মোমবাতি!
হ্যাঁ, দাঁড়ান, মোমবাতিটা জ্বেলে দিই।
অন্ধকারেই এগিয়ে গেল সুশান্ত এবং অনায়াসেই পাশ থেকে দেশালাইটা নিয়ে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে দিল।
নরম স্নিগ্ধ মোমের আলোয় ঘরটা মৃদুভাবে আলোকিত হয়ে উঠল ধীরে ধীরে।
কিরীটী চেয়ে দেখল, একটা বড় সাইজের মোমবাতি—প্রায় অর্ধেকেরও বেশী পুড়ে গিয়েছে।
একটা কাঠের চেস্ট-ড্রয়ারের উপর একটা ভাঙা কাঁচের প্লেটের উপরে মোমবাতিটা বসানো।
মাঝারি আকারের ঘরটা।
দুটি দরজা। একটি দরজা বন্ধ। বোধ হয় পাশের ঘরের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে। অন্যটি দিয়ে তারা একটু পূর্বে ভিতরে প্রবেশ করেছে।
তিনটি জানালা। দুটি দক্ষিণ দিকে, বন্ধ। অন্যটি পশ্চিম দিকে অন্দরমুখী।
সব কটি জানালাই বন্ধ ছিল। আসবাবপত্র ঘরে সামান্যই।
একটা শূন্য খাট, তার পাশে একটা গোলাকার টেবিল, তার উপরে কিছু ঔষধপত্রের শিশি, হরলিকসের বোতল, একটা জলের গ্লাস ও কাপ তখনও রয়েছে দেখা গেল।
পশ্চিম দিকে দেওয়াল ঘেঁষে একটা আলমারি—প্রমাণ সাইজের আয়না বসানো। তার পাশে একটা আলনায় কিছু শাড়ি ঝুলছে।
দেওয়ালের গায়ে একটা ক্যাম্প খাট ফোল্ড করা রয়েছে। একটি চেয়ার ও একটি টুল।
এ ঘরে কি একা শকুন্তলা দেবীই থাকতেন? কিরীটী প্রশ্ন করে।
না, আমিও থাকতাম। ঐ ক্যাম্প খাটটা পেতে আমিও এই ঘরেই শুতাম যখন বাড়িতে থাকতাম। জবাব দেয় সুশান্ত।
আর আপনার ছেলে রাহুল?
সে তার মাসীমণির কাছেই এখানে আসা অবধি শোয়।
মানে মিত্ৰাণী দেবীর সঙ্গে?
হ্যাঁ। আপনার ছেলে বাড়িতে নেই?
আছে। সকাল থেকে ওর জ্বর।
জ্বর!
হ্যাঁ, খুব জ্বর। মাঝে মাঝে ভুল বকছে।
ডাক্তার আসেননি?
হ্যাঁ। সুরেন ডাক্তার এসেছিল। ঔষধ দিয়ে গিয়েছে।
কিরীটী এবার বলে, চলুন, একবার পাশের ঘরটা দেখব যে ঘরে মিত্ৰাণী দেবী থাকেন। চলুন। সুশান্ত বলে।
০৪. পাশের ঘরটি
পাশের ঘরটিও ঠিক বলতে গেলে একই সাইজের।
একটি খাটের উপর রাহুল চোখ বুজে শুয়ে মধ্যে মধ্যে জ্বরের ঘোরে বিড়বিড় করে ভুল বকছে।
কিরীটী শয্যায় শায়িত ছেলেটির দিকে তাকাল। ছেলেটি ভারী রুগ্ন। তার বাপের ফর্সা রং পায়নি। কালো। শয্যার একপাশে মিত্ৰাণী বসেছিল চুপচাপ। ওদের ঘরে ঢুকতে দেখে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ায়।
কিরীটী তাড়াতাড়ি বলে, না না, আপনাকে উঠতে হবে না, আপনি বসুন।
মিত্ৰাণী কিন্তু বসে না, দাঁড়িয়েই থাকে। কিরীটী চেয়ে দেখে মিত্ৰাণীর দিকে।
অবনীবাবু ঠিকই বর্ণনা দিয়েছিলেন মেয়েটির চেহারার।
রোগা, পাতলা এবং কালোর উপরে ভারি চমৎকার দেখতে। চোখে-মুখে যেন একটা অপূর্ব শ্রী।
মুহূর্তের জন্য চোখাচোখি হয় কিরীটীর সঙ্গে।
মিত্ৰাণী সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি ভূমিতলে নিবদ্ধ করে। কিন্তু সেই মুহূর্তের চাউনিতেই বুঝতে কষ্ট হয় না কিরীটীর, তীক্ষ্ণ বুদ্ধির দীপ্তি যেন চোখের মণি দুটো থেকে উঁকি দিচ্ছে মেয়েটির।
পরনে মলিন একটা রঙিন জলড়ুরে শাড়ি। বগল-কাটা ব্লাউস গায়ে। হাতে একগাছা করে সোনার রুলি। আর দেহের কোথাও কোন গহনা নেই।
মাথার চুল রুক্ষ, কিন্তু পর্যাপ্ত চুল মাথায়।
ঘরে আসবাবপত্রের মধ্যে একটি বড় সাইজের খাট, একটি দেরাজ এবং দেরাজের পাশেই একটি দরজা।
এ ঘরে তিনটি দরজা।
একটা দিয়ে তারা ঘরে এসেছে, একটা দুই ঘরের মধ্যবর্তী। সেটা এদিক থেকে বন্ধ। অন্যটা দক্ষিণ দেওয়ালে দেরাজের পাশে, সেটাও বন্ধ ছিল।
অন্য দিকের দেওয়ালে একটা আলনা ও ছোট একটা ড্রেসিং টেবিল।
কিরীটী দক্ষিণের দরজাটার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, ঐ দরজাটা?
সুশান্ত বলে, ওটা হচ্ছে এ বাড়ির পিছনে যাবার। ওদিকে একটা ছোট বাগান মত আছে।
দরজাটা ব্যবহার হয় তাহলে বলুন?
সুশান্ত বলে, তা হয় বোধ হয় মধ্যে মধ্যে।
কে ব্যবহার করেন, আপনি?
না, আমি ওদিকে বড় একটা যাই না।
কিরীটী এবারে ঘুরে তাকাল মিত্ৰাণীর দিকে, আপনি?
আমি?
হ্যাঁ, আপনি ব্যবহার করেন ঐ দরজা?
তা মধ্যে মধ্যে করি।
কথা বলতে বলতেই হঠাৎ কিরীটী নীচু হয়ে খাটের নীচে থেকে একটা সিগারেটের টুকরোর শেষাংশ কুড়িয়ে গেল।
মিঃ চ্যাটার্জি।
বলুন?
আপনি তো সিগারেট খান, কি ব্র্যাণ্ড খান?
আমি-আমি তো স্মোক করি না!
করেন না?
না।
কখনও মধ্যে-সধ্যেও না?
না। তবে এককালে ছিল, এখন আর—
ড্রিংক করেন?
মধ্যে মধ্যে করি।
একটু যেন ইতস্তত করেই কথাটা বলেন সুশান্ত চ্যাটার্জি।
ঐসময় বিড়বিড় করে রাহুল বলে ওঠে, মাসীমণি, বড় অন্ধকার-আলোটা জ্বালো না। তারপরই চেচিয়ে ওঠে কেমন যেন ভয়ার্ত কণ্ঠে, কে-কে-কে ওখানে মাসীমণি? কে?
মিত্ৰাণী তাড়াতাড়ি ঝুঁকে পড়ে রাহুলের সামনে, কই, কেউ তো নয় বাবা, কেউ নয়, তুমি ঘুমাও।
রাহুল আবার শান্ত হয়ে যায়।
কিরীটী এগিয়ে গিয়ে রাহুলের কপাল স্পর্শ করে, জুরে যেন একেবারে পুড়ে যাচ্ছে ছেলেটার গা। খুব কম হলেও একশো চার ডিগ্রীর নীচে নয়।
মিত্ৰাণী দেবী!
কিরীটীর ডাকে মিত্ৰাণী চোখ তুলে তাকাল ওর দিকে।
রাহুলের গায়ের চাদরটা ঠিক করে দিচ্ছিল মিত্ৰাণী।
এ ঘরটা ঝাঁট দেওয়া হয়নি কদিন?
অ্যাঁ! কি বললেন?
এ ঘরটা ঝট দেওয়া হয়নি কদিন?
পরশুও তো ঝাট দিয়েছি। আজ অবিশ্যি দেওয়া হয়নি এখনো পর্যন্ত।
তাহলে পরশুও ঝাট দিয়েছেন!
হ্যাঁ, বিকেলে।
আপনিই দেন বোধ হয়?
হ্যাঁ, আমিই দিই।
কেন, ঝি নেই?