হ্যাঁ।
আপনি ঠিক কি বলতে চান বুঝতে পারছি না।
যদি ধর তোমাকে আমি বিয়ে করি—
ছি!
পরিপূর্ণ একটা ঘৃণায় যেন কথাটা উচ্চারিত হল মিত্ৰাণীর কণ্ঠ হতে।
ছি কেন? আমার বয়স বেশী বলে একটু?
না।
তবে?
তা সম্ভব নয়।
তাই তো জিজ্ঞাসা করছি, কেন সম্ভব নয়? বাধাটা কোথায়? কিসেরই বা বাধা আমাদের বিয়েতে?
আমি যাচ্ছি। যাবার জন্যই বোধ হয় মিত্ৰাণী ঘুরে দাঁড়ায়–পা বাড়ায়।
সুশান্ত তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে।
দুপা এগিয়ে এসে বলে, দাঁড়াও-শোন মিতা–
না, বললাম তো না!
সুশান্ত হঠাৎ হাত বাড়িয়ে মিত্ৰাণীর একটি হাত চেপে ধরে। বলে, বল–কেন না, মিতা?
আঃ ছাড়ুন, কি করছেন!
পাশের ঘর থেকে ঐ সময় সুশান্তর বাপ সুকান্তর কাশির শব্দ শোনা গেল।
হঠাৎ সুকান্ত কাশতে সুরু করেছে।
সুশান্ত চাপা কণ্ঠে মিত্ৰাণীর হাতটা আরও দৃঢ় মুষ্টিতে চেপে ধরে বলে, না, বলতেই হবে তোমাকে, বল-বল–
সুশান্ত যেন ক্ষেপে গিয়েছে। ভরভর করে সুশান্তর মুখ থেকে মদের গন্ধ বের হচ্ছে।
কেঁপে ওঠে মিত্ৰাণী যেন। এক ঝটকা দিয়ে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নেয় মিত্ৰাণী এবং সুশান্ত কিছু বুঝবার আগেই ছুটে গিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে মিত্ৰাণী ঘরের দরজাটা বন্ধ করে ভিতর থেকে খিল তুলে দেয়। সে তখনও রীতিমত হাঁপাচ্ছে। বুকের ভিতরটা তখনও তার যেন থরথর করে কাঁপছে।
সুশান্ত বন্ধ দরজার গায়ে মৃদু ধাক্কা দিতে দিতে চাপা কণ্ঠে ডাকে, মিতা, মিতা!
দু-হাতে মুখ ঢেকে ফেলে মিত্ৰাণী। দু চোখের কোল ছাপিয়ে হুঁ হুঁ করে জল নেমে আসে। সুশান্তর ইদানীংকার চোখের দৃষ্টিটার তাৎপর্য যেন এক্ষণে স্পষ্ট হয়ে ওঠে মিত্ৰাণীর কাছে।
সুশান্তর মনে তাহলে এই ছিল? ছিঃ ছিঃ ছিঃ!
কুলাদি এইজন্যই তাহলে ইদানীং তার ওপরে এত বিরক্ত হয়ে উঠেছিল?
সে স্ত্রী হয়ে তার স্বামীর চোখের দৃষ্টিকে ভুল করেনি। আর স্বাভাবিক ভাবেই হয়তো সে ভেবে নিয়েছিল মিত্ৰাণীরও সায় আছে।
ছিঃ ছিঃ ছিঃ! ঘৃণায় লজ্জায় ও একটা অবিমিশ্র ধিক্কারে নিজেকে যেন মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে ইচ্ছে করে মিত্ৰাণীর। এর পর আর এক মুহূর্তও কি তার এখানে থাকা নিরাপদ বা যুক্তিসঙ্গত হবে?
১৬. লেটার-বকস্ থেকে
প্রিয়তোষই লেটার-বকস্ থেকে পরের দিন বিটের পিওনের সাহায্যে চিঠিটা সংগ্রহ করে এনেছিল।
অবনী চিঠিটা পেয়েই কিরীটীকে ফোনে সংবাদ দিয়েছিল।
একটা চিঠি পাওয়া গিয়েছে কিরীটীবাবু।
কিরীটী ঐসময় কৃষ্ণার সঙ্গে বসে দাবা খেলছিল।
মনটার মধ্যে তখনও দাবার ছকটা ও দাবার খুঁটিগুলোই ঘোরাফেরা করছিল।
বলে, চিঠি!
হ্যাঁ।
কার?
মিত্ৰাণীর।
মিত্ৰাণী চিঠি দিয়েছে নাকি!
না না–
তবে?
সে লিখেছিল একজনকে।
কাকে?
সঞ্জীব দত্তকে। আপনি আসুন একবার।
এতক্ষণে যেন কিরীটী তার নিজের মধ্যে ফিরে আসে। মনোযোগী হয়ে ওঠে। বলে, মিত্ৰাণী মানে সেই সুশান্ত চ্যাটার্জির শ্যালিকা?
হ্যাঁ।
আসছি আমি।
কিরীটী ফোনটা নামিয়ে রাখল।
আর দেরি না করে জামাটা কোনমতে গায়ে চড়িয়ে তখুনি সোজা থানায় চলে আসে। প্রিয়তোষ তখনও তার কথা ফলাও করে অবনীকে বলছিল। কিরীটীকে থানায় প্রবেশ করতে দেখে সে থেমে যায়।
এই যে আসুন-শেষ পর্যন্ত আপনার ফাঁদে পা দিয়েছেন দেবী—
হাসতে হাসতে অবনী বলে।
কই, দেখি কি চিঠি?
খোলা চিঠিটা কিরীটীর হাতে এগিয়ে দেয় অবনী মিত্র।
সযত্নে জলের সাহায্যে চিঠিটা খুলে ফেলেছিল অবনী মিত্র।
খাম থেকে চিঠিটা টেনে বের করে কিরীটী।
উপরে সঞ্জীব দত্তর নাম-ঠিকানা থাকলেও ভিতরে চিঠিতে কোন সম্বোধন নেই। এক সংক্ষিপ্ত চিঠি :
তোমার ব্যাপার কি সত্যিই বুঝতে পারছি না।
রাগ করেছ নাকি? নাকি খুব কাজে ব্যস্ত! কুড়ি-পঁচিশ দিনেরও বেশী হয়ে গেল একটিবার দেখা করবারও সময় পেলে না?
আমার বিপদটা কি তুমি বুঝতে পারছ না? সত্যি সর্বক্ষণ আমার বুকটা কাঁপছে ভয়ে আর দুশ্চিন্তায়। কি হবে বুঝতে পারছি না। দারোগাবাবু বোধ হয় কিছু সন্দেহ করেছেন।
আরও কি সেদিন বলে গেছেন জান? কুন্তদি নাকি বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেনি। তাকে হত্যা করা হয়েছে। তাছাড়া এখানে জামাইবাবুরও চোখের দৃষ্টি, কথাবার্তা ইদানীং যেন কেমন মনে হচ্ছে।
লক্ষ্মীটি, চিঠি পাওয়া মাত্রই তুমি এসে আমার সঙ্গে দেখা করবে।
দরজায় টোকা দিলেই দরজা খুলে দেব।
আমি জেগেই থাকব।
ইতি—তোমার মিতুয়া
কিরীটী বার-দুই চিঠিটা আগাগোড়া পড়ল। তারপর চিঠিটা ভাঁজ করতে করতে অবনী মিত্রের দিকে তাকাল।
চিঠিটা কোথায় পেয়েছেন?
প্রিয়তোষ এনেছে, তবে আর বলছি কি! ভাগ্যে আপনি বাড়িটার ওপর সর্বক্ষণ ওয়াচ রাখতে বলেছিলেন! অবনী মিত্র পরিতৃপ্তির হাসি হাসেন।
কোথায় পেলেন, প্রিয়তোষবাবু? কিরীটী প্রিয়তোষের মুখের দিকে তাকায়।
ওদের কোয়ার্টারের কাছে ঠিক রাস্তার মোড়ে যে লেটার-বক্সটা আছে, কাল একসময় মিত্ৰাণী দেবী এসে তার মধ্যে চিঠিটা ফেলে দেয়। আজ সকালে চিঠিটা পিওনের সাহায্যে হাতিয়েছি।
হুঁ! কিরীটী কি যেন ভাবছে।
কি ভাবছেন মিঃ রায়?
কিরীটী সে কথার জবাব না দিয়ে নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে, বেলা সোয়া আটটা-চলুন—উঠুন–
উঠব।
হ্যাঁ, চলুন একবার ঘুরে আসি।
কোথায়?
সুশান্ত চ্যাটার্জির কোয়ার্টারে।
যাবেন?
হ্যাঁ, চলুন।
.
ওরা আর দেরি করে না। অবনী মিত্রের জীপেই দুজনে বের হয়ে পড়ে। ওরা যখন সুশান্ত চ্যাটার্জির কোয়ার্টারের সামনে এসে জীপ থেকে নামল, নটা বাজতে তখনও মিনিট কুড়ি বাকি।