অবনী এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল ওদের কথাবার্তা। একটি কথাও বলেনি। মিত্ৰাণী চলে যেতে সে কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে ডাকে, মিঃ রায়?
উঁ।
আপনি জানলেন কি করে কথাটা—ঐ সিগারেটের টুকরোটা থেকেই?
না, বাগানে জুতোর ছাপ আর ঐ সিগারেট—দুই মিলে চার হয়েছে, তারপর এই চিঠি।তা তো হল! ব্যাপারটা যেন কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে এখন!
কেন?
মিত্ৰাণী যদি সঞ্জীবকেই ভালবাসত, তাহলে–
শুনলেন তো, সেটা সম্ভবত সুশান্তবাবু এখনও জানেন না!
তা অবিশ্যি—তাহলে অন্য পক্ষের সক্রিয় সহযোগিতা না থাকলে—
অবনীবাবু, রহস্যের জালটা সবে একটু সরেছে, এখনও অনেকটা ঝাপসা অস্পষ্ট—
কিরীটীর কথা শেষ হল না, সুশান্ত এসে সামনে দাঁড়াল।
আপনারা!
হুঁ, বসুন।
সুশান্ত বসল চেয়ারটায়। সুশান্ত চেয়ারে বসে কিরীটীর মুখের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায়।
তার মুখের দিকে তাকালে মনে হয় যেন সে একটু বিস্মিত হয়েছে। গত-রাত্রের অত্যধিক মদ্যপানের জন্য মাথাটা তখনও বেশ ভারী, চোখের পাতা থেকেও ঘুম একেবারে মুছে যায়নি।
কিরীটী মৃদু কণ্ঠে ডাকে, সুশাবাবু!
বলুন।
সঞ্জীব দত্ত বলে কাউকে চেনেন?
সঞ্জীব দত্ত।
হ্যাঁ, নামটা কখনও শুনেছেন?
না তো! কে সে?
নামটাও শোনেননি তাহলে? মিত্ৰাণীর মুখেও কখনও শোনেননি?
না। বুঝতে পারছি আপনি জানেন না, কিন্তু সেই ভদ্রলোক মধ্যে মধ্যে এখানে আসতেন। এখানে আসতেন মানে? আপনার কথা তো কিছু বুঝতে পারছি না!
এখানে আসতেন মানে মিত্ৰাণী দেবীর সঙ্গে দেখা করতে—
মিত্ৰাণীর সঙ্গে!
হ্যাঁ, আর সেই দুর্ঘটনার রাত্রেও সেই সঞ্জীব দত্তই মিত্ৰাণী দেবীর ঘরে এসেছিল।
সে কি! কেন?
কারণ সেই যুবক দীর্ঘদিন থেকে মিত্ৰাণীর সঙ্গে পরিচিত এবং ওদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতাও আছে।
না, না-মিথ্যা–
মিথ্যা নয় সুশান্তবাবু, নিষ্ঠুর নির্মম সত্য। কথাটা বলেই হঠাৎ উঠে দাঁড়াল কিরীটী। আচ্ছা আজ এবার আমরা উঠব। আর একটা কথা, অবনীবাবুকে না জানিয়ে কলকাতার বাইরে আপাততঃ কোথাও আপনি যাবেন না যেন।
যাব না?
না, তাতে কিন্তু আপনার বিপদ ঘটতে পারে!
তারপরই কিরীটী অবনী মিত্রের দিকে তাকিয়ে বলে, উঠুন অবনীবাবু–যাওয়া যাক।
সুশান্ত স্থাণুর মত চেয়ারটার ওপর বসে রইল। তার মাথার ঝিমঝিম ভাবটা তখন কেটে গিয়েছে। চোখের ঘুম-ঘুম ভাবটাও চোখ থেকে সম্পূর্ণ মুছে গিয়েছে।
মিত্ৰাণী—তার কাছে সঞ্জীব দত্ত মধ্যে মধ্যে আসত! তারা অনেক দিনের পরস্পরের পরিচিত! মিত্ৰাণী-সঞ্জীব দত্ত-মাথাটার মধ্যে যেন আগুন জ্বলছে-সুশান্ত চেয়ারের হাতলটা শক্ত মুঠিতে চেপে ধরে। চোয়াল দৃঢ় হয়—মিত্ৰাণী-সঞ্জীব।
.
কিরীটী আর অবনী সুশান্তর কোয়ার্টার থেকে বের হয়ে এল।
বেলা তখন সাড়ে বারোটা। আকাশের মেঘ তখনও কাটেনি। কিন্তু বৃষ্টিও আর নামেনি। কেবল একটা ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা হাওয়া বইছিল। দুজনে জীপে উঠে বসে। অবনীই স্টীয়ারিং ধরেন। কিরীটী পাশে বসে একটা সিগারেট ধরায়।
অবনী সাহা জীপ চালাচ্ছিলেন।
মৃদু কণ্ঠে একসময় কিরীটী ডাকে, অবনীবাবু।
বলুন? অবনী সাড়া দিলেন।
আজ একবার বিকেলের দিকে এক জায়গায় চলুন—
কোথায়?
মানিকতলা খালের ওপারে—শ্রীমান সঞ্জীবচন্দ্রের দেখা যদি পাওয়া যায়।
কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না কিরীটীবাবু।
কি?
সঞ্জীব দত্তর শকুন্তলা দেবীকে হত্যা করবার কি এমন কারণ থাকতে পারে?
কার কোথায় কি ইন্টারেস্ট থাকতে পারে, তা এত সহজেই বলা যায় না মিঃ মিত্র! চলুন না—আলাপ করে দেখাই যাক ভদ্রলোকের সঙ্গে আগে একটিবার!
বেশ।
১৮. ঐদিন সন্ধ্যার কিছু আগে
ঐদিন সন্ধ্যার কিছু আগেই ওরা বের হয়ে পড়েছিল মানিকতলা খালপারের বস্তীর উদ্দেশ্যে।
বস্তীটা যেমন ঘিঞ্জি তেমনি বহু বিচিত্র লোকের বাস সেখানে। প্রায় দু-ঘণ্টা খোঁজবার পর এক ছোরার কাছে সঞ্জীব দত্তর সন্ধানটা পাওয়া গেল।
মাস্তান গোছের একটি বছর আঠারো-উনিশ বয়সের ছেলে। নাম জানা গেল সুবিমল। ‘স’ ‘স’ করে ছেলেটি কথা বলে। পরনে একটা ড্রেন-পাইপ প্যান্ট, গায়ে রংচঙে একটা হাওয়াই শার্ট। পায়ে চপ্পল। মাথার চুল সিনেমার অ্যাক্টরের ধরনের ছাঁটা।
সে কি নাম বললেন, স্যার? সুবিমল শুধায়।
সঞ্জীব দত্ত।
সে ভদ্রলোকের কত বয়েস হবে বলতে পারেন, স্যার?
বয়েস?
হ্যাঁ।
তা বয়েস—
মানে যা বলছিলাম—তিনি young না old?
এই ধরুন চব্বিশ-পঁচিশ!
সে তাহলে বলুন স্যার ইয়ংম্যান!
তাই হবে।
হুঁ, তা সে কোথায় চাকরি করে জানেন কিছু–মানে এখানে চারজন সঞ্জীব আছে কিনা–
চারজন।
হ্যাঁ।
এখানে কোন্ সঞ্জীব দত্ত পোর্ট কমিশনারে চাকরি করে?
তাই বলুন-সেই সঞ্জীব দত্ত নিউকামার আমাদের এখানে। তা যান না, এগিয়ে ডানহাতি দশ-বারোটা বাড়ির পরে একটা টিউবওয়েল দেখবেন, তার ওপাশেই খান-দুই বাড়ির পরে রতন মিস্ত্রীর একটা ঘর নিয়ে থাকে।
ছোকরা মিথ্যা বলেনি। সেই মতই পাওয়া গেল সঞ্জীব দত্তর সন্ধান।
পর পর কয়েকটি ঘর। অন্ধকার আর ধোঁয়ায় ঝাপসা অস্পষ্ট। দু-একটা ঘরে তখন সবে আলো জ্বলেছে। সব ঘরে আলো জ্বলেনি। সামনের দিকেই একটা ঘর নিয়ে সঞ্জীব থাকে।
নাম ধরে ডাকতেই সঞ্জীব বের হয়ে এল।
কে?
আপনিই সঞ্জীববাবু? কিরীটী শুধায়।
সঞ্জীব বলে, হ্যাঁ, আপনি কে? আপনাকে তো চিনতে পারলাম না!
আমাকে আপনি তো চিনবেন না। একটু ভিতরে আসতে পারি?