কলিং বেল টিপতেই একটু পরে দরজাটা খুলে গেল।
সামনে দাঁড়িয়ে মিত্ৰাণী। তার চোখে-মুখে যেন রাত্রি-জাগরণের একটা বিষণ্ণ ক্লান্তি। মিত্ৰাণী ওদের ঐ সময় দেখে যেন একটু অবাকই হয়।
কিরীটীই প্রশ্ন করে, সুশান্তবাবু বাড়িতে আছেন?
হ্যাঁ।
কি করছেন তিনি?
ওরা ভিতরে গিয়ে ঢুকল।
দুজনে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে দুটো চেয়ার অধিকার করে বসে।
কি করছেন তিনি?
কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।
ঘুমোচ্ছেন বোধ হয়।
এখনও ঘুমোচ্ছন?
কিরীটীর প্রশ্নে মিত্ৰাণী মাথাটা নীচু করে। কোন জবাব দেয় না।
রাত্রে ডিউটি ছিল বুঝি মিঃ চ্যাটার্জির? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।
না।
তবে এমনি বেলা পর্যন্তই ঘুমোন নাকি উনি?
সে প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে মিত্ৰাণী বলে, আমি ডেকে দিচ্ছি তাকে।
মিত্রাণী ভিতরের দিকে পা বাড়ায়। কিরীটী সঙ্গে সঙ্গে বাধা দেয়। বলে, শুনুন শুনুন, ব্যস্ত হবেন না, একটু পরে তাকে ডাকলেও চলবে।
মিত্ৰাণী তাকায় কিরীটীর মুখের দিকে।
বসুন, আপনার সঙ্গে কিছু কথা আছে।
মিত্ৰাণী কিরীটীর মুখের দিকে তখনও তাকিয়ে আছে।
বসুন!
মিত্ৰাণী কিন্তু বসে না। দাঁড়িয়েই থাকে।
রাহুল কোথায়?
স্কুলে গেছে।
আর ভয় পায়নি তো?
ভয়!
হ্যাঁ, আমার মনে হয় কোন কারণে ভয় পেয়েই বোধ হয় ওর হঠাৎ সেদিন জ্বর হয়েছিল।
ভয় কেন পাবে?
পেতেও তো পারে। যেমন ধরুন আচমকা কাউকে জানালার ধারে অন্ধকারে দেখে হঠাৎ ঘুম ভেঙে–
মিত্ৰাণী কিরীটীর মুখের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে আছে তখনও।
যাক সে কথা। সেদিন আপনি আমাদের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, দুর্ঘটনার দিন রাত্রে তৃতীয় কোন ব্যক্তি আপনার শোবার ঘরে আসেনি!
হ্যাঁ।
কিন্তু, যদি বলি আপনি deliberately-ইচ্ছা করেই মিথ্যা কথা বলেছেন?
মিথ্যা!
হ্যাঁ, মিথ্যা—আপনি মিথ্যা বলেছেন।
আমি–
শুনুন মিত্ৰাণী দেবী, আমি জানি সে-রাত্রে কেউ আপনার ঘরে এসেছিল; আবার আমি জিজ্ঞাসা করছি-এখনও বলুন, কে তৃতীয় ব্যক্তি সে-রাত্রে আপনার ঘরে এসেছিল?
কিরীটীর কণ্ঠস্বর কঠিন তীক্ষ্ণ, চোখের দৃষ্টি যেন অন্তস্তল ভেদ করে যাচ্ছে।
কিরীটীর কণ্ঠস্বর—বিশেষ করে অন্তর্ভেদী কিরীটীর চোখের সেই দৃষ্টি সহসা মিত্ৰাণীকে যেন কেমন বিবশ করে দেয়।
বলুন, কে এসেছিল?
মিত্ৰাণী যেন পাথর।
সঞ্জীব দত্ত এসেছিল, তাই না?
না, না–
জানেন—একটু থেমে কিরীটী বলে, শুনুন মিত্ৰাণী দেবী, সত্যকে আপনি চাপা দিয়ে রাখতে পারবেন না, প্রকাশ তা পাবেই। সূর্যের আলোকে চাপা দেওয়া যায় না, এখনও বলুন—এখনও স্বীকার করুন সে রাত্রে কে আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল?
মিত্ৰাণী যেন পাথর হয়ে গিয়েছে। কোন সাড়া নেই, কোন শব্দ নেই তার মুখে। ওষ্ঠে এতটুকু কুঞ্চনও নেই। দু-চোখে ভাষাহীন বোবা দৃষ্টি।
এখনও বলুন মিত্ৰাণী দেবী, কে এসেছিল আপনার ঘরে সে-রাত্রে? এখন না বললেও জানবেন—আজ হোক কাল হোক সব বলতে আপনাকে হবেই। কিরীটী বলতে থাকে, স্বীকার আপনাকে করতেই হবে, নচেৎ অবনীবাবু আপনাকে আপনার বোন শকুন্তলা দেবীর হত্যাপরাধে গ্রেপ্তার করবেন।
হত্যাপরাধে।
হ্যাঁ, শকুন্তলা দেবী যে সে-রাত্রে বিষ খেয়ে অত্মহত্যা করেননি, সে-কথা আপনি জানেন।
আমি বিশ্বাস করি না সে-কথা।
বিশ্বাস না করলেও তাই সত্য বলে জানবেন। তিনি আত্মহত্যা করেননি। তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা-খুন করা হয়েছে।
না, না–
হ্যাঁ, তাকে হত্যা করা হয়েছে-নিষ্ঠুর, নৃশংস হত্যা। এখনও বলুন, সে-রাত্রে আপনার জামাইবাবু ছাড়াও তৃতীয় ব্যক্তি কে আপনার ঘরে এসেছিল? বলুন?
কিরীটীর কণ্ঠস্বর, তার চোখের ধারালো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মিত্ৰাণীকে যেন কেমন বিবশ করে দেয়।
১৭. কিরীটীর মুখে উচ্চারিত শেষের কথাগুলো
বিশেষ করে কিরীটীর মুখে উচ্চারিত শেষের কথাগুলো মিত্ৰাণীকে যেন সত্যিই পাথর করে দেয়, সে তার প্রতিরোধক্ষমতা হারায়।
কিরীটী চেয়ে আছে তখনও মিত্ৰাণীর দিকে।
সে-রাত্রে কেউ তাহলে আপনার ঘরে এসেছিল।
মৃদু-অত্যন্ত মৃদু কণ্ঠে এবার জবাব দেয় মিত্ৰাণী। সে বলে, হ্যাঁ।
কে? কে সে?
সঞ্জীব।
সে তাহলে আপনার বিশেষ পরিচিত?
হ্যাঁ। মালদহে আমরা পাশাপাশি বাড়িতে থাকতাম।
তার সঙ্গে আপনার তাহলে বলুন অনেক দিনের পরিচয়! কিরীটী পুনরায় শুধায়।
হ্যাঁ।
কত দিনের পরিচয়?
আট-নয় বছর হবে।
কি করে সে?
জানি না, কলকাতা পোর্ট কমিশনারে যেন কিছুদিন হল কি একটা চাকরি পেয়েছে।
এখানে কোথায় থাকে?
মানিকতলায় থাকে, তবে কোথায় তা ঠিক জানি না।
জানেন আপনি, মিথ্যা বলছেন। বলুন তার ঠিকানা কি?
সে একটা বস্তী শুনেছি-খালের ওপারে।
হুঁ। তা অত রাত্রে কেন এসেছিল সঞ্জীব দত্ত? আপনার সঙ্গে দেখা করতে নিশ্চয়ই?
হ্যাঁ।
এর আগে কখনও এসেছে?
হ্যাঁ।
নিশ্চয়ই সব সময় রাত্রেই সে এসেছে?
হ্যাঁ।
দিনের বেলা এলে পাছে জানাজানি হয়ে যায় বলে বোধ হয়?
হ্যাঁ। সুশান্তবাবু বা তার স্ত্রী নিশ্চয়ই জানতেন ব্যাপারটা?
না।
সে-রাত্রে বোধ হয় ঘর অন্ধকার করে সঞ্জীবকে ঘরে এনেছিলেন?
হ্যাঁ।
তাই–তাই রাহুল মধ্যে মধ্যে অন্ধকারে সঞ্জীববাবুকে দেখত বলেই বোধ হয় ভয় পেয়েছে। ঠিক আছে আপনি যান, সুশান্তবাবুকে একবার পাঠিয়ে দিন।
মিত্ৰাণী উঠে দাঁড়াল।
শিথিল ক্লান্ত পায়ে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বের হয়ে গেল মিত্ৰাণী।