মিত্ৰাণী মৃদু মৃদু হেসেছে।
গায়ে মাখেনি কোন তিরষ্কার মিত্ৰাণী তবু।
দুধ এনে বলেছে, খেয়ে নাও দিদি দুধটা।
আগে ঐ বিড়ালকে একটু দে ঐ দুধ থেকে, তারপর খাব। কই, দে!
ভয় নেই তোমার, এতে বিষ নেই।
যা বলছি তাই শোন।
শেষ পর্যন্ত বিড়ালকে দুধ খাওয়াবার পর তবে সেই দুধ খেয়েছে শকুন্তলা।
কখনও আবার জিজ্ঞাসা করেছে, কাল সারারাত ধরে অত ফুসুরফুসুর কার সঙ্গে করছিলি?
কার সঙ্গে আবার করব? মিত্ৰাণী বলেছে।
ঢাকবার চেষ্টা করিস না মিতা, তোর জামাইবাবুর সঙ্গে আমি জানি সারারাত কথা বলেছিস!
জামাইবাবুর তো কাল নাইট-ডিউটি ছিল।
দেখ, মিথ্যা বলিস না। আমি জানি ও কাল ডিউটিতেই যায়নি।
মিত্ৰাণী আর কি বলবে, চুপ করে থেকেছে।
চুপ না করে থাকা ছাড়া আর উপায়ই বা কি!
তারপর? কিরীটী শুধায়।
অবনী বলল, এ ধরনের টচারের একটা সীমা আছে। তাই আমার মনে হয়—হয়ত ঐ সুশান্ত, শকুন্তলার স্বামী, শেষ পর্যন্ত ডেসপারেট হয়ে–
নিজের স্ত্রীকে বিষ দিয়ে হত্যা করেছে।
অসম্ভব কি কিছু?
না, তা নয়। তবে—
কি?
অবনী কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল।
আচ্ছা এখন সুশান্তবাবুর ওখানে গেলে তার সঙ্গে দেখা হতে পারে?
পারে। কারণ আমি তাকে দুদিন বাড়িতেই সর্বক্ষণ থাকতে বলে এসেছি।
তবে চলুন না একবার সুশান্তবাবুর ওখান থেকে ঘুরে আসা যাক।
বেশ তো চলুন।
০৩. সুশান্ত চ্যাটার্জি গৃহেই ছিল
সুশান্ত চ্যাটার্জি গৃহেই ছিল।
পর পর সব এক সাইজের এক প্যাটার্নের কোয়ার্টার। ১৮নং কোয়াটারই সুশান্ত চ্যাটার্জির। বাইরে থেকে কোন আলো দেখা যায় না। অন্ধকার।
ওরা গাড়ি থেকে নেমে নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে গেট ঠেলে দুজনে বারান্দার দিকে অগ্রসর হতেই অন্ধকারে আবছা দুটো ছায়ামূর্তি পাশাপাশি চেয়ারের উপর বসে আছে চোখে পড়ল এবং একজন তার মধ্যে সঙ্গে সঙ্গে বোধ হয় ওদের গেট দিয়ে ঢুকতে দেখে উঠে দাঁড়াল।
ঐ সঙ্গে অস্পষ্ট নারীকণ্ঠে শোনা গেল, জামাইবাবু, কারা যেন আসছে—
পুরুষকণ্ঠে প্রশ্ন আসে, কে?
জবাব দেয় অবনী সাহা, সুশান্তবাবু আমি অবনী সাহা, থানার ওসি।
সঙ্গে সঙ্গে বারান্দার ইলেকট্রিক আলো জ্বলে উঠল।
কিরীটীর নজরে পড়ল, সামনেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে বত্রিশ-তেত্রিশ বৎসরের এক যুবক।
যুবকের চেহারাটি সত্যিই সুন্দর। রোগা পাতলা চেহারা। গাত্রবর্ণ রীতিমত গৌর। মাথায়। কোঁকড়া কোঁকড়া চুল। মুখখানি একটু লম্বাটে ধরনের। চোখ দুটো ভাসা-ভাসা। দেখলেই মনে হয় যেন সরল গোবেচারা গোছের মানুষ।
সমস্ত মুখখানি যেন কেমন বিষণ্ণ, ক্লান্ত। পরনে পায়জামা ও পাঞ্জাবি। পায়ে রবারের চপ্পল।
আসুন অবনীবাবু, বসুন।
সুশান্ত চ্যাটার্জি আহ্বান জানায়।
আজ ডিউটিতে তাহলে যাননি?
না। আপনিই তো বারণ করে গিয়েছেন। সাত দিনের ছুটি নিয়েছি।
খুব ভাল করেছেন। মনের এ অবস্থায় ডিউটি ভাল করে করতেও পারতেন না।
ডিউটি গত দেড় মাস থেকেই তো ভাল ভাবে করতে পারিনি! কেন? প্রশ্ন করেন অবনী।
কেন আর? শকুন্তলার জন্য।
ও সত্যিই ইদানীং জীবনটা আমার একেবারে যেন দুর্বিষহ করে তুলেছিল। কী জানেন অবনীবাবু, যদিও এটা ক্রুয়েল তবু অকপটে বলছি, ও যদি নিজে থেকেই বিষ খেয়ে সুইসাইড না করত-শেষ পর্যন্ত একদিন আমিই ওর গলা টিপে হত্যা করে ফাঁসি যেতাম!
ছি ছি, কী বলছেন মিঃ চ্যাটার্জি?
কথাটা এতটুকু মিথ্যা নয়। ও যে ইদানীং কী ভাবে অত্যাচার করত আমাদের ওপর-অথচ সমস্ত ব্যাপারটা বেসলেস একেবারে, সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। সবই তো সকালে আপনাকে বলেছি মিঃ সাহা।
হ্যাঁ, বলেছেন বটে।
বসুন না, দাঁড়িয়ে রইলেন কেন?
অবনী ও কিরীটী দুজনে দুটো চেয়ার টেনে বসে।
একটু বসুন, মিতাকে দু কাপ চায়ের কথা বলে আসি।
বাধা দিল কিরীটী, না না, মিঃ চ্যাটার্জি, বসুন, তার কোন প্রয়োজন নেই। এইমাত্র চা খেয়ে আসছি। বসুন আপনি।
ওঁকে তো চিনতে পারছি না, মিঃ সাহা?
অবনী মিথ্যা কথা বললেন, আমাদেরই একজন লোক, মিঃ রায়।
ও।
উনি আপনাদের কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে চান। অবনী বলেন।
কী কথা?
কিরীটীই এবারে জবাব দিল, এমন বিশেষ কিছু না। সে হবেখন। তার আগে শকুলা দেবী যে ঘরে ছিলেন সেই ঘরটা একবার দেখতে চাই মিঃ চ্যাটার্জি।
বেশ তো, চলুন।
.
রেলওয়ে কোয়ার্টার যেমন হয়।
সামনে ছোট একটি বারান্দা, তারপরই পূর্ব-মুখে একটা বড় সাইজের ঘর, লাগোয়া একটা বারান্দা। ও ছোট্ট একটা স্টোর-রুম।
বারান্দার একদিকে রান্নাঘর, অন্যদিকে পাশাপাশি দুটো ঘর, তার মধ্যে একটা ঘরের দরজায় তালা দেওয়া ছিল।
অন্য ঘরটার দরজা খোলা, ভিতরে আলো জ্বলছিল। ঘরের দরজায় পর্দা ঝুলছে, ভিতরটা নজরে পড়ে না। অবনী বললেন, তালা-দেওয়া ঐ ঘরটাতেই শকুন্তলা দেবী ছিলেন।
তালা দিল কে? কিরীটী শুধায়।
আমিই যাবার সময় তালা দিয়ে গিয়েছিলাম আজ সকালে।
অবনী পকেট থেকে চাবি বের করে ঘরের তালাটা খুলে দিলেন। তিনজনে অতঃপর ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে।
ঘরটা অন্ধকার।
আলোটা জ্বালুন, অবনীবাবু।
সুশান্তই সুইচ টিপে ঘরের আলোটা জ্বালাবার চেষ্টা করল কিন্তু আলো জ্বলল না, খুট করে একটা শব্দ হল মাত্র।
সুশান্ত বললে, ঘরের বাটা বোধ হয় ফিউজ হয়ে গিয়েছে!
কাল এ ঘরে আলো জ্বলেনি? কিরীটী ঐসময় শুধায়।
না। সুশান্ত বলে।
কেন?
ইলেকট্রিক আলো ইদানীং কুন্ত চোখে সহ্য করতে পারত না বলে ঘরে একটা মোমবাতি জ্বালানো থাকত।