মিত্ৰাণী ঘুরে দাঁড়াল নিঃশব্দে। সুশান্তর মুখের দিকে তাকাল মিত্ৰাণী।
তোমার ব্যাপারটা কি বল তো?
প্রশ্নটা করে সুশান্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় মিত্ৰাণীর দিকে।
মিত্ৰাণী চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। কোন কথা বলে না।
সুশান্ত আবার বলে আজ কদিন থেকেই দেখছি তুমি যেন আমার উপরে একটু বিরক্ত!
বিরক্ত হব কেন?
কেন হবে তা তুমিই জান। তবে দেখছি তাই-তুমি কি—
কি?
মিত্ৰাণী!
বলুন?
একটা কথার সত্যি জবাব দেবে?
কি?
সত্যি করে বল তো, কুন্তলার মৃত্যুর জন্য কি আমাকে তুমি সন্দেহ করছ?
কথাটা বলতে বলতে সুশান্ত উঠে দাঁড়ায়।
দু-পা এগিয়ে এসে মিত্ৰাণীর একেবারে মুখোমুখি দাঁড়ায়।
তুমি কি আমাকে সত্যিই সন্দেহ কর নাকি?
এসব কি বলছেন আপনি? ছি!
শোন মিতা, কারো মনে যদি আমাদের কোন সন্দেহ থাকে পরস্পরের প্রতি, সেটার স্পষ্টাস্পষ্টি একটি মীমাংসা হয়ে যাওয়াই ভাল নয় কি?
আমি যাই, ভাতটা ফুটে গিয়েছে
না, দাঁড়াও।
জামাইবাবু, এসব কথা থাক!
না, কথাটা যখন উঠেছে শেষ করতে হবে।
আমাকে যেতে দিন জামাইবাবু!
সুশান্ত ইতিমধ্যে পথরোধ করে দাঁড়িয়েছিল।
মিত্ৰাণী যাবার চেষ্টা করে বোধ হয় পাশ কাটিয়ে।
জামাইবাবু-জামাইবাবু—
হঠাৎ যেন ক্ষেপে ওঠে সুশান্ত, কে তোমার জামাইবাবু-আমি তোমার জামাইবাবু নই!
কি বলছেন আপনি?
ঠিকই বলছি। ভারি তো দূর-সম্পৰ্কীয় বোন—
মিত্ৰাণী যেন কেমন ব্যথিত দৃষ্টিতে তাকায় সুশান্তর মুখের দিকে।
তারপর মৃদুকণ্ঠে বলে, আপনি হয়ত জানেন না জামাইবাবু, কুত্তাদির সঙ্গে আমার তেমন কোন নিকটতম সম্পর্ক না থাকলেও আমার নিজের মায়ের পেটের বোনের চাইতেও বেশী ছিল সে।
তাই বুঝি!
হ্যাঁ, আপনি জানেন না, আমার নিজের কোন সহোদর বোন নেই, কিন্তু থাকলেও বোধ হয় সে কুত্তাদির চাইতে আপন হত না।
ব্যঙ্গভরে জবাব দেয় কটুকণ্ঠে সুশান্ত, তাই বুঝি বোনটি তোমাকে এত ভালবাসত।
কথাটায় কান দিল না বা দাঁড়াল না মিত্ৰাণী। ধীরে ধীরে পাশ কাটিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
সুশান্ত কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে মিত্ৰাণীর গমনপথের দিকে তাকিয়ে থাকে; তার মুখের ওপর একটা বিচিত্র কুটিল ছায়া যেন ভেসে ওঠে।
হাত বাড়িয়ে সুশান্ত চায়ের কাপটা তুলে নেয়। চায়ের কাপে চুমুক দেয়। কিন্তু অত্যন্ত বিস্বাদ যেন লাগে চা-টা সুশান্তর। গলা পর্যন্ত যেন তার তেতো হয়ে গিয়েছে।
ঠক করে চায়ের কাপটা পুনরায় টেবিলের উপর নামিয়ে রাখে।
পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ধরায়, কিন্তু মুখটা যেন আরও বেশী বিস্বাদ হয়ে যায় তাতে করে। সিগারেটটা জানালা-পথে বাইরে নিক্ষেপ করে।
অতঃপর ঐ ছোট্ট ঘরটার মধ্যেই পায়চারি করতে থাকে। পায়চারি করতে করতে হঠাৎ কি ভেবে পায়চারি থামিয়ে জামাটা আবার গায়ে দিয়ে নেয় সুশান্ত। জুতোর মধ্যে পা গলিয়ে বের হয়ে আসে ঘর থেকে।
রান্নাঘরের সামনেই মিত্ৰাণীর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। মিত্ৰাণী শুধায়, কোথায় যাচ্ছেন আবার এসময়?
চুলোয়! বলে সুশান্ত হনহন করে বাইরের দরজার দিকে এগিয়ে যায়।
মিত্ৰাণী বুঝি শেষ চেষ্টা করে বলে, সারাটা রাত ডিউটি করে এসেছেন। রান্না হয়ে গিয়েছিল, স্নান করে খেয়ে বেরুলেই পারতেন জামাইবাবু।
সুশান্ত ফিরে তাকাল মিত্ৰাণীর দিকে একবার। দু-চোখে তার অগ্নিবর্ষী দৃষ্টি।
১৪. অগ্নিবর্ষী দৃষ্টি দিয়ে
অগ্নিবর্ষী দৃষ্টি দিয়ে দু-চোখে যেন মিত্ৰাণীকে ঝলসে দিয়ে সুশান্ত মুখটা ঘুরিয়ে আবার দরজার দিকে এগিয়ে যায়।
জামাইবাবু? আবার ডাকল মিত্ৰাণী।
ঘুরে দাঁড়াল সুশান্ত, আমার নিমন্ত্রণ আছে বাইরে।
নিমন্ত্রণ!
হ্যাঁ, তুমি খেয়ে নিও। তাছাড়া রাত্রে হয়ত আমি না-ও ফিরতে পারি।
একটা কথা বলছিলাম—
মিত্ৰাণীর কণ্ঠস্বরে সুশান্ত আবার ঘুরে তাকায় ওর মুখের দিকে।
বলছিলাম কি–আপনি একটা অন্য ব্যবস্থা করে নিন।
তার মানে? কিসের ব্যবস্থা?
রাহুল ও আপনাকে দেখাশোনা করার জন্য একজন লোকের দরকার হবে তো আমি চলে গেলে!
কেন, তুমি চলে যাচ্ছ নাকি?
হ্যাঁ।
কোথায় যাবে শুনি? মালদহে ফিরে গেলে আর তোমাকে তারা জায়গা দেবে মনে কর নাকি?
নাই যদি দেয় তো কি আর করা যাবে। মৃদু হেসে শান্ত গলায় কথাটা শেষ করে মিত্ৰাণী, মালদহই তো পৃথিবীর শেষ একটিমাত্র স্থান নয়!
ওঃ, পৃথিবীটা চিনে ফেলেছ তাহলে?
চিনতে তো হবেই।
তাই বুঝি?
নচেৎ আমাদের মত মেয়েদের চলবে কি করে?
কিন্তু হঠাৎ এ মতলব কেন? সুশান্তর গলার স্বরটা যেন হঠাৎ কেমন করুণ শোনায়।
মতলব আর কি, দিদির জন্যই তো এসেছিলাম, সে-ই যখন-তাছাড়া–
কি?
এখানে যেন আর এক মুহূর্তও আমি টিকতে পারছি না। দম যেন আমার বন্ধ হয়ে আসছে।
দম বন্ধ হয়ে আসছে!
আপনি একজন লোক ঠিক করে নিন—
হুঁ, কারণটা কি তাই, না অন্য কোথায়ও আশ্রয়ের প্রতিশ্রুতি পেয়েছ কারও কাছ থেকে? মিত্ৰাণী হাসল। বললে, কে দেবে আশ্রয়? গলগ্রহ যারা অন্যের হয় তাদের লজ্জা বা অনিচ্ছা বলে কিছুর বালাই না থাকলেও যারা আশ্রয় দেবে তাদের সর্বক্ষেত্রেই প্রায় বলতে গেলে ঐ দুটোই যে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু সেজন্য আপনাকে ভাবতে হবে না!
ভাবতে হবে না।
না। তেমন যদি বিপাকে পড়িই, অন্ততঃ রাস্তা বলেও একটা জায়গা তো আছেই সংসারে, সেখানে তো অন্ততঃ ঢোকবার বা বেরুনোর জন্য কেউ দরজার সৃষ্টি করে রাখেনি!