না না, আমি খাব না, আপনি জানেন না—
সেই জিদ আর আপত্তি।
কি জানি না? ডাক্তার শুধিয়েছেন।
আসুন না, একটু কাছে সরে আসুন বলছি—
শকুন্তলা তখন বলেছে।
কৌতূহলে সুরেন ডাক্তার একটু কাছে এসে শুধিয়েছেন, কি বলুন তো? সুবিধা—
সুবিধা!
কি বলছেন?
সুবিধা হবে যে ওদের—
কাদের? কাদের সুবিধা হবে? সুরেন ডাক্তার আবার শুধিয়েছেন।
কেন, আমার স্বামীর আর ঐ কালসাপিনীর।
কি বলছেন আপনি মিসেস চ্যাটার্জি?
ঠিকই বলছি। ঘুমের মধ্যে ওরা আমাকে শাসরুদ্ধ করে মেরে ফেলবে–
না না, তাই কি হয়!
হয়, হয়—আপনি জানেন না।
সুরেন ডাক্তার বলেছেন, আপনি আবোলতাবোল ভাবছেন।
আবোলতাবোল ভাবছি, তাই না? আপনি জানেন না ডাক্তারবাবু, ওরা সেই সুযোগের অপেক্ষায়ই তো আছে। আর সেইজন্যই তো আমি ঘুমোই না, সারা-রাতই জেগে থাকি-চোখ মেলে।
ছি, কি যে বলেন মিসেস চ্যাটার্জি আপনি! মিঃ চ্যাটার্জি আপনাকে কত ভালবাসেন
ভালবাসেন! হুঁ! দিন পল মুহূর্ত গুনছে-কখন কবে আমি শেষ হয়ে যাব, কবে ও মিতুকে বিয়ে করবে—
.
সত্যি, ঐ এক ধারণা হয়ে গিয়েছিল ইদানীং শকুলার।
সুশান্ত আর মিত্ৰাণী—ওরা যেন দিবারাত্র ঐ চিন্তাই করছে।
কবে মরবে রুগ্না শকুন্তলা, আর ওরা নিশ্চিন্ত হয়ে হাত ধরাধরি করে হাসতে হাসতে সাজগোজ করে রেজিস্ট্রী অফিসে গিয়ে বিয়ে করে আসবে!
কথাটা সুশাই বলেছিল তার জবানবন্দিতে যেদিন থেকে মনের মধ্যে শকুন্তলার ঐ ধারণাটা বাসা বেঁধেছে-মনের মধ্যে যেন একটা বিষের ধোয়া পাক খেয়ে খেয়ে ফিরেছে।
প্রথম প্রথম মুখভার করে থেকেছে, তারপর একটু-আধটু হাবভাবে প্রকাশ করতে শুরু করেছে এবং ইদানীং মাস-দেড়েক হবে স্পষ্টাস্পষ্টিই তো বলতে শুরু করেছিল।
সুশান্তকে বলেছে, ভাবো বুঝি না-? তোমাদের মনের কথাটা বুঝতে পারি না-না? রোগে জীর্ণ হয়ে পঙ্গু হয়ে পড়ে আছি একটা ঘরের মধ্যে, তোমরা কি কর না কর কিছু টের পাই না, চোখে দেখি না বলে কানেও শুনি না?
সুশান্ত প্রথম প্রথম জবাব দেয়নি।
মৃদু মৃদু হেসেছে কেবল। কখনও কখনও হয়ত কৌতুক করে বলেছে, টের পাও সব, না কুন্ত?
হ্যাঁ হ্যাঁ-সব-সব টের পাই। দিন গুনছে কবে এ আপদ মরবে, আর তোমরা নিশ্চিত হয়ে হাত-ধরাধরি করে রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে বিয়ে করে আসবে।
কী করে বুঝলে বল তো? পুনরায় কৌতুকভরে শুধিয়েছে সুশান্ত স্ত্রীকে।
ও বুঝতে হয় না, বুঝলে? তোমরা পুরুষগুলো এত হ্যাংলা, নিষ্ঠুর, এত স্বার্থপর, এত নির্লজ্জ যে একটা অন্ধেরও সেটা চোখে পড়ে–
কার কার চোখে পড়েছে বল তো?
সবার—পৃথিবীসুদ্ধ সবার চোখে পড়েছে।
বল কি! সবাই তাহলে জেনে ফেলেছে ব্যাপারটা?
হ্যাঁ। কিন্তু জেনো, তা আমি হতে দেবো না। তোমাদের ওই সুখের আশায় আমি ছাই দিয়ে দেবো।
বেশ, তাই দিও।
দেবোই তো। এই মরা কঙ্কালসার দেহ নিয়েই আমি বেঁচে থাকব। আমি যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন তো আর বিয়ে করতে পারবে না!
কেন পারব না? সুশান্ত কৌতুক করে বলেছে, যদি আমি ডিভোর্স করি তোমায় অসুস্থ পঙ্গু বলে?
তাহলে—তাহলে তোমাকে আমি ঠিক জেনো তার আগে ফাঁসিকাঠে চড়াবার ব্যবস্থা করে যাব। নতুন করে আবার তুমি ঘর বাঁধবে তা আমি হতে দেব না-না-
অবশেষে শকুন্তলার ঐ মনোবিকৃতিতে ক্লান্ত হয়ে বলেছিল একদিন সুশান্ত, আচ্ছা এ পোকা তোমার মাথার মধ্যে কেমন করে ঢুকল বল তো কুন্ত? মিত্ৰাণীকে আমি বিয়ে করব এ তুমি কেমন করে ভাবতে পারলে?
তুমিই তো ভাবিয়েছ?
আমি?
হ্যাঁ হ্যাঁ–তুমি। কিসের তোমাদের অত হাসাহাসি, কিসের অত ফুসুরফুসুর গুজুরগুজুর কথা সর্বক্ষণ!
কে বলেছে তোমায় ঐ কথা?
মিথ্যা–মিথ্যা বলতে চাও?
আচ্ছা তুমি কি সত্যি-সত্যিই পাগল হলে কুন্ত! সুশান্ত বলেছে।
পাগল? তাই হতে পারলেই বোধ হয় ভাল হত!
আচ্ছা তোমার কি ধারণা বল তো? দুটো কথা কারো সঙ্গে বললেই—
বুকে হাত দিয়ে বল তো, সে কেবলমাত্র কথাই, আর কিছু নয় তোমার?
সুশান্ত চুপ করে থেকেছে।
কী, চুপ করে রইলে কেন? বল, তোমাদের মনে সত্যিই কোন পাপ নেই?
বিশ্বাস কর, সত্যিই–
তোমার ছেলের মাথায় হাত দিয়ে বলতে পার, তোমাদের দুজনের পরস্পরের মধ্যে–
কুন্ত, তুমি সর্পে রঞ্জুম করছেঐ সাপই তোমায় একদিন দংশন করবে জেনো।
০২. অবনী সাহা বলছিল কিরীটীকে
ব্যাপারটা যদিও প্লেন ও সিম্পল সুইসাইড কেস বলেই সকলের ধারণা হয়েছে, তবু কেন যেন অবনী মনে মনে ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে গ্রহণ করতে পারেনি।
অথচ মনের কথাটা কাউকে খুলেও বলতে পারে না।
হঠাৎ মনে পড়েছিল থানায় বসে কেসটার ডাইরী লিখতে লিখতে কিরীটীর কথা।
সন্ধ্যাবেলা তাই সোজা চলে এসেছিল কিরীটীর ওখানে।
কিরীটী তার বসবার ঘরে নিত্যকার মত দাবার ছক সাজিয়ে নিয়ে কৃষ্ণার সঙ্গেই খেলছিল।
আগে আগে কৃষ্ণার ঐ দাবা খেলাটা আদৌ ভাল লাগত না, কিন্তু ইদানীং বোধ হয় দাবা খেলায় রস পেতে শুরু করেছিল সে।
কিরীটী ডাকলেই বসে পড়ত টুলটা টেনে।
কিরীটীর অবিশ্যি তাতে করে সুবিধাই হয়েছে।
সে বলে, যাক, দাবাটা তাহলে নেহাত তোমার কাছে এখন একেবারে নিরস ব্যাপার বলে মনে হয় না কৃষ্ণা?
না।
কিন্তু কি করে এই অঘটন সম্ভবপর হল বল তো?
কি করে আবার? সঙ্গদোষে?
কৃষ্ণা হাসতে হাসতে বলেছে।
যা বলেছ। সঙ্গদোষে সাধুও চোর হয়ে যায়।
তা যায়, আবার চোরও সাধু হয়।