টোকা দিলেই দরজা খুলে দেব।

আমি জেগেই থাকব।

ইতি—তোমার মিতুয়া

কিরীটী বার-দুই চিঠিটা আগাগোড়া পড়ল। তারপর চিঠিটা ভাঁজ করতে করতে অবনী মিত্রের দিকে তাকাল।

চিঠিটা কোথায় পেয়েছেন?

প্রিয়তোষ এনেছে, তবে আর বলছি কি! ভাগ্যে আপনি বাড়িটার ওপর সর্বক্ষণ ওয়াচ রাখতে বলেছিলেন! অবনী মিত্র পরিতৃপ্তির হাসি হাসেন।

কোথায় পেলেন, প্রিয়তোষবাবু? কিরীটী প্রিয়তোষের মুখের দিকে তাকায়।

ওদের কোয়ার্টারের কাছে ঠিক রাস্তার মোড়ে যে লেটার-বক্সটা আছে, কাল একসময় মিত্ৰাণী দেবী এসে তার মধ্যে চিঠিটা ফেলে দেয়। আজ সকালে চিঠিটা পিওনের সাহায্যে হাতিয়েছি।

হুঁ! কিরীটী কি যেন ভাবছে।

কি ভাবছেন মিঃ রায়?

কিরীটী সে কথার জবাব না দিয়ে নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে, বেলা সোয়া আটটা-চলুন—উঠুন–

উঠব।

হ্যাঁ, চলুন একবার ঘুরে আসি।

কোথায়?

সুশান্ত চ্যাটার্জির কোয়ার্টারে।

যাবেন?

হ্যাঁ, চলুন।

.

ওরা আর দেরি করে না। অবনী মিত্রের জীপেই দুজনে বের হয়ে পড়ে। ওরা যখন সুশান্ত চ্যাটার্জির কোয়ার্টারের সামনে এসে জীপ থেকে নামল, নটা বাজতে তখনও মিনিট কুড়ি বাকি।

কলিং বেল টিপতেই একটু পরে দরজাটা খুলে গেল।

সামনে দাঁড়িয়ে মিত্ৰাণী। তার চোখে-মুখে যেন রাত্রি-জাগরণের একটা বিষণ্ণ ক্লান্তি। মিত্ৰাণী ওদের ঐ সময় দেখে যেন একটু অবাকই হয়।

কিরীটীই প্রশ্ন করে, সুশান্তবাবু বাড়িতে আছেন?

হ্যাঁ।

কি করছেন তিনি?

ওরা ভিতরে গিয়ে ঢুকল।

দুজনে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে দুটো চেয়ার অধিকার করে বসে।

কি করছেন তিনি?

কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।

ঘুমোচ্ছেন বোধ হয়।

এখনও ঘুমোচ্ছন?

কিরীটীর প্রশ্নে মিত্ৰাণী মাথাটা নীচু করে। কোন জবাব দেয় না।

রাত্রে ডিউটি ছিল বুঝি মিঃ চ্যাটার্জির? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।

না।

তবে এমনি বেলা পর্যন্তই ঘুমোন নাকি উনি?

সে প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে মিত্ৰাণী বলে, আমি ডেকে দিচ্ছি তাকে।

মিত্রাণী ভিতরের দিকে পা বাড়ায়। কিরীটী সঙ্গে সঙ্গে বাধা দেয়। বলে, শুনুন শুনুন, ব্যস্ত হবেন না, একটু পরে তাকে ডাকলেও চলবে।

মিত্ৰাণী তাকায় কিরীটীর মুখের দিকে।

বসুন, আপনার সঙ্গে কিছু কথা আছে।

মিত্ৰাণী কিরীটীর মুখের দিকে তখনও তাকিয়ে আছে।

বসুন!

মিত্ৰাণী কিন্তু বসে না। দাঁড়িয়েই থাকে।

রাহুল কোথায়?

স্কুলে গেছে।

আর ভয় পায়নি তো?

ভয়!

হ্যাঁ, আমার মনে হয় কোন কারণে ভয় পেয়েই বোধ হয় ওর হঠাৎ সেদিন জ্বর হয়েছিল।

ভয় কেন পাবে?

পেতেও তো পারে। যেমন ধরুন আচমকা কাউকে জানালার ধারে অন্ধকারে দেখে হঠাৎ ঘুম ভেঙে–

মিত্ৰাণী কিরীটীর মুখের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে আছে তখনও।

যাক সে কথা। সেদিন আপনি আমাদের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, দুর্ঘটনার দিন রাত্রে তৃতীয় কোন ব্যক্তি আপনার শোবার ঘরে আসেনি!

হ্যাঁ।

কিন্তু, যদি বলি আপনি deliberately-ইচ্ছা করেই মিথ্যা কথা বলেছেন?

মিথ্যা!

হ্যাঁ, মিথ্যা—আপনি মিথ্যা বলেছেন।

আমি–

শুনুন মিত্ৰাণী দেবী, আমি জানি সে-রাত্রে কেউ আপনার ঘরে এসেছিল; আবার আমি জিজ্ঞাসা করছি-এখনও বলুন, কে তৃতীয় ব্যক্তি সে-রাত্রে আপনার ঘরে এসেছিল?

কিরীটীর কণ্ঠস্বর কঠিন তীক্ষ্ণ, চোখের দৃষ্টি যেন অন্তস্তল ভেদ করে যাচ্ছে।

কিরীটীর কণ্ঠস্বর—বিশেষ করে অন্তর্ভেদী কিরীটীর চোখের সেই দৃষ্টি সহসা মিত্ৰাণীকে যেন কেমন বিবশ করে দেয়।

বলুন, কে এসেছিল?

মিত্ৰাণী যেন পাথর।

সঞ্জীব দত্ত এসেছিল, তাই না?

না, না–

জানেন—একটু থেমে কিরীটী বলে, শুনুন মিত্ৰাণী দেবী, সত্যকে আপনি চাপা দিয়ে রাখতে পারবেন না, প্রকাশ তা পাবেই। সূর্যের আলোকে চাপা দেওয়া যায় না, এখনও বলুন—এখনও স্বীকার করুন সে রাত্রে কে আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল?

মিত্ৰাণী যেন পাথর হয়ে গিয়েছে। কোন সাড়া নেই, কোন শব্দ নেই তার মুখে। ওষ্ঠে এতটুকু কুঞ্চনও নেই। দু-চোখে ভাষাহীন বোবা দৃষ্টি।

এখনও বলুন মিত্ৰাণী দেবী, কে এসেছিল আপনার ঘরে সে-রাত্রে? এখন না বললেও জানবেন—আজ হোক কাল হোক সব বলতে আপনাকে হবেই। কিরীটী বলতে থাকে, স্বীকার আপনাকে করতেই হবে, নচেৎ অবনীবাবু আপনাকে আপনার বোন শকুন্তলা দেবীর হত্যাপরাধে গ্রেপ্তার করবেন।

হত্যাপরাধে।

হ্যাঁ, শকুন্তলা দেবী যে সে-রাত্রে বিষ খেয়ে অত্মহত্যা করেননি, সে-কথা আপনি জানেন।

আমি বিশ্বাস করি না সে-কথা।

বিশ্বাস না করলেও তাই সত্য বলে জানবেন। তিনি আত্মহত্যা করেননি। তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা-খুন করা হয়েছে।

না, না–

হ্যাঁ, তাকে হত্যা করা হয়েছে-নিষ্ঠুর, নৃশংস হত্যা। এখনও বলুন, সে-রাত্রে আপনার জামাইবাবু ছাড়াও তৃতীয় ব্যক্তি কে আপনার ঘরে এসেছিল? বলুন?

কিরীটীর কণ্ঠস্বর, তার চোখের ধারালো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মিত্ৰাণীকে যেন কেমন বিবশ করে দেয়।

১৭. কিরীটীর মুখে উচ্চারিত শেষের কথাগুলো

বিশেষ করে কিরীটীর মুখে উচ্চারিত শেষের কথাগুলো মিত্ৰাণীকে যেন সত্যিই পাথর করে দেয়, সে তার প্রতিরোধক্ষমতা হারায়।

কিরীটী চেয়ে আছে তখনও মিত্ৰাণীর দিকে।

সে-রাত্রে কেউ তাহলে আপনার ঘরে এসেছিল।

মৃদু-অত্যন্ত মৃদু কণ্ঠে এবার জবাব দেয় মিত্ৰাণী। সে বলে, হ্যাঁ।

কে? কে সে?

সঞ্জীব।

সে তাহলে আপনার বিশেষ পরিচিত?

হ্যাঁ। মালদহে আমরা পাশাপাশি বাড়িতে থাকতাম।

তার সঙ্গে আপনার তাহলে বলুন অনেক দিনের পরিচয়! কিরীটী পুনরায় শুধায়।

হ্যাঁ।

কত দিনের পরিচয়?

আট-নয় বছর হবে।

কি করে সে?

জানি না, কলকাতা পোর্ট কমিশনারে যেন কিছুদিন হল কি একটা চাকরি পেয়েছে।

এখানে কোথায় থাকে?

মানিকতলায় থাকে, তবে কোথায় তা ঠিক জানি না।

জানেন আপনি, মিথ্যা বলছেন। বলুন তার ঠিকানা কি?

সে একটা বস্তী শুনেছি-খালের ওপারে।

হুঁ। তা অত রাত্রে কেন এসেছিল সঞ্জীব দত্ত? আপনার সঙ্গে দেখা করতে নিশ্চয়ই?

হ্যাঁ।

এর আগে কখনও এসেছে?

হ্যাঁ।

নিশ্চয়ই সব সময় রাত্রেই সে এসেছে?

হ্যাঁ।

দিনের বেলা এলে পাছে জানাজানি হয়ে যায় বলে বোধ হয়?

হ্যাঁ। সুশান্তবাবু বা তার স্ত্রী নিশ্চয়ই জানতেন ব্যাপারটা?

না।

সে-রাত্রে বোধ হয় ঘর অন্ধকার করে সঞ্জীবকে ঘরে এনেছিলেন?

হ্যাঁ।

তাই–তাই রাহুল মধ্যে মধ্যে অন্ধকারে সঞ্জীববাবুকে দেখত বলেই বোধ হয় ভয় পেয়েছে। ঠিক আছে আপনি যান, সুশান্তবাবুকে একবার পাঠিয়ে দিন।

মিত্ৰাণী উঠে দাঁড়াল।

শিথিল ক্লান্ত পায়ে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বের হয়ে গেল মিত্ৰাণী।

অবনী এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল ওদের কথাবার্তা। একটি কথাও বলেনি। মিত্ৰাণী চলে যেতে সে কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে ডাকে, মিঃ রায়?

উঁ।

আপনি জানলেন কি করে কথাটা—ঐ সিগারেটের টুকরোটা থেকেই?

না, বাগানে জুতোর ছাপ আর ঐ সিগারেট—দুই মিলে চার হয়েছে, তারপর এই চিঠি।তা তো হল! ব্যাপারটা যেন কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে এখন!

কেন?

মিত্ৰাণী যদি সঞ্জীবকেই ভালবাসত, তাহলে–

শুনলেন তো, সেটা সম্ভবত সুশান্তবাবু এখনও জানেন না!

তা অবিশ্যি—তাহলে অন্য পক্ষের সক্রিয় সহযোগিতা না থাকলে—

অবনীবাবু, রহস্যের জালটা সবে একটু সরেছে, এখনও অনেকটা ঝাপসা অস্পষ্ট—

কিরীটীর কথা শেষ হল না, সুশান্ত এসে সামনে দাঁড়াল।

আপনারা!

হুঁ, বসুন।

সুশান্ত বসল চেয়ারটায়। সুশান্ত চেয়ারে বসে কিরীটীর মুখের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায়।

তার মুখের দিকে তাকালে মনে হয় যেন সে একটু বিস্মিত হয়েছে। গত-রাত্রের অত্যধিক মদ্যপানের জন্য মাথাটা তখনও বেশ ভারী, চোখের পাতা থেকেও ঘুম একেবারে মুছে যায়নি।

কিরীটী মৃদু কণ্ঠে ডাকে, সুশাবাবু!

বলুন।

সঞ্জীব দত্ত বলে কাউকে চেনেন?

সঞ্জীব দত্ত।

হ্যাঁ, নামটা কখনও শুনেছেন?

না তো! কে সে?

নামটাও শোনেননি তাহলে? মিত্ৰাণীর মুখেও কখনও শোনেননি?

না। বুঝতে পারছি আপনি জানেন না, কিন্তু সেই ভদ্রলোক মধ্যে মধ্যে এখানে আসতেন। এখানে আসতেন মানে? আপনার কথা তো কিছু বুঝতে পারছি না!

এখানে আসতেন মানে মিত্ৰাণী দেবীর সঙ্গে দেখা করতে—

মিত্ৰাণীর সঙ্গে!

হ্যাঁ, আর সেই দুর্ঘটনার রাত্রেও সেই সঞ্জীব দত্তই মিত্ৰাণী দেবীর ঘরে এসেছিল।

সে কি! কেন?

কারণ সেই যুবক দীর্ঘদিন থেকে মিত্ৰাণীর সঙ্গে পরিচিত এবং ওদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতাও আছে।

না, না-মিথ্যা–

মিথ্যা নয় সুশান্তবাবু, নিষ্ঠুর নির্মম সত্য। কথাটা বলেই হঠাৎ উঠে দাঁড়াল কিরীটী। আচ্ছা আজ এবার আমরা উঠব। আর একটা কথা, অবনীবাবুকে না জানিয়ে কলকাতার বাইরে আপাততঃ কোথাও আপনি যাবেন না যেন।

যাব না?

না, তাতে কিন্তু আপনার বিপদ ঘটতে পারে!

তারপরই কিরীটী অবনী মিত্রের দিকে তাকিয়ে বলে, উঠুন অবনীবাবু–যাওয়া যাক।

সুশান্ত স্থাণুর মত চেয়ারটার ওপর বসে রইল। তার মাথার ঝিমঝিম ভাবটা তখন কেটে গিয়েছে। চোখের ঘুম-ঘুম ভাবটাও চোখ থেকে সম্পূর্ণ মুছে গিয়েছে।

মিত্ৰাণী—তার কাছে সঞ্জীব দত্ত মধ্যে মধ্যে আসত! তারা অনেক দিনের পরস্পরের পরিচিত! মিত্ৰাণী-সঞ্জীব দত্ত-মাথাটার মধ্যে যেন আগুন জ্বলছে-সুশান্ত চেয়ারের হাতলটা শক্ত মুঠিতে চেপে ধরে। চোয়াল দৃঢ় হয়—মিত্ৰাণী-সঞ্জীব।

.

কিরীটী আর অবনী সুশান্তর কোয়ার্টার থেকে বের হয়ে এল।

বেলা তখন সাড়ে বারোটা। আকাশের মেঘ তখনও কাটেনি। কিন্তু বৃষ্টিও আর নামেনি। কেবল একটা ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা হাওয়া বইছিল। দুজনে জীপে উঠে বসে। অবনীই স্টীয়ারিং ধরেন। কিরীটী পাশে বসে একটা সিগারেট ধরায়।

অবনী সাহা জীপ চালাচ্ছিলেন।

মৃদু কণ্ঠে একসময় কিরীটী ডাকে, অবনীবাবু।

বলুন? অবনী সাড়া দিলেন।

আজ একবার বিকেলের দিকে এক জায়গায় চলুন—

কোথায়?

মানিকতলা খালের ওপারে—শ্রীমান সঞ্জীবচন্দ্রের দেখা যদি পাওয়া যায়।

কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না কিরীটীবাবু।

কি?

সঞ্জীব দত্তর শকুন্তলা দেবীকে হত্যা করবার কি এমন কারণ থাকতে পারে?

কার কোথায় কি ইন্টারেস্ট থাকতে পারে, তা এত সহজেই বলা যায় না মিঃ মিত্র! চলুন না—আলাপ করে দেখাই যাক ভদ্রলোকের সঙ্গে আগে একটিবার!

বেশ।

১৮. ঐদিন সন্ধ্যার কিছু আগে

ঐদিন সন্ধ্যার কিছু আগেই ওরা বের হয়ে পড়েছিল মানিকতলা খালপারের বস্তীর উদ্দেশ্যে।

বস্তীটা যেমন ঘিঞ্জি তেমনি বহু বিচিত্র লোকের বাস সেখানে। প্রায় দু-ঘণ্টা খোঁজবার পর এক ছোরার কাছে সঞ্জীব দত্তর সন্ধানটা পাওয়া গেল।

মাস্তান গোছের একটি বছর আঠারো-উনিশ বয়সের ছেলে। নাম জানা গেল সুবিমল। ‘স’ ‘স’ করে ছেলেটি কথা বলে। পরনে একটা ড্রেন-পাইপ প্যান্ট, গায়ে রংচঙে একটা হাওয়াই শার্ট। পায়ে চপ্পল। মাথার চুল সিনেমার অ্যাক্টরের ধরনের ছাঁটা।

সে কি নাম বললেন, স্যার? সুবিমল শুধায়।

সঞ্জীব দত্ত।

সে ভদ্রলোকের কত বয়েস হবে বলতে পারেন, স্যার?

বয়েস?

হ্যাঁ।

তা বয়েস—

মানে যা বলছিলাম—তিনি young না old?

এই ধরুন চব্বিশ-পঁচিশ!

সে তাহলে বলুন স্যার ইয়ংম্যান!

তাই হবে।

হুঁ, তা সে কোথায় চাকরি করে জানেন কিছু–মানে এখানে চারজন সঞ্জীব আছে কিনা–

চারজন।

হ্যাঁ।

এখানে কোন্ সঞ্জীব দত্ত পোর্ট কমিশনারে চাকরি করে?

তাই বলুন-সেই সঞ্জীব দত্ত নিউকামার আমাদের এখানে। তা যান না, এগিয়ে ডানহাতি দশ-বারোটা বাড়ির পরে একটা টিউবওয়েল দেখবেন, তার ওপাশেই খান-দুই বাড়ির পরে রতন মিস্ত্রীর একটা ঘর নিয়ে থাকে।

ছোকরা মিথ্যা বলেনি। সেই মতই পাওয়া গেল সঞ্জীব দত্তর সন্ধান।

পর পর কয়েকটি ঘর। অন্ধকার আর ধোঁয়ায় ঝাপসা অস্পষ্ট। দু-একটা ঘরে তখন সবে আলো জ্বলেছে। সব ঘরে আলো জ্বলেনি। সামনের দিকেই একটা ঘর নিয়ে সঞ্জীব থাকে।

নাম ধরে ডাকতেই সঞ্জীব বের হয়ে এল।

কে?

আপনিই সঞ্জীববাবু? কিরীটী শুধায়।

সঞ্জীব বলে, হ্যাঁ, আপনি কে? আপনাকে তো চিনতে পারলাম না!

আমাকে আপনি তো চিনবেন না। একটু ভিতরে আসতে পারি?

আসুন।

ছোট অপরিসর একখানা ঘর। একটা উজ্জ্বল হ্যারিকেন বাতি জ্বলছিল ঘরের মধ্যে, তারই আলোয় ঘরটা বেশ উজ্জ্বল! একটা তক্তাপোশ, গোটা-দুই টুল, একটা সুটকেস, একটা সরাই, কাপ ডিশ ও জলের গ্লাস।

বসুন।

সঞ্জীব দত্ত ওদের ঐ চৌকির ওপরেই বসতে বলে।

কিরীটীর ইতিমধ্যে নজরে পড়েছিল ঘরের কোণে দুজোড়া জুতো। একজোড়া চপ্পল সু ও একজোড়া কালো কাদা-মাখা কেডস। কিরীটী না বসে সেই জুতোর দিকে তাকিয়ে ছিল।

বসুন!

হ্যাঁ, বসি। কিরীটী বলে, আসুন পরিচয় করিয়ে দিই–

সঞ্জীববাবু-অবনীকে দেখিয়ে কিরীটী বলে, এই ভদ্রলোকও আপনার সঙ্গে আলাপ করতে এসেছেন। ইনি বেলেঘাটা থানার ও. সি.।

থানার ও, সি!

একটা ঢোঁক গিলে কোনমতে যেন শুষ্কপ্রায় গলায় কথাটা উচ্চারণ করল সঞ্জীব দত্ত।

কিরীটী তখনও তাকিয়ে সঞ্জীবের দিকে। বয়েস কিরীটীর অনুমানে ভুল হয়নি।

চব্বিশ-পঁচিশের মধ্যেই হবে। বেশ সবল বলিষ্ঠ চেহারা। মাথায় পরিপটি করে আঁচড়ানো চুল। নাকটা একটু ভোতা, কিন্তু দু চোখের দৃষ্টির মধ্যে একটা বুদ্ধির দীপ্তি। দৃঢ়বদ্ধ ওষ্ঠ।

সরু চিবুক। দাড়িগোঁফ নিখুতভাবে কামানো। পরনে একটা পায়জামা ও শার্ট।

কিন্তু আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না মশাই! আমার কাছে আপনাদের কি দরকার। থাকতে পারে।

আছে বৈকি। কিরীটী বলে।

কি দরকার?

মিত্ৰাণী বলে কাউকে আপনি চেনেন?

মিত্ৰাণী।

হুঁ।

কিন্তু কেন বলুন তো?

ভ্রু কুঁচকে তাকায় সঞ্জীব ওদের মুখের দিকে।

জিজ্ঞাসা করছি, জবাব দিন। এবারে অবনী বলেন।

তা চিনব না কেন—

অনেক দিনের পরিচয় আপনাদের? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।

হ্যাঁ।

আপনারা পরস্পর পরস্পরকে ভালবাসেন?

এককালে বাসতাম।

মানে?

মানে বাসতাম-সেটা অতীতে—এখন আর বাসি না।

কেন?

সেটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। ক্ষমা করবেন।

একটা কথা বোধ হয় আপনি জানেন না সঞ্জীববাবু! কিরীটী বলে।

কি কথা বলুন তো?

মিত্ৰাণীর দিদি শকুন্তলা দেবী দিন-কুড়ি আগেকার এক ঝড়জলের রাত্রে নিহত হয়েছেন।

সে কি?

হ্যাঁ, গলা টিপে শ্বাসরোধ করে তাকে হত্যা করা হয়েছে এবং সম্ভবতঃ যে সময় দুর্ঘটনাট ঘটে তার কিছু আগে পরে সে-রাত্রে আপনি মিত্ৰাণী দেবীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন যখন-তখন–

ননসেন্স। কি সব যা-তা বলছেন?

যা বলছি তার এক বর্ণও মিথ্যা নয়।

সম্পূর্ণ মিথ্যা।

না। শুনুন সঞ্জীববাবু, প্রমাণ আমার হাতে আছে- আপনি সে-রাত্রে সেখানে গিয়েছিলেন এবং প্রমাণও আছে আমার–

প্রমাণ!

হ্যাঁ।

কি প্রমাণ?

ঐ-ঐ যে ঘরের কোণে আপনার কাদা-মাখা জুতোজোড়া, ঐ তার সাক্ষী দিচ্ছে। আর শুধু তাই নয়, যার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন আপনি সেই রাত্রে—সেই মিত্ৰাণী তার জবানবন্দিতে বলেছেন

কি-কি বললেন? মিত্ৰাণী বলেছে?

হ্যাঁ।

সে বলেছে তার সঙ্গে আমি দেখা করতে গিয়েছিলাম সে-রাত্রে?

হ্যাঁ। অতএব বুঝতেই পারছেন, আর অশ্বীকার করবার চেষ্টা করে কোন লাভ নেই!

বলতে বলতে এবারে কিরীটী পকেট থেকে সেই সিগারেটের টুকরোটা বের করল।

আর এই যে সিগারেটের টুকরো, এটাও মিত্ৰাণীর ধরেই পরের দিন পাওয়া গিয়েছে। আমি ঘরে ঢুকেই লক্ষ্য করেছি, খাটের ওপরে আপনার ঐ সিগারেটের প্যাকেটটা-চর্মিনার সিগারেট—এটাও তাই, বলুন—এখনও বলবেন সে-রাত্রে আপনি সেখানে যাননি?

উপায় ছিল না আর অস্বীকার করবার।

সঞ্জীবকে-যাকে বলে কোণঠাস—তাই করেছিল কিরীটী।

সঞ্জীব যেন চুপসে যায়। সেই উদ্ধত প্রতিরোধ ঝিমিয়ে এসেছে তখন।

ধীরকণ্ঠে বলে, হ্যাঁ—মানে আমি গিয়েছিলাম—

কেন?

শুনবেন কেন?

হ্যাঁ।

তাকে-তাকে হত্যা করতে-সেই বিশ্বাসঘাতিনী—

সঞ্জীববাবু-আপনি একটা মহা ভুল করতে উদ্যত হয়েছিলেন—

কি বললেন?

তাই—এবং সে ভুল করলে সারাটা জীবন আপনি হয়ত অনুতাপ করতেন!

তাই বুঝি?

হ্যাঁ, কারণ মিত্ৰাণী সত্যিই আপনাকে ভালবাসেন।

হো হো করে হেসে ওঠে সীব। বলে, কি বললেন—ভালবাসে?

হ্যাঁ।

মিত্ৰাণী আমাকে ভালবাসে?

হ্যাঁ।

না—আপনি জানেন না মশাইও সাক্ষাৎ কালসাপিনী—

না—সে আপনাকে সত্যিই ভালবাসে।

বিশ্বাস করি না।

বিশ্বাস করুন আমার কথা।

হঠাৎ যেন অতঃপর সঞ্জীব দত্ত কেমন স্তব্ধ হয়ে গেল।

এখন বলুন, ঠিক কটার সময় আপনি সেরাত্রে সেখানে গিয়েছিলেন সঞ্জীববাবু?

রাত তখন—

কত? সম্ভবত দেড়টা দুটো হবে-প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে তখন—

কিরীটী এবারে বলে, ঐ রাত্রে—ঐ প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি মাথায় করে অতটা পথ নিশ্চয়ই পায়ে হেঁটেই গিয়েছিলেন, কারণ ঐ সময় যানবাহন পাওয়া কঠিন–

পায়ে হেঁটেই গিয়েছিলাম। সঞ্জীব দত্ত বলে।

তাই তো জিজ্ঞাসা করছি সঞ্জীববাবু, কি এমন জরুরী প্রয়োজন হয়েছিল যে অত রাত্রে ঐ দুর্যোগের মধ্যেও আপনাকে অতটা পথ যেতে হয়েছিল!

মিথ্যা বলব না মিঃ রায় আপনাকে–দিনের বেলা সবার চোখের উপর দিয়ে মিত্ৰাণীর সঙ্গে গিয়ে দেখা করা আমার পক্ষে সম্ভবপর ছিল না।

কেন?

কারণ আমাদের পরস্পরের ভালবাসাটা কেউ ওর আত্মীয়স্বজন ক্ষমার চোখে দেখেনি। মালদহে আমরা পাশাপাশি বাড়িতে থাকা সত্ত্বেও গোপনে এবং সর্বদা রাত্রির অন্ধকারেই পরস্পর আমরা পরস্পরের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করতাম। তাছাড়া ঐ সুশান্ত চ্যাটার্জি-মিত্ৰাণীর জামাইবাবু লোকটার সঙ্গে যদিও আমার সাক্ষাৎ পরিচয় কোনদিনও হয়নি—হবার সুযোগও হয়নি, শুনেছিলাম ভীষণ নাকি রাগী প্রকৃতির–সাহস হয়নি তাই দিনের বেলা সেখানে যেতে।

এখানে আপনি কতদিন এসেছেন?

তা প্রায় মাস চারেক হবে। আমার এক মামা আমার পোর্ট কমিশনারের চাকরিটা যোগাড় করে দেওয়ায় এসেছি।

এই চার মাসের মধ্যে কবার আপনাদের পরস্পরের মধ্যে সাক্ষাৎ হয়েছে?

তা দশ-বারো বার তো হবেই-বেশীও হতে পারে।

প্রত্যেক বারই বোধ হয় রাত্রে?

হ্যাঁ। মিত্ৰাণীর জামাইবাবুর রাত্রে নাইটডিউটি পড়লে সে চিঠি দিয়ে আমায় জানাত-আমি যেতাম।

১৯. কিরীটী মৃদু হেসে বলে

কিরীটী মৃদু হেসে বলে, তাহলে পাকা ব্যবস্থা করেই যেতেন?

হ্যাঁ। কিন্তু আপনি একটু আগে যা বললেন তা কি সত্যি?

কি? মিত্ৰাণী সত্যি সত্যি আপনাকে ভালবাসে কিনা?

হ্যাঁ।

হ্যাঁ সঞ্জীববাবু, আমি যা বলছি সত্যি। কিন্তু এখনও তো বললেন না, কেন সেদিন ঐ ঝড়জলের রাত্রে অত দূরে গিয়েছিলেন?

একটা শেষ বোঝাপড়া করবার জন্যে। বোঝাপড়া?

হ্যাঁ।

কিসের?

সে—

বলুন? থামলেন কেন?

কিছুতেই সে বিবাহের ব্যাপারে মত দিচ্ছিল না। কেবলই বলছিল, এখন নয় পরে–আর তাতেই আমার মনে সন্দেহ জাগে প্রথম। তারপর–

বলুন?

তারপর একদিন রাত্রে তার সঙ্গে পূর্ব ব্যবস্থা না করেই দেখা করতে যাই হঠাৎ, কিন্তু–

কী?

রাত তখন বোধ হয় সাড়ে বারোটা হবে, ভেবেছিলাম ওর ঘরের দরজায় টোকা দিয়ে ওর ঘুম ভাঙাব, কিন্তু তা আর করতে হল না-দেখলাম জেগেই আছে সে-তার ভগ্নীপতি আর সে–

কি–কি বললেন?

হঠাৎ যেন কিরীটী সজাগ হয়ে ওঠে-সোজা হয়ে বসে।

হ্যাঁ, সে আর তার ভগ্নীপতি ঐ সুশান্ত চ্যাটার্জি ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে-গায়ে গা ঘেঁষে হেসে হেসে আলাপ করছে।

কিন্তু সেটা শালী-ভগ্নীপতির রহসালাপও হতে পারে।

মশাই না, রহস্যালাপ নয়—ও প্রেমালাপ–হলপ করে বলতে পারি প্রেমালাপ—

আপনি তাদের কোন কথা শুনেছেন?

না, দরকার মনে করিনি। ঘৃণায় ছুটে সেখান থেকে চলে এসেছি—আর তাই সেরাত্রে গিয়েছিলাম–

ঐ ব্যাপারটা কবে ঘটেছিল?

সেই ঝড়জলের রাত্রের দিন-চারেক আগের এক রাত্রে। তাই তো এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না। আপনি বলা সত্ত্বেও বিশ্বাস করতে পারছি না, কোথায় যেন একটা সন্দেহের কাটা খচখচ করছে–

প্রেমের ব্যাপারে অতি সামান্য কারণেই মনে সন্দেহ জাগে সঞ্জীববাবু-মন তখন বড় দুর্বল হয়ে পড়ে–

আমি দুর্বল নই কিরীটীবাবু—

কিরীটী হাসল, ব্যতিক্রম হবে না যে তা নয়, কিন্তু যাক সে কথা—দেখুন তো, এই খামের হাতের লেখাটা চিনতে পারেন কিনা?

কিরীটী পকেট থেকে বের করে মিত্ৰাণীর চিঠিটা সঞ্জীবের সামনে ধরল।—চিনতে পারছেন?

হ্যাঁ-মিতার–

রাখুন এটা আপনার কাছে-পরে পড়ে দেখবেন-কেমন? আচ্ছা সঞ্জীববাবু, আমরা এবারে উঠব–

কিরীটী উঠে দাঁড়ায়।

যাবেন?

হ্যাঁ-রাত হল। আপনি যেভাবে অকপটে সব জানিয়ে আমাদের সাহায্য করলেন তার জন্য ধন্যবাদ। চলি। নমস্কার।

নমস্কার।

কিরীটী ও অবনী বের হয়ে এল।

রাত প্রায় সোয়া দশটা তখন।

অবনী গাড়িতে উঠতে উঠতে শুধান, বাড়িতে যাবেন তো?

না।

তবে কোথায়?

সুশান্তবাবুর কোয়াটারে যেতে হবে একটিবার—

এখন! মানে এই রাত্রে–

হ্যাঁ-এখুনি একবার থানায় চলুন। তারপর সেখান থেকে সোজা সুশাবাবুর কোয়ার্টারে–

কিছু প্রয়োজন আছে নাকি সুশাবাবুর ওখানে?

আছে। চলুন দেরি করবেন না আর। যেতে যেতে সব বলব।

.

রাত সাড়ে দশটার একটু পরেই ওরা বেলেঘাটা পৌঁছে গেল। আগে-পিছে দুটো জীপ।

কিছুক্ষণ আগে থাকতে বেশ বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। বৃষ্টির জন্য ঐ সময় ঐ জায়গাটা প্রায় নির্জন হয়ে গিয়েছিল। কোয়াটারের কাছাকাছি আসবার আগেই কিরীটী অবনীকে বললে, গাড়ির হেডলাইট নিভিয়ে দিন অবনীবাবু।

অবনী সুইচ অফ করে দিলেন।

ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। গাঢ় অন্ধকার-সামনে পিছনে ডাইনে বাঁয়ে কিছু দেখা যায় না।

গাড়ি এখানেই থামান-হেঁটে যাব। কিরীটী বলে।

কিন্তু বৃষ্টি যে জোরে পড়ছে! অবনী বলেন।

পড়ুক।

কিরীটী বলতে বলতে নেমে পড়ল, আসুন।

অন্ধকারে কিরীটী এগিয়ে যায়-অবনী তাকে অনুসরণ করেন। কোয়ার্টারে পৌঁছতে পৌঁছতেই ওরা বেশ ভিজে যায়।

মিত্ৰাণীর ঘরে আলো জ্বলছিল। আর সব ঘর অন্ধকার। জানালা খোলা। সেই জানালাপথেই কিরীটীর ঘরের মধ্যে নজরে পড়ে। মিত্ৰাণী ও সুশান্ত মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। মিত্ৰাণী মাথা নিচু করে আছে, সুশান্ত তাকে যেন কি বলছে। ওরা জানালার সামনে একেবারে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল।

সুশান্ত বলছে, তোমার আপত্তিটা কিসের? আমি কোন কথা শুনতে চাই না তোমার, তোমাকে বলতেই হবে–

মিত্ৰাণী বলে, আপনাকে তো আমি বলেছিই জামাইবাবু—এ হতে পারে না।

পারে না-পারে না—সেই এক কথা, বাট হোয়াই?

সুশান্তর কণ্ঠস্বর রীতিমত অসহিষ্ণু।

মিত্ৰাণী মাথা নিচু করে থাকে। কোন জবাব নেই তার মুখে।

হুঁ, তাহলে আমার ধারণাটা মিথ্যা নয়।

মিত্ৰাণী সুশান্তর দিকে মুখ তুলে তাকাল।

সুশান্ত পূর্ববৎ অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলতে থাকে, মিঃ রায় এখন দেখছি ঠিক সন্দেহই করেছেন, সে-রাত্রে কেউ তোমার ঘরে এসেছিল! কে এসেছিল বল?

সঞ্জীব দত্ত।

কে?

বললাম তো-সঞ্জীব।

মানে সেই ছেলেটা-সেই মালদহের বখাটে ছেলেটা? সে তাহলে এখন পর্যন্তও ধাওয়া করেছে! ছিঃ ছিঃ, এই তোমার চরিত্র মিত্রাণী? এত ছোট প্রবৃত্তি তোমার? একটা বেকার লোফার–

জামাইবাবু!

সহসা মিত্ৰাণীর কণ্ঠস্বর যেন তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। চোখের দৃষ্টি প্রখর হয়ে ওঠে।শুনুন, বেকার ও নয়, লোফারও সে নয়।

তাই বুঝি?

হ্যাঁ।

প্রেমে একেবারে তাই হাবুড়ুবু খাচ্ছো! ঠিক আছে, তাহলে কাল সকালেই সেই নাগরের কাছে চলে যেও। এখানে আর তোমার স্থান নেই।

কাল সকালে কেন এখনি আমি চলে যাব।

তাই যাও। ইতর, বাজারের মেয়েমানুষ—

কি বললেন?

মিত্ৰাণী অকস্মাৎ ঘুরে দাঁড়ায় গ্রীবা বেঁকিয়ে।

যা তুমি তা-ই বলছি, একটা বাজারের মেয়েমানুষ—

তবু জানবেন আপনার মত হীন প্রবৃত্তি আমার নয়—

মুখ সামলে কথা বল মিত্ৰাণী!

কেন? একজন স্ত্রী-হত্যাকারীকে ভয় করতে হবে নাকি?

কি-কি বললি?

অকস্মাৎ যেন ঝাপিয়ে পড়ল সুশান্ত মিত্ৰাণীর ওপর হিংস্র একটা জন্তুর মত অন্ধ আক্রোশে।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি জানি-আমি স্বচক্ষে দেখেছি—

কিন্তু মিত্ৰাণীর বক্তব্য শেষ হয় না, সুশান্ত তার গলাটা দু-হাতে সজোরে চেপে ধরায় তার কথাগুলো গলার মধ্যে আটকে যায়।

কিরীটী সঙ্গে সঙ্গে দরজায় ধাক্কা দিয়ে ডাকে, সুশান্তবাবু, মিঃ চ্যাটার্জী! দরজাটা খুলুন।

কে?

২০. কিরীটীর গলার স্বরে

কিরীটীর গলার স্বরে ও দরজার গায়ে ধাক্কার শব্দে সুশান্তর দুটো হাত সঙ্গে সঙ্গে মিত্ৰাণীর গলার উপর থেকে শিথিল হয়ে যায়।

মিত্ৰাণীও নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়।

বৈদ্যুতিক শক খেলে যেমন মানুষ হঠাৎ স্তব্ধ অনড় হয়ে যায়, সুশান্তও বুঝি তেমনি অসাড় নিস্পন্দ হয়ে গিয়েছিল কিরীটীর কণ্ঠস্বরটা কানে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই।

সুশান্তবাবু দরজা খুলুন—আমি অবনী সাহা, থানার ও. সি.! অবনী সাহা ঘন ঘন দরজার গায়ে ধাক্কা দিয়ে চলেন। সুশান্তবাবু—মিঃ চ্যাটার্জী? মিত্ৰাণীই দরজাটা খুলে দেয়। কিরীটী ও অবনী সাহা ঘরে প্রবেশ করেন। সুশান্ত তখনও যেন প্রস্তর-মূর্তির মত ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে।

শুনুন মিত্ৰাণী দেবী–সুশান্তবাবু-কিরীটী বলে ওদের লক্ষ্য করে, কেউ আপনারা আর পালাবার চেষ্টা করবেন না। অবনীবাবু প্রস্তুত হয়েই এসেছেন। বাড়ি আপনাদের পুলিসে ঘেরাও করে আছে।

সুশান্ত ও মিত্ৰাণী নির্বাক।

সুশান্তবাবু, অবনীবাবু এসেছেন আপনাকে গ্রেপ্তার করতে আপনার স্ত্রীকে শ্বাসরোধ করে। হত্যার অপরাধে–

না, না, আমি—আমি হত্যা করিনি, কুন্তকে হত্যা করেছে ঐ–ঐ নীচ চরিত্রের মেয়েলোকটা-সুশান্ত চিৎকার করে ওঠে।

না—কঠিন কণ্ঠে অবনী সাহা বলেন-হত্যা করেছেন আপনি। মিত্ৰাণীকে বিবাহ করবার জন্য আপনি প্যাশানে অন্ধ হয়ে নিজের রুগ্ন স্ত্রীকে হত্যা করেছেন সেরাত্রে গলা টিপে শ্বাসরোধ করে–

না, না, অবনীবাবু

হ্যাঁ-কিরীটী বলে, হ্যাঁ এবং হত্যা করবার জন্যই সে-রাত্রে আপনি রেস্টিং রুম থেকে এখানে এসেছিলেন—এসে নিঃশব্দে হত্যা করে যখন বের হয়ে যান মিত্ৰাণী দেবী আপনাকে দেখতে পান।

মিথ্যে কথা।

মিথ্যে কথা নয়—আরও প্রমাণ আমার আছে-আপনি স্ত্রীকে হত্যা করবার জন্যই সেরাত্রে এসেছিলেন। তারপর নিঃশব্দে হত্যা করে ব্যাপারটাকে একটা সুইসাইড প্রমাণ করবার জন্য আপনার বাবার ঘরে যান মালিশের শিশিটা আনতে–

প্রমাণ আছে কিছু তার?

আছে। মালিশের ঔষধের শিশির গায়ে আপনার ফিঙ্গারপ্রিন্ট আছে। তারপর আপনার কাদা-মাখা জুতো। আপনার বাড়ির সামনের রাস্তায় কোন কাদা নেই-কিন্তু সে-রাত্রে বৃষ্টির দরুন আপনার বাড়ির পিছনের বাগানে কাদা হয়েছিল, সেই কাদা আপনার জুতোয় লেগে যায়। স্ত্রীকে গলা টিপে হত্যা করবেন বলেই সে-রাত্রে সামনের রাস্তা দিয়ে না এসে গোপনে পিছনের রাস্তা দিয়ে এসেছিলেন।

হ্যাঁ, আমি এসেছিলাম—কিন্তু স্ত্রীকে হত্যা করতে নয়। তাকে আমি হত্যা করিনি। ঐ স্বৈরিণীর একটা চিঠি আমার হাতে পড়ে-ও আমার অনুপস্থিতিতে ওর নাগরকে ডাকে বলে ওদের হাতেনাতে ধরতে এসেছিলাম সে-রাত্রে।

মৃদু হেসে কিরীটী বলে, কিন্তু জানতেন না যে মিত্ৰাণী আপনাকে ভালবাসে না—সে মনে মনে অন্যকে ভালবাসে!

হ্যাঁ, জানতাম না—আমি সত্যিই জানতাম না।

জানলে হয়ত এত বড় ভুলটা আপনাকে করতে হত না! কিরীটী বলে।

ভুল!

নয়? নিজের স্ত্রীকে হত্যা করে বসলেন—প্যাশানে অন্ধ হয়ে—

করিনি-আমি করিনি-সুশান্ত বলে।

করেছেন-ইউ-ইউ-আপনি-আপনিই আপনার স্ত্রীকে হত্যা করেছেন।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঐ–ঐ ইতরটাই করেছে!

সুকার কণ্ঠস্বরে অকস্মাৎ সকলে ফিরে তাকাল।

দরজার ওপরে হাঁপানী রোগী বৃদ্ধ সুকান্ত-সুশান্তর বাবা দাঁড়িয়ে।

আমি-আমি জেগে ছিলাম তখন। ও মালিশের শিশিটা নিয়ে যায়—ও যে সত্যিই এত ইতর, এত ছোট হয়ে গিয়েছে কল্পনাও করতে পারিনি!

বাবা?

আমি তোর বাবা নই, তোর মুখ দেখতেও আমার ঘৃণা হয়।

কিন্তু কথাটা শেষ করতে পারে না সুকান্ত-হঠাৎ একটা প্রচণ্ড কাশি ওঠে।

কাশতে কাশতে পড়ে যায় সুকান্ত।

সুশান্ত ছুটে এসে বাপের মাথাটা কোলে তুলে নেয়, বাবা, বিশ্বাস কর বাবা, বিশ্বাস কর, আমি কুন্তকে হত্যা করতে এসেছিলাম সত্যি কিন্তু আমার হাতের চাপে তার মৃত্যু হয়নি-তার আগেই সে হার্টফেল করেছিল—নিজে নিজের গলা টিপে আত্মহত্যা করতে গিয়ে–

সুকান্তর চোখের দৃষ্টি স্থির হয়ে যায়।

সুশান্ত ডাক ছেড়ে কেঁদে ওঠে।

.

সুশান্তকে অ্যারেস্ট করে জীপে তুলে দেন অবনী।

অন্য আর একটা জীপে অবনী আর কিরীটী ফিরছিল।

অবনী বলেন, সুশান্ত যা বলেছে তা কি সত্যি কিরীটীবাবু?

মনে হয় তাই-তবে—

কি তবে?

তবে এও ঠিক, সুশান্তই তার স্ত্রীর গলা টিপে সে-রাত্রে ধরেছিল এবং শ্বাসরোধেই তার মৃত্যু হয়েছে-হাটফেল করে নয়।

কিন্তু–

ভয় নেই অবনীবাবু, পাপ আর গরল কখনও চাপা থাকে না। একদিন সুশান্তকে স্বীকার করতেই হবে-ও পাপ সে স্বীকার করবেই-আজ হোক বা কাল হোক।

Exit mobile version