হ্যাঁ, একজন ভোলা ঝি আছে। ইদানীং কিছুদিন হল আমাদের পুরনো ঝি ছুটি নিয়ে মাস-দুয়েকের জন্য দেশে গিয়েছে, নতুন বি ওসব করতে চায় না।
আচ্ছা মিত্ৰাণী দেবী, আজ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অবনীবাবু ও সুশান্তবাবু ছাড়া আর কোন তৃতীয় ব্যক্তি এখানে এসেছিলেন?
কই না!
ভালো করে মনে করে দেখুন?
এবারে জবাব দিল সুশান্ত, কে আসবে এখানে মিঃ রায়? সকাল থেকে যা দুর্যোগ চলেছে-তাছাড়া আমার বাড়িতে কেউ এলেও এ ঘরে কেন আসবে?
কিন্তু আসতেও তো পারে মিঃ চ্যাটার্জি! শান্ত কণ্ঠে একটা পাইপ পকেট থেকে বের করে সেটায় তামাক ভরতে ভরতে বলে কিরীটী।
কি বলছেন আপনি?
ঠিকই বলছি মিঃ চ্যাটার্জি। আজ সারাদিন যদি কেউ না এসে থাকেনও, পরশু বিকেল থেকে রাতের মধ্যে অর্থাৎ ঐ বারো ঘণ্টার মধ্যে আপনার কোয়ার্টারের এই ঘরে কেউ যে এসেছিল সে সম্পর্কে আমি নিঃসন্দেহ।
কিন্তু।
শুনুন মিঃ চ্যাটার্জি, আপনি হয়ত জানেন না, কিন্তু মিত্ৰাণী দেবী নিশ্চয়ই জানেন-তাই ওঁকেই তো কথাটা জিজ্ঞাসা করছি। কি মিত্ৰাণী দেবী, আসেননি কেউ?
শান্ত ধীর কণ্ঠে জবাব দেয় মিত্ৰাণী, না।
ঠিক বলছেন?
হ্যাঁ।
কেউ আসেননি তাহলে?
না।
কিরীটী ক্ষণকাল নিস্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল মিত্ৰাণীর দিকে। মনে হল ঈষৎ বাঁকা ঠোঁটের কোণে যেন একটা চাপা হাসির বিদ্যুৎ খেলছে।
তারপর ধীরে ধীরে আবার তাকাল সুশান্তর দিকে।
সুশান্তবাবু!
কিছু বলছেন?
হ্যাঁ। আজ শনিবার—আপনি তো বৃহস্পতিবার অর্থাৎ পরশু সকালেই ডিউটিতে বের হয়ে যান?
হাঁ।
বেলা তখন কটা হবে?
সকাল পৌনে নটা।
আপনার ডিউটি ছিল কটা থেকে?
দশটা থেকে।
ফিরেছেন আপনি আজ সকালে?
হ্যাঁ। কখন ডিউটি শেষ হল?
ডিউটি অবিশ্যি আমার সন্ধ্যাতেই শেষ হবার কথা, কিন্তু ট্রেনের লেটের জন্য ফিরেছি আমি রাত প্রায় আড়াইটায়–
তখন বাড়ি আসেননি?
না। কেন?
রেস্টিং রুমেই শুয়েছিলাম আমি, আর—আর একজন টি. টি. আই., অত রাত্রে আর বাড়ি আসতে ইচ্ছা করল না বলে। তাছাড়া–
তাছাড়া? বাড়িতে এলেই তো সেই অশান্তি। তাই—
তাই যতটা সম্ভব বাড়ি এড়িয়ে চলতেন?
তাই।
কিরীটী আর কোন কথা বলল না।
এগিয়ে গিয়ে দক্ষিণ দিকের যে দরজাটা বন্ধ ছিল ভিতর থেকে, সেটা খুলে বাইরে পা বাড়াল।
ছোট একফালি জমি। সীমানায় কাঁটাতারের বেড়া। তার ওদিকে সরু একটা রাস্ত। তারও ওদিকে রেলওয়ে ইয়ার্ড। কিছু ফুলের গাছ আছে। অরক্ষিত।
শুধু একটা টগর গাছে রাশি রাশি সাদা ফুল ফুটে আছে।
হঠাৎ নজরে পড়ল কিরীটীর, গতরাত্রে প্রচণ্ড বৃষ্টি হয়ে জমি নরম হয়ে গিয়েছিল, এখানে ওখানে কিছু জল জমে আছে আর নরম কাদা তখনও।
নরম কাদায় এলোমেলো কিছু জুতোর ছাপ রয়েছে। কিরীটী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জুতোর ছাপগুলো পরীক্ষা করে দেখল। এক ধরনের জুতোর ছাপ নয়, দুরকমের জুতোর ছাপ পড়েছে।
তার মধ্যে একটা হালকা, অন্যটা যেন ভারী, চেপে বসেছে। একটা কিছু অস্পষ্ট, অন্যটা বেশ স্পষ্ট।
একটা মনে হয় চামড়ার সোলের, অন্যটা মনে হয় রবার সোলের কেডস্ জাতীয় কোন জুতোর ছাপ যেন।
কিরীটী ফিরে এল আবার ঘরে।
চলুন অবনীবাবু।
সকলে বের হয়ে এল অতঃপর ঘর থেকে।
বারান্দা দিয়ে যেতে যেতে কয়েক জোড়া জুতোর উপরে নজর পড়ল কিরীটীর।
চার-পাঁচটা জেন্টস, লেডিস, ও বাচ্চার জুতো, তার মধ্যে একজোড়া ব্রাউন রঙের ভারী সোলের জুতোও রয়েছে।
মুহূর্তের জন্য থামল কিরীটী।
ভাল করে নজরে করে দেখল ভারী ব্রাউন জুতোজোড়া। জুতোর সোলে তখনও কাদা শুকিয়ে আছে। মিঃ চ্যাটার্জি।
বলুন?
ঐ ব্রাউন ভারী সোলের জুতোজোড়া নিশ্চয়ই আপনার?
হ্যাঁ।
পরশু ডিউটিতে কোন্ জুতো পরে গিয়েছিলেন? ঐ জুতোজাড়াই বোধ হয়?
হ্যাঁ।
বুঝতে পেরেছিলাম! চলুন অবনীবাবু।
কিছু বলছেন?
না। ভাল কথা, পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা কখন পাওয়া যাবে?
কাল পেতে পারি বিকেল নাগাদ। অবনী জবাব দেন।
রিপোর্ট পেলে একবার আমার ওখানে আসবেন?
নিশ্চয়ই।
চলুন রাত হল, এবারে ফেরা যাক।
কিরীটীর কথায় যেন মনে হল অবনী সাহা একটু অসন্তুষ্ট হয়েছেন কিন্তু মুখে সেটা প্রকাশ করেন না।
কিরীটীর সঙ্গে সঙ্গে কোয়ার্টার থেকে বের হয়ে আসেন।
অবনীর জীপেই ফিরছিল ওরা। অবনী জীপ চালাচ্ছিলেন, কিরীটী পাশে বসেছিল। রাত মন্দ হয়নি তখন—প্রায় পৌনে নটা। তাহলেও কলকাতা তখন রীতিমত প্রাণচঞ্চল। আলোকিত, শব্দ-মুখরিত, যানবাহন ও মানুষের ভিড়ে চঞ্চল শব্দময়ী কলকাতা।
অবনী সাহা মৃদুকণ্ঠে ডাকেন, কিরীটীবাবু!
উঁ?
কী মনে হল আপনার?
০৫. অবনী সাহা উৎসুক দৃষ্টিতে
অবনী সাহা উৎসুক দৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করেন।
কিসের?
মানে বলছিলাম ঐ সুশান্ত চ্যাটার্জি আর মিত্ৰাণীকে—
একটা কথাই ওদের সম্পর্কে মনে হচ্ছে আপাততঃ—
কী?
ভাবছি, দুজনেই যেন মনে হল মিথ্যা কথা বলল।
মিথ্যা কথা!
হুঁ। সুশান্ত ও মিত্ৰাণী দেবী মনে হচ্ছে দুজনেই মিথ্যা বলছে!
কি মিথ্যা বলেছে?
প্রথমতঃ আমার মনে হচ্ছে, কাল রাত্রে—মানে ভোর হবার অনেক আগেই সুশান্ত কোন একসময় বাড়ি ফিরেছিল।
আপনার তাই মনে হয়? হ্যাঁ, তাই। তারপর আবার ফিরে গিয়ে ভোরনাগাদ কোয়ার্টারে ফিরে এসেছে আজ।
কিন্তু–
ভাবছেন সে বলেছে যে রাত আড়াইটের ডিউটি থেকে ফিরে অশান্তির ভয়ে ভোররাত পর্যন্ত স্টেশনের রেস্টিং রুমে ছিল! তা কিন্তু নয় বলেই আমার মনে হয়, যদিও তার অ্যালিবিটা খুব স্ট্রং।